Mahfuzur Rahman Manik
পাহাড় রক্ষায় জাতীয় কমিশন প্রয়োজন
ফেব্রুয়ারী 6, 2023

সাক্ষাৎকার: অধ্যাপক ড. খালেদ মিসবাহুজ্জামান

সাক্ষাৎকার গ্রহণ: মাহফুজুর রহমান মানিক

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বন ও পরিবেশ বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. খালেদ মিসবাহুজ্জামান শিক্ষকতা ও গবেষণার পাশাপাশি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে পরামর্শক হিসেবেও কাজ করছেন। ২০০২ সালে বর্তমান বিভাগে যোগ দেওয়ার আগে তিনি খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেছেন। তারও আগে ১৯৯৩ সালে বাংলাদেশ বন বিভাগে কর্মজীবন সূচিত হয়। এই বন গবেষক চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ফরেস্ট্রি ইনস্টিটিউট থেকে ১৯৯২ সালে স্নাতক, যুক্তরাজ্যের ইউনিভার্সিটি অব এডিনবড়া থেকে পিএচডি এবং যুক্তরাষ্ট্রের পেন স্টেট ইউনিভার্সিটি ও ডেনমার্কের ইউনিভার্সিটি অব কোপেনহেগেন থেকে পোস্ট-ডক্টরাল সম্পন্ন করেন। তিনি জার্মানির মিউনিখ ইউনিভার্সিটির পরিবেশ ও সমাজবিষয়ক র‌্যাসেল কার্সন ফেলো।

সমকাল: গবেষণায় এসেছে চট্টগ্রাম মহানগরের ৬০ শতাংশ পাহাড় ধ্বংস করা হয়েছে। বাস্তবতা কি এতটাই ভয়াবহ?

খালেদ মিসবাহুজ্জামান: চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও চট্টগ্রাম প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা ও ইউএনডিপির প্রতিবেদন বিশ্নেষণে দেখা গেছে, গত ৪০ বছরে চট্টগ্রাম মহানগরের ৬০ শতাংশ পাহাড় ধ্বংস করা হয়েছে। এ সংক্রান্ত সর্বশেষ গবেষণা হয়েছে তাও অন্তত ১০-১২ বছর হয়ে গেছে। নতুন করে গবেষণা হলে সংখ্যাটি নিশ্চয়ই আরও বাড়বে। এটিই বাস্তবতা।

সমকাল: দেশের অন্যান্য স্থানে পাহাড়ের পরিণতিও কি এমনই?

খালেদ মিসবাহুজ্জামান: দেশের ভূভাগের ২০ শতাংশ পাহাড়ি অঞ্চল। আর ১০ শতাংশ শুধু পাহাড়। পাহাড়ের অধিকাংশই চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রামে অবস্থিত। এর বাইরে বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলে পাহাড় আছে; আছে কুমিল্লা, শেরপুর ও নেত্রকোনায়। আমি সম্প্রতি সিলেটের পাহাড়ি অঞ্চলেও ঘুরেছি। তবে চট্টগ্রামে পাহাড় যতটা ধ্বংস হয়েছে, দেশের অন্যান্য স্থানের পরিস্থিতি এতটা খারাপ বলে আমার মনে হয় না।

সমকাল: পাহাড় ধ্বংসের পরিণতি কী?

খালেদ মিসবাহুজ্জামান: পাহাড় ধ্বংসের পরিণতি ভয়াবহ। পাহাড়কে সাধারণ মানুষ বলে ভূপৃষ্ঠের খুঁটি। আমরা যাঁরা পাহাড় নিয়ে গবেষণা করি তাঁরা বলি- জলস্তম্ভ। পাহাড় ভূপৃষ্ঠের প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষায় খুঁটির মতো কাজ করে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলা ছাড়াও জীববৈচিত্র্য ও সুপেয় পানির প্রাকৃতিক আধার হিসেবে কাজ করে পাহাড়। ক্রমাগতভাবে পাহাড়ি বন আর পাহাড় ধ্বংস হলে যে বনহীন ভূমি সৃষ্টি হবে, সেটি হবে পরিবেশের জন্য ভয়ানক। আমাদের বাস্তুতন্ত্র রক্ষায়ও পাহাড়ের জীববৈচিত্র্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। চট্টগ্রামের যে জলাবদ্ধতার সমস্যা, পাহাড় কাটার কারণেই সেটি আরও বাড়ছে। পাহাড় রক্ষা আমাদের জীবনের জন্যই জরুরি।

সমকাল: পাহাড় কীভাবে সুপেয় পানির প্রাকৃতিক আধার হিসেবে কাজ করে?

খালেদ মিসবাহুজ্জামান: পাহাড়ের মধ্যে গাছ, বিভিন্ন প্রজাতির বৃক্ষলতা থাকে। পাহাড়ের গাছপালার স্বাভাবিক বৃদ্ধির জন্য ভূগর্ভস্থ পানি দরকার আর গাছের শিকড় প্রয়োজনে ব্যবহারের জন্য তা ভূমির ওপরের স্তরে ধরে রাখে। এভাবে প্রাপ্ত পানি কেবল বনের গাছপালার প্রয়োজনই মেটায় না, মানুষ আর প্রাণী ছাড়াও অন্য জীবকুলের ব্যবহার্য স্বাদু পানির সরবরাহও এ থেকে পাওয়া যায়।

সমকাল: তার মানে পাহাড়ে যে বৃক্ষ নিধন হচ্ছে, তারও নেতিবাচক ফল রয়েছে?

খালেদ মিসবাহুজ্জামান: কেবল পাহাড় কাটা নয়, পাহাড়ের বৃক্ষ নিধন হলে পানির স্তর আরও নিচে নেমে যাবে। সুপেয় পানির সরবরাহও কমে যাবে। তা ছাড়া বৃক্ষ ছাড়া পাহাড়ও টিকে থাকতে পারে না। বৃক্ষ নিধন খোদ পাহাড় ধ্বংসেও ভূমিকা রাখছে।

সমকাল: পাহাড়ধসে মানুষ মারার যে মিছিল আমরা দেখছি, সেখানেও তো এর প্রভাব স্পষ্ট?

খালেদ মিসবাহুজ্জামান: পাহাড় কাটা ও পাহাড়ে বৃক্ষ নিধন পাহাড়ধস ত্বরান্বিত করে। এক হিসাবে দেখা গেছে, গত ১৫ বছরে চট্টগ্রাম মহানগর এবং আশপাশের এলাকায় পাহাড়ধসে আড়াইশ মানুষের প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে। দুস্কৃতকারীরা বর্ষার শুরুতে পাহাড় কেটে রাখে, তাতে বৃষ্টির পানিতে পাহাড় ধসে যায়। পাহাড়ে যারা স্থানীয় এবং আগে থেকে বসবাস করছে, তাদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। অনেকে ছিন্নমূলদের এনে পাহাড়ে বসতির ব্যবস্থা করছে। তাদের একটি ডাটাবেজ তৈরি করে সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে হবে।

সমকাল: দুস্কৃতকারী বলতে কাদের বোঝাচ্ছেন?

খালেদ মিসবাহুজ্জামান: দুস্কৃতকারীরা স্থানীয়ভাবে প্রভাবশালী। আমি বিশ্বাস করতে চাই না, তারা রাজনৈতিক ছত্রচ্ছায়ায় কাজ করে। তবে তারা অমুক মন্ত্রী, তমুক এমপি-নেতার নাম ভাঙিয়ে কাজ করে। দুঃখজনক হলেও সত্য, পাহাড়খেকোদের সঙ্গে পাহাড় রক্ষার কাজে নিয়োজিত সংশ্নিষ্ট বিভাগের কারও কারও যোগসাজশ রয়েছে।

সমকাল: দুস্কৃতকারীরা তো এখন পরিবেশকর্মীদের ওপরও হামলা করছে।

খালেদ মিসবাহুজ্জামান: সম্প্রতি বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি-বেলার প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান চট্টগ্রামে পাহাড় কাটা দেখতে গিয়ে যেভাবে হামলার শিকার হয়েছেন, তা অত্যন্ত ন্যক্কারজনক। সেখানে পাহাড় কাটার ক্ষেত্রে প্রভাবশালীদের যুক্ত থাকার কারণেই তারা এমন দুঃসাহস করেছে। হামলার সঙ্গে যারা জড়িত তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হওয়া প্রয়োজন।

সমকাল: পাহাড় সুরক্ষায় কী ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে?

খালেদ মিসবাহুজ্জামান: পাহাড় সুরক্ষায় দুই ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি- প্রশাসনিক তৎপরতা ও জনসচেতনতা। প্রশাসনিক তৎপরতায় আমরা দেখছি পাহাড়ে কিছু ঘটলে তখন কর্তৃপক্ষ নড়েচড়ে বসে কিংবা সময়ে সময়ে কিছু অভিযান পরিচালনা করা হয়। কিন্তু প্রশাসনিক এসব পদক্ষেপ যথেষ্ট নয়।

সমকাল: পাহাড় রক্ষায় প্রশাসনিক পদক্ষেপ যথেষ্ট নয় কেন?

খালেদ মিসবাহুজ্জামান: প্রশাসনের অভিযান হলেও প্রায়ই হোতারা ধরা পড়ে না। পাহাড় রক্ষায় একক কোনো কর্তৃপক্ষ নেই। সমস্যা হলে একেক সময় একেক প্রতিষ্ঠান এ নিয়ে কাজ করে। সে জন্য পাহাড় রক্ষার কাজটি সেভাবে হচ্ছে না। আমি মনে করি, নদী রক্ষায় যেমন 'জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন' রয়েছে, তেমনি পাহাড় রক্ষায় 'জাতীয় পাহাড় রক্ষা কমিশন' গঠন করা প্রয়োজন।

সমকাল: পাহাড় রক্ষা কমিশন কেন জরুরি?

খালেদ মিসবাহুজ্জামান: পাহাড় রক্ষা জরুরি অথচ সে জন্য নিয়মিত এর রক্ষণাবেক্ষণ কিংবা এ নিয়ে ভাবার কেউ নেই। পরিবেশ অধিদপ্তরের কাজ ব্যাপক এবং বন রক্ষায় বন অধিদপ্তরও রয়েছে। তবে প্রয়োজনীয় জনবলের অভাবে এগুলো পাহাড় রক্ষায় তেমন কাজ করতে পারছে না। তাহলে পাহাড় রক্ষা করবে কে? সে কারণেই পাহাড় রক্ষা কমিশন গঠনের বিষয়টি জরুরি।

সমকাল: পাহাড় সংরক্ষণে জরিপ প্রস্তাব দিয়েছে চট্টগ্রাম পরিবেশ অধিদপ্তর। সেটি কতটা জরুরি?

খালেদ মিসবাহুজ্জামান: চট্টগ্রাম পরিবেশ অধিদপ্তর চট্টগ্রামের পাহাড় রক্ষণাবেক্ষণ ও সংরক্ষণে ইতোপূর্বে নকশা প্রণয়ন ও রেখা জরিপের প্রস্তাব দিয়েছে। আমি মনে করি, এটি অতি উত্তম প্রস্তাব। সেভাবে জরিপ কার্যক্রম পরিচালিত হলে চট্টগ্রাম জেলার পাহাড় এলাকার নকশা প্রণয়ন এবং কী পরিমাণ পাহাড় চট্টগ্রামে আছে বা ধ্বংস হয়েছে, তারও বিস্তারিত তথ্যের ডাটাবেজ তৈরি করা সম্ভব হবে।

সমকাল: পাহাড় রক্ষায় সচেতনতামূলক কর্মসূচির কথা বলা হয়। কিন্তু শুধু কথায় কি চিড়ে ভিজবে?

খালেদ মিসবাহুজ্জামান: পাহাড় কাটার ক্ষতিকর দিক যদি পাহাড়খেকোরা অনুধাবন করে, আমার ধারণা তারা এমন ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ড থেকে পিছিয়ে আসবে। তাদের অনেকের মধ্যেই এই বোধ নেই যে, তারা পাহাড় কেটে যা লাভ করছে, তার চেয়ে নিজের ও সমাজের ক্ষতি করছে অনেক বেশি। সংবাদমাধ্যমসহ সব স্তর থেকে সচেতনতা কার্যক্রম জোরদার করলে পাহাড় কাটার বিরুদ্ধে জনপ্রতিরোধ গড়ে উঠবে বলে আমার বিশ্বাস।

সমকাল: উন্নয়নের স্বার্থে যেখানে পাহাড় কাটা জরুরি, সেখানে প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা কী?

খালেদ মিসবাহুজ্জামান: জরুরি উন্নয়ন কর্মকাণ্ড পরিচালনার জন্য পাহাড় কাটলেও সেখানে কিছু ব্যবস্থা নিতে হবে। আমরা দেখেছি সম্প্রতি চট্টগ্রামের বায়েজিদ থেকে ফৌজদারহাট পর্যন্ত ছয় কিলোমিটার সড়ক পাহাড় কেটে নির্মাণ করা হয়েছে। এসব ক্ষেত্রে পাহাড় কাটার নিয়ম হলো, মোটামুটি ২৬ ডিগ্রি কোণে ঢাল কেটে কাজ করা। ভূমিধস যাতে না হয়, সে জন্য এর চেয়ে বেশি ঢালুভাবে পাহাড় কাটা যাবে না। পাহাড় কাটার পর সেখানে যথাসম্ভব গাছ লাগানোর ব্যবস্থা করা চাই। গাছ লাগানোর মতো পরিস্থিতি না থাকলে এর প্রকৌশলগত সমাধান রয়েছে। সেটি হলো, পাহাড়ে সুরক্ষা দেয়াল তৈরি।

সমকাল: পাহাড়িদের ভূমি অধিকার রক্ষার সঙ্গে পাহাড় সুরক্ষা কতটা জড়িত?

খালেদ মিসবাহুজ্জামান: পাহাড়ের নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠী, যাদের জীবন-জীবিকা পাহাড়ের ওপর নির্ভরশীল, তাদের ভূমির অধিকার জরুরি। আমি মনে করি না, তারা পাহাড় ধ্বংসে কাজ করে। যেহেতু পাহাড়ের সঙ্গে তাদের জীবন ওতপ্রোতভাবে জড়িত, সে জন্য তারা এ ব্যাপারে সচেতন। আর ভূমি অধিকার রক্ষার বিষয়টিতে আমি বিশ্বাস করি, সরকার সচেতন। সমন্বিত পরিকল্পনার মাধ্যমে তাদের ভূমি অধিকার নিশ্চিত করতে সরকার কাজ করছে।

সমকাল: সময় দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ।

খালেদ মিসবাহুজ্জামান: আপনাকেও ধন্যবাদ। সমকালের জন্য শুভকামনা।

সমকালে প্রকাশ: ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৩

ট্যাগঃ , ,

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।