সাক্ষাৎকার: ড. মনজুর আহমদ
সাক্ষাৎকার গ্রহণ: মাহফুজুর রহমান মানিক
ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক ড. মনজুর আহমদ গণসাক্ষরতা অভিযানের (ক্যাম্প) ভাইস চেয়ারম্যান এবং বাংলাদেশ আর্লি চাইল্ডহুড ডেভেলপমেন্ট নেটওয়ার্কের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি দুই দশকেরও বেশি সময়ে ইউনিসেফে কাজ করেছেন। কান্ট্রি ডিরেক্টর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন চীন, ইথিওপিয়া ও জাপানে। এর আগে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের কানেকটিকাটে ইন্টারন্যাশনাল কাউন্সিল ফর এডুকেশনাল ডেভেলপমেন্টের জ্যেষ্ঠ গবেষক হিসেবে কাজ করেছেন।
সমকাল: ছাত্র রাজনীতির প্রশ্নে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ, অভিভাবক ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে যে শঙ্কা; তাকে কি রাজনীতিভীতি বলা যায়?
মনজুর আহমদ: সরকারি, বেসরকারি নির্বিশেষে আমাদের উচ্চশিক্ষা এখন সংকটে। যে কোনো নতুন পদক্ষেপের ফলাফল গভীরভাবে যাচাই করে দেখতে হবে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র রাজনীতির যে স্বরূপ; তার বিস্তার বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে হলে শঙ্কিত হওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে। বর্তমান ছাত্র রাজনীতি মানে হচ্ছে, শিক্ষাঙ্গনে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের ছাত্র শাখার একচ্ছত্র আধিপত্য। সংঘাত, ক্ষমতা প্রদর্শন, শিক্ষার্থীদের বলপূর্বক নিয়ন্ত্রণে রাখা, প্রশাসনে হস্তক্ষেপের চেষ্টা, নানা দুর্নীতি, চাঁদাবাজি- এসবই ছাত্র রাজনীতির বৈশিষ্ট্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। শিক্ষাঙ্গনে শিক্ষার পরিবেশ রক্ষায় ছাত্র রাজনীতি প্রধান বাধা হিসেবে দেখা দিয়েছে। অভিভাবক ও শিক্ষার্থীদের কাছে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি বড় আকর্ষণ হচ্ছে- বিরাজমান ছাত্র রাজনীতি এখানে নেই। এ পরিস্থিতির পরিবর্তন তাঁরা চান না। এটাকে রাজনীতিভীতি না বলে বর্তমানে অপরাজনীতির প্রভাব থেকে দূরে থাকার চেষ্টা হিসেবে দেখাই সংগত।
সমকাল: কিন্তু আমাদের ছাত্র রাজনীতির তো গৌরবময় ঐতিহ্য রয়েছে।
মনজুর আহমদ: ছাত্র রাজনীতির গৌরবের কথা বলতে গেলে বিভিন্ন ঐতিহাসিক সন্ধিক্ষণে জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ সমস্যার ক্ষেত্রে ছাত্রদের অবস্থান, আন্দোলন ও অনেক ক্ষেত্রে অগ্রবর্তী ভূমিকার কথা স্মরণ করতে হয়। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার দাবি, শিক্ষা সংস্কার; সর্বোপরি স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ে ছাত্ররা যোগ দিয়েছে, জীবন উৎসর্গ করেছে। সেই ঐতিহ্যের কতখানি অবশিষ্ট আছে এখন? অন্তত ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের ছাত্র শাখাকে এ ধরনের ভূমিকায় দেখা যায় না। সাম্প্রতিককালে আমরা দেখেছি শাহবাগ আন্দোলন, কোটাবিরোধী আন্দোলন, নিরাপদ সড়কের দাবি ইত্যাদিতে সাধারণ ছাত্রসমাজ স্বতঃস্ম্ফূর্তভাবে যোগ দিয়েছে; নিজেরা সংগঠিত হয়েছে। ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের ছাত্র শাখা এসবের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। বিভিন্নভাবে এগুলোকে প্রতিরোধেরও চেষ্টা করেছে। মস্তান ও হেলমেট বাহিনী তৈরি করে সহিংসতা ও ভীতির পরিবেশ সৃষ্টি করেছে।
সমকাল: ছাত্র রাজনীতি পথ হারাল কেন?
মনজুর আহমদ: ছাত্র রাজনীতির ঐতিহ্যের এক বড় অংশ ছিল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নির্বাচিত ছাত্র সংসদ। এটি ছিল নানা সাংস্কৃতিক, সৃজনশীল, বিনোদনমূলক কার্যকলাপের ব্যবস্থা; ছাত্রদের সমস্যা, দাবিদাওয়া তুলে ধরা ও সমাধানের জন্য আলোচনা এবং ছাত্রদের মধ্যে নেতৃত্বচর্চার ক্ষেত্র। প্রচলিত ছাত্র রাজনীতিতে এই প্রক্রিয়াকে বিসর্জন দেওয়া হয়েছে। আদালতের নির্দেশে দুই দশক পর ২০১৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ নির্বাচন হয়। নির্বাচনের ফলাফল দেশের ক্ষমতাধরদের মনঃপূত না হওয়ায় এই পথে আর তাঁরা পা বাড়াচ্ছেন না। আর কোনো বিশ্ববিদ্যালয়েও ছাত্র সংসদ নির্বাচনের কথা শোনা যাচ্ছে না।
সমকাল: বিদ্যমান পরিস্থিতিতে করণীয় কী?
মনজুর আহমদ: সাধারণভাবে বলা যায়, সব শিক্ষার্থী, বিশেষত উচ্চশিক্ষা পর্যায়ের শিক্ষার্থীরা সমাজ-সচেতন, দেশপ্রেমিক নাগরিক হিসেবে গড়ে উঠবে, মূল্যবোধসম্পন্ন হবে; তারুণ্যের আবেগে অন্যায়ের প্রতিবাদ করবে- এটাই শিক্ষাবিদদের চাওয়া। দেশের রাজনীতি, বিদ্যমান ছাত্র রাজনীতি ও শিক্ষা প্রশাসনের সরকার নিয়োজিত নেতৃত্ব অনেক ক্ষেত্রে এই চাওয়াকে বাধাগ্রস্ত করছে। স্মরণ করা যেতে পারে, ২০১০ সালের এপ্রিল মাসে নতুন শিক্ষানীতির খসড়া প্রকাশিত হওয়ার পর তা বাস্তবায়নে সঠিক পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য দেশের বিশেষ বরেণ্য পাঁচ শিক্ষাবিদ অধ্যাপক কবীর চৌধুরী, আনিসুজ্জামান, জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী, জামাল নজরুল ইসলাম ও সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী আহ্বান জানিয়েছিলেন। বিভিন্ন সুপারিশের মধ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে তাঁদের আবেদন ছিল- শিক্ষাঙ্গনে শিক্ষার পরিবেশ রক্ষা এবং অপরাজনীতি থেকে শিক্ষাঙ্গনকে দূরে রাখার জন্য যেন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ তাদের ছাত্র শাখার সঙ্গে গাঁটছড়া ছিন্ন করে এবং নিয়ম ও শৃঙ্খলা বজায় রাখতে বিনা পক্ষপাতিত্বে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে পূর্ণ সহযোগিতা দেয়। এভাবে ছাত্র রাজনীতির গৌরবের ঐতিহ্যও ফিরে আসতে পারে- তাঁরা বলেছিলেন।
সমকাল: সেই পরামর্শ তো এখনও প্রাসঙ্গিক।
মনজুর আহমদ: বর্তমান সময়েও তরুণদের নেতৃত্বচর্চার সুযোগ, রাজনৈতিক চেতনা সৃষ্টি, নাগরিক দায়িত্ববোধ তৈরি এবং শিক্ষক ও শিক্ষাজীবনের সমস্যা তুলে ধরার প্রকৃষ্ট উপায় হবে প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে নির্বাচিত ছাত্র সংসদ। ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র শাখার প্রভাব বিস্তার বিপরীত পরিণতির দিকে নিয়ে যাওয়ার আশঙ্কাই বেশি।
সমকাল: বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের একাডেমিক শিক্ষার বাইরে সমাজ-চেতনা, দায়িত্বশীল নাগরিক তৈরির প্রয়োজন আছে নিশ্চয়।
মনজুর আহমদ: অবশ্যই প্রয়োজন আছে। আমি মনে করি, সরকারি ও বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নেতৃত্বদাতা ও ব্যবস্থাপকদের এই বিষয়গুলোকে বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে। এই দায়িত্ব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধান অংশীজনের ওপর বর্তায়। তবে সরকারের শিক্ষা প্রশাসন ও বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনকে এ ব্যাপারে সহায়ক পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে এবং প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে তার দায়িত্ব পালনে নিরপেক্ষভাবে সহযোগিতার হাত বাড়াতে হবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের একাডেমিক ও প্রশাসনিক নেতৃত্ব, শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের সম্মিলিতভাবে অংশগ্রহণমূলক প্রক্রিয়ায় এ কাজে যুক্ত হওয়ার সুযোগ থাকতে হবে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন বিষয় ও আগ্রহভিত্তিক সংগঠন চালু আছে, কিন্তু নির্বাচিত ছাত্র সংসদ প্রক্রিয়া এখনও সব জায়গায় চালু হয়নি। এ ব্যাপারে প্রতিষ্ঠানগুলোর আরও উদ্যোগী হওয়া দরকার।
সমকাল: বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সমিতি বলছে, শিক্ষার্থীরা ব্যক্তিগতভাবে ক্যাম্পাসের বাইরে রাজনীতিতে যোগ দিতে পারে। ক্যাম্পাসে নয় কেন?
মনজুর আহমদ: দেশের রাজনীতিতে সংযুক্ত হওয়ার অধিকার শিক্ষার্থী-শিক্ষকসহ প্রত্যেক নাগরিকের আছে। এটাকে একটি নাগরিক দায়িত্ব হিসেবেও দেখা যায়। সচেতন নাগরিকের বিভিন্ন রাজনৈতিক প্রশ্নে সুবিবেচিত অবস্থান থাকা গণতন্ত্রচর্চার জন্য প্রয়োজন। তবে প্রাতিষ্ঠানিক দায়িত্ব ও ভূমিকা পালন এবং রাজনৈতিক অবস্থান বা সংশ্নিষ্টতায় ভারসাম্য রক্ষা কীভাবে হবে, তা নিয়ে মতপার্থক্য থাকতে পারে। এ ব্যাপারে প্রতিষ্ঠান নিজস্ব নীতিমালা ও আচরণবিধি আলোচনা-সংলাপের মাধ্যমে অংশগ্রহণমূলক প্রক্রিয়ায় স্থির করতে পারে। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন এ ব্যাপারে অংশীজনের সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতে সাধারণ নীতি কাঠামো তৈরি করতে পারে, যা কাজে লাগবে প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব আচরণবিধি তৈরিতে। দেশের রাজনৈতিক নেতৃত্বকে এ ক্ষেত্রে তাৎক্ষণিক রাজনৈতিক স্বার্থ ত্যাগ করে বৃহত্তর মঙ্গলের কথা ভাবতে হবে।
সমকাল: ছাত্র রাজনীতি ছাত্রদের দাবিদাওয়া ও সমস্যা তুলে ধরা এবং সমাধানের উপায় মনে করা হয়। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে কি এসবের প্রয়োজন নেই?
মনজুর আহমদ: তাত্ত্বিকভাবে এ কথায় যুক্তি আছে। বাস্তবে বিরাজমান ছাত্র রাজনীতি শিক্ষা ও শিক্ষাজীবনের সমস্যা সমাধানে কোনো অনুকূল ভূমিকা রাখার দাবি সত্যের অপলাপ ছাড়া কিছু নয়। বরং দলভিত্তিক ছাত্র রাজনীতি সমস্যা সৃষ্টিতে তৎপর। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়েও নির্বাচিত ছাত্র সংসদ দলীয় ভিত্তিতে দখলদারির মধ্যে পড়ে গেলে সমস্যার জটিলতা বাড়বে। এ ব্যাপারে উচ্চতম রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক মহলে আত্মবিশ্নেষণ প্রয়োজন। তাঁরা কী চান, সেটা তাঁদের ভাবতে হবে। দেশের সামগ্রিক রাজনৈতিক সংস্কৃতি ও আচরণ যে বিভাজন ও সংঘাতময় পরিবেশ সৃষ্টি করেছে, তা থেকে শিক্ষাঙ্গন ও পরবর্তী প্রজন্মকে নিরাপদ দূরত্বে রাখার সর্বাঙ্গীণ প্রচেষ্টা হবে দেশ ও শিক্ষার জন্য মঙ্গলজনক। সংঘাত ও আধিপত্য বিস্তারের ভিত্তিতে চালিত ছাত্র রাজনীতির প্রসার হবে আত্মঘাতী পদক্ষেপ।
সমকাল: সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
মনজুর আহমদ: আপনাকেও ধন্যবাদ। সমকালের জন্য শুভকামনা।