পাঁচটি পরিবার নাকি পৃথিবীতে চিনির সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। চিনির উৎপাদন, বাণিজ্য ও নিয়ন্ত্রণ তাঁরাই করতেন। বাংলাদেশেও যাঁরা চিনি নিয়ন্ত্রণ করেন, তাঁদের সংখ্যা হাতেগোনা। তাঁরা যেভাবে বলবেন, সেভাবেই চলবে চিনির বাজার। তাঁদের ওপর এমনকি সরকারও কথা বলে না। তাঁরা নতুন করে কেজিতে ২৫ টাকা বাড়িয়ে চিনি বিক্রির দাবি জানিয়েছেন। এমন অবস্থায় তাঁদের ‘না’ করার সাধ্য কার? কিন্তু এমন অবাস্তব মুক্তবাজার অর্থনীতি কোনো দেশে চলে কিনা, সন্দেহ। বাজার কোথায়ও শতভাগ স্বাধীন না; সরকারের ভূমিকা সেখানে থাকা চাই।
চিনির বাজারে দীর্ঘদিন কোনো সুখবর নেই। চিনি-সংক্রান্ত অধিকাংশ খবরই বলা চলে, মূল্যবৃদ্ধি সংক্রান্ত। ঊর্ধ্বমুখী দ্রব্যমূল্যের বাজারে চিনি এমনই লাগামহীন যে, একে বাগে আনার কোনো লক্ষণ নেই। বরং চিনিকল মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ সুগার রিফাইনার্স অ্যাসোসিয়েশন যখন যেভাবে বাড়ানোর কথা বলছে, সেভাবেই চিনির দাম বাড়ছে। এমনকি কখনও সরকার কিছুটা মধ্যস্থতার চেষ্টা করলেও বাজারে তার প্রতিফলন দেখা যায় না বললেই চলে। বর্তমানে প্রতিকেজি খোলা চিনি ১২০ টাকা এবং প্যাকেটজাত ১২৫ টাকা নির্ধারিত থাকলেও বাজারে বিক্রি হচ্ছে ১৩৫ থেকে ১৪০ টাকায়। এরই মধ্যে নতুন করে চিনির দাম ২৫ টাকা করে বাড়ানোর প্রস্তাব করেছেন মিল মালিকরা। অবস্থা এমন যে, সরকার চাইলেও তাঁদের দাবি না মেনে থাকতে পারবে না। ফলে চিনির চাপ ভোক্তার ওপর আরও জোরালোভাবেই পড়বে।
এক সময় চিনি ছিল আভিজাত্যের প্রতীক। ধনী লোকরা স্বর্ণ দিয়ে চিনির দাম শোধ করত। সাদা দানাদার বিলাসপণ্য এই চিনি এখন সবাই ভোগ করে। তার বিনিময় স্বর্ণ থেকে মুদ্রাতে এসেছে বটে, নতুন দাম বাড়ার প্রবণতা সেই আভিজাত্যের কথাই স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে। এখন চিনির দাম বাড়ার কারণ হিসেবে ঝোলানো হচ্ছে বিশ্ববাজারের মুলা। সেটি অবশ্য অসত্য নয়। কিন্তু বিশ্ববাজারে যখন কোনো পণ্যের দাম বাড়ে, তখন ব্যবসায়ীরা দেশীয় বাজারে তার দাম বাড়ানোয় যতটা তোড়জোড় দেখায়; বিশ্ববাজারে দাম কমার পর সে তৎপরতা কেন দেখা যায় না? এটি সত্য, গত এক বছরে আন্তর্জাতিক বাজারে চিনির দাম প্রায় ২২ শতাংশ বেড়েছে। দেশীয় বাজারে যখন ওই পণ্যের দাম বাড়ানো হবে, তখন সেভাবে সমন্বয় জরুরি। ইতোপূর্বে দফায় দফায় চিনির দাম যেভাবে বাড়ানো হয়েছে, তাতে সেই সমন্বয় দেখা যায়নি। উপরন্তু প্রতিবারই চিনির দাম সরকার যা নির্ধারণ করেছে তার চেয়ে বেশি অর্থ দিয়ে ভোক্তাকে পণ্যটি কিনতে হয়েছে। এখন চিনির দাম এক লাফে ২৫ টাকা বাড়ানোর বিষয়টি কেবল ঘোষণা করতে বাকি। সরকার অবশ্য ঘোষণা দিয়েই ক্ষান্ত। বাজারে তা ভোক্তা কত টাকা দিয়ে কিনছে– কে দেখবে?
চিনি যতটা মিষ্টি, তার ইতিহাস ততটাই তেতো। আমেরিকানরা দাসদের দিয়ে প্রতিষ্ঠা করেছিল চিনির রাজত্ব। পৃথিবীর অন্যান্য জায়গার ইতিহাসও অভিন্ন নয়। এর পরও চিনির কদর কমেনি, বরং বেড়েছে। অনেকে মেদ ঝরানোর জন্য স্বাস্থ্য সচেতন হিসেবে চা, কফি কিংবা অন্যান্য খাদ্যদ্রব্যে চিনি যেভাবে এড়িয়ে চলেন, তার প্রভাব কী বাজারে আছে? নাই। আছে বরং উৎপাদন ঘাটতি। দেশীয় চিনিকলগুলোকে পরিকল্পিতভাবে লোকসানি করে বন্ধ রাখার অভিযোগও নতুন না। মিষ্টি চিনির বাজার তাই তেতো। মানুষ অসহায়, সরকার উদাসীন আর কোম্পানির পোয়াবারো।