রোববার (২ এপ্রিল) জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদের আয়োজিত ইফতার অনুষ্ঠান রাজনৈতিক দিক থেকে নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। সমকালের প্রতিবেদন অনুসারে, এতে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগসহ অন্যান্য দলের নেতারা অংশ নিয়েছেন। ছিলেন বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকরাও। তবে গত ১০ বছরে এই প্রথমবারের মতো এতে যোগ দিয়েছে বিএনপির একটা শক্তিশালী প্রতিনিধি দল, যেখানে ছিলেন স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, ড. আবদুল মঈন খান, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা মনিরুল হক চৌধুরী ও আবদুস সালাম। এত বছর পর বিএনপির অংশগ্রহণের বিশেষ তাৎপর্য রয়েছে বলে পর্যবেক্ষকদের ধারণা। সে জন্যই তিনটি প্রশ্ন সামনে এসেছে।
প্রথম প্রশ্ন– ইফতারে দলটির প্রধান পৃষ্ঠপোষক ও সংসদে বিরোধীদলীয় নেতা রওশন এরশাদ এবং তাঁর ছেলে সংসদ সদস্য রাহগির আল মাহি (সাদ এরশাদ) কেন ছিলেন না? অবশ্য দু’দিন আগে– শনিবার প্রকাশিত সমকালের ফের দেবর-ভাবির বিরোধের খবরেই অনেকটা স্পষ্ট হয়ে যায়, জাপা চেয়ারম্যান জি এম কাদেরের ইফতারে রওশন এরশাদ যাচ্ছেন না। এ বছরের শুরুতে দেবর-ভাবির দীর্ঘদিনের বিরোধের সমঝোতা হয় অনেকটা সরকারের মধ্যস্থতায়। কিন্তু সম্প্রতি আবারও তাঁরা বিরোধে জড়িয়েছেন। রওশন এরশাদের পক্ষ নিয়ে দল থেকে বহিষ্কার হওয়া মসিউর রহমান রাঙ্গা, জিয়াউল হক মৃধাসহ কয়েকজন নেতাকে দলটির প্রধান পৃষ্ঠপোষক দলে ফেরাতে চাইলেও তাতে রাজি নন জি এম কাদের। অন্যদিকে আগামী নির্বাচনে মনোনয়ন অনিশ্চিত বলে রওশনপন্থি কয়েকজন নেতা চান না দেবর-ভাবির মধ্যে ঐক্য হোক। তা ছাড়া রওশন এরশাদের পক্ষের সবাইকে দলে ‘পুনর্বাসনে’ রাজি নন জি এম কাদেরপন্থিরা। এই তিন কারণে তাঁদের বিরোধ রয়ে গেছে এবং খুব শিগগির তাঁদের মধ্যে পুনরায় সমঝোতা হবে– সে সম্ভাবনাও ক্ষীণ। কারণ রওশন এরশাদ সরকারের সঙ্গে সদ্ভাব বজায় রেখেছেন এবং সে পথেই তিনি হাঁটছেন। অন্যদিকে জি এম কাদেরের বক্তব্যে দেখা যাচ্ছে সরকারবিরোধী অবস্থান। অর্থাৎ দু’জনের এখন দুটি পথ। এমনকি সমকালের প্রতিবেদন বলছে, এই ইফতার অনুষ্ঠানে রওশন এরশাদের অনুসারীদের আমন্ত্রণও জানানো হয়নি।
ইফতার অনুষ্ঠান নিয়ে দ্বিতীয় প্রশ্ন– জাতীয় পার্টির অনুষ্ঠানে এক দশক পর বিএনপির যোগ দেওয়ার রহস্য কী? এর আগে জাতীয় পার্টির প্রতিষ্ঠাতা ও আমৃত্যু চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের জীবদ্দশায় তাঁর আমন্ত্রণে সর্বশেষ ২০১৩ সালে জাপার ইফতারে অংশ নিয়েছিল বিএনপি। কিন্তু ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচন বিএনপি বর্জন করলেও রওশন এরশাদের নেতৃত্বে জাতীয় পার্টির একটি অংশ তাতে অংশ নেয়। তখন থেকে দলটির অনুষ্ঠানে বিএনপি নেতারা যোগ দেননি। গত বছরও জাতীয় পার্টি বিএনপিকে আমন্ত্রণ জানায়, কিন্তু বিএনপি নেতারা তাতে অংশ নেননি। এ বছর যদিও বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ইফতারে আমন্ত্রণ পেয়েও যাননি; তার পরও অন্য নেতাদের অংশ নেওয়া একেবারে সাদামাটা বিষয় নয়। বস্তুত গত বছরের মাঝামাঝি থেকেই গুঞ্জন– জি এম কাদেরের নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টি বিএনপির দিকে ঝুঁকছে কিনা। তার ওই সময়ের বক্তব্য অনেকটাই বিএনপি নেতাদের বক্তব্যের সঙ্গে মিলে যায়। তা ছাড়া এর আগ থেকেই তিনি বলে আসছিলেন, জাপা আর আওয়ামী লীগের সঙ্গে নেই। এও বলেছেন, কোন জোটে তাঁরা যোগ দেবেন, তা সময়ই বলে দেবে। আমরা দেখেছি, গত বছরের শেষে সরকারকে ক্ষমতা থেকে অপসারণ, নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনসহ ১০ দফা দাবি বাস্তবায়নে বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলের মধ্য থেকে ১২টি দল নতুন জোট গঠন করে। সেখানে মোস্তফা জামাল হায়দারের নেতৃত্বে জাতীয় পার্টি (জাফর) রয়েছে। জি এম কাদের সেই জোটে যোগ দেবেন কিনা কিংবা এর সঙ্গে জাতীয় পার্টির ইফতারে বিএনপির অংশগ্রহণের সম্পর্ক রয়েছে কিনা, তা সময়ই বলে দেবে। তবে এটা বোঝা যাচ্ছে, বিএনপির সঙ্গে তাদের এক ধরনের সম্পর্ক চলছে। ১০ বছর পর বিএনপি নেতাদের আগমন প্রসঙ্গে জাপা চেয়ারম্যান জি এম কাদের সমকালকে বলেছেন, রাজনৈতিক মতভিন্নতা থাকলেও ইফতারে অংশ নেওয়া উচিত। আমন্ত্রণ রক্ষা করায় বিএনপিকে ধন্যবাদ। তা ছাড়া সোমবার বিএনপির ইফতার অনুষ্ঠানের ব্যাপারে তিনি বলেছেন, পূর্বনির্ধারিত কর্মসূচি থাকায় বিএনপির ইফতারে যেতে পারছেন না। তবে জাপার সিনিয়র কো-চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নুসহ প্রতিনিধি দল যাবে।
তৃতীয় প্রশ্ন– সরকারের সঙ্গে জাতীয় পার্টির সম্পর্ক কেমন হবে? বলাবাহুল্য, দলটির ইফতারে অন্যান্য বছরের তুলনায় আওয়ামী লীগ নেতাদের উপস্থিতি ছিল কম। সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক এতে অংশ নেন। এ ছাড়া আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদক বিপ্লব বড়ুয়াও ইফতার অনুষ্ঠানে ছিলেন। এটা স্পষ্ট, আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে জাতীয় পার্টির এ ইফতার নিয়ে আগ্রহ কম ছিল। এর পেছনে রওশন এরশাদের সঙ্গে জি এম কাদেরের শীতল সম্পর্কও ভূমিকা রাখতে পারে। সংসদে বিরোধীদলীয় নেতা হলেও রওশন এরশাদের অবস্থান স্পষ্ট। তিনি অতীতে যেমন বর্তমান সরকারে সঙ্গে ছিলেন; বর্তমানে আছেন এবং ভবিষ্যতেও তাঁর অবস্থান নড়চড় হওয়ার সম্ভাবনা কম। কিন্তু জি এম কাদেরের অবস্থান নিয়ে সংশয় থেকেই যাচ্ছে। যদিও জাতীয় পার্টি নিয়ে শেষ কথা বলার সময় আসেনি। গত ডিসেম্বরে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করেন রওশন এরশাদ ও জি এম কাদের। সরকারের পক্ষ থেকে আবার কোনো সমঝোতার উদ্যোগ নিলে দেবর-ভাবির একমত হওয়া হয়তো সময়ের ব্যাপার।
জাতীয় পার্টির ইফতার অনুষ্ঠানে অংশ নিয়ে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি নেতারাও এক টেবিলে বসেছেন। এক টেবিলে ইফতার করেন দুই প্রতিদ্বন্দ্বী দেশ যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত পিটার হাস ও চীনা রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েনও। ইফতার আয়োজন সামাজিক অনুষ্ঠানের অংশ। এখানেও রাজনীতির শত্রু-মিত্রের এক টেবিলে বসাকে অস্বাভাবিক হিসেবে দেখার সুযোগ সামান্যই। কিন্তু এর আয়োজক যখন জাতীয় পার্টি আর নির্বাচন যখন ঘনিয়ে আসছে, তখন এ নিয়ে প্রশ্ন ওঠা অস্বাভাবিক নয়। এইচএম এরশাদ সকাল-বিকেল মত পাল্টানোর যে সংস্কৃতি চালু করে গেছেন এবং তাঁর সময় থেকে নির্বাচন এলেই যেভাবে জাতীয় পার্টিতে ভাঙন ধরেছে, সেখান থেকে দলটির বের হওয়ার সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। সে নিরিখে দেখলে দলটির ইফতার অনুষ্ঠানে বিএনপির অংশগ্রহণ প্রশ্নহীন হতে পারে না।