আগামী সংসদ নির্বাচন ঘিরে বাংলাদেশের রাজনীতিতে নানামুখী যে তৎপরতা শুরু হয়েছে; জাতীয় পার্টিতেও তার প্রভাব স্পষ্ট। সম্প্রতি জাতীয় পার্টির প্রধান পৃষ্ঠপোষক রওশন এরশাদ হঠাৎ এক চিঠিতে দলের কাউন্সিল আহ্বানের কথা জানিয়েছেন। ৩১ আগস্ট পাঠানো ওই চিঠিতে আগামী ২৬ নভেম্বর দলের কাউন্সিল আহ্বান করা হয়েছে; যদিও দলটির চেয়ারম্যান জি এম কাদের ওই চিঠি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। কারণ তিনি মনে করেন, যেখানে জাতীয় পার্টিতে চেয়ারম্যানের হাতেই সর্বময় ক্ষমতা; সেখানে প্রধান পৃষ্ঠপোষক হিসেবে দলের কাউন্সিল ডাকার এখতিয়ার রওশন এরশাদের নেই। হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের মৃত্যুর পর রওশন এরশাদকে জাতীয় পার্টির প্রধান পৃষ্ঠপোষক বানানো হয় এবং চেয়ারম্যান হন জি এম কাদের। এর আগে জি এম কাদের ও রওশান এরশাদের মধ্যে পাল্টাপাল্টি অবস্থান আমরা দেখেছি।
রওশন এরশাদ এমন সময়ে কাউন্সিল আহ্বান করে এ চিঠি দিয়েছেন, যখন তিনি অসুস্থ এবং ব্যাংককের একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। এর আগে আট মাস পর তিনি গত ২৭ জুন দেশে আসেন। বলা হয়, জাপা থেকে বিচ্যুত ও বহিস্কৃৃত কয়েকজন নেতা তাঁকে দেশে আনেন, যাতে তাঁদের বহিস্কারাদেশ প্রত্যাহার করতে দলের শীর্ষ নেতা জি এম কাদেরের ওপর রওশন এরশাদ চাপ সৃষ্টি করেন। কিন্তু সে চেষ্টা ভেস্তে যায়। এখন নতুন করে সম্মেলন আহ্বান এবং কমিটি গঠনের চিঠি ওইসব বহিস্কৃৃত নেতার অপতৎপরতা বলছেন জাতীয় পার্টির অনেকেই।
তবে রওশন এরশাদের হঠাৎ তৎপরতা নির্বাচনমুখী রাজনীতির আলোকেও ব্যাখ্যা করার অবকাশ রয়েছে। সেটা অবশ্য বুঝতে হবে জি এম কাদেরের অবস্থান দেখে। আমরা দেখছি, এ সময়ে বিএনপি মাঠে ব্যাপক তৎপর। হামলা-মামলার শিকার হয়েও দলটি মাঠে থাকার ঘোষণা দিয়েছে। অন্যান্য দলেরও নির্বাচনী তৎপরতা থেমে নেই। জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদেরও এ সময়ে নানাভাবে আলোচনায় রয়েছেন। তিনি নতুন জোট নিয়ে আসছেন কিনা- সে প্রশ্নও উঠছে। সম্প্রতি বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ও জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদেরকে একই সঙ্গে দেখা গেছে গত ১৯ আগস্ট নিখোঁজ বিএনপি নেতা এম ইলিয়াস আলীর ছেলে আবরার ইলিয়াসের বিয়ের অনুষ্ঠানে। সে জন্য এ প্রশ্নও উঠছে- জাতীয় পার্টি বিএনপির সঙ্গে জোট বাঁধতে যাচ্ছে কিনা।
সম্প্রতি অনেক বিষয়েই জি এম কাদেরের প্রকাশ্যে সরকারের বিরোধিতা করে বক্তব্যের কারণেও নানামুখী গুঞ্জন শুরু হয়। ২৫ আগস্ট জাপা চেয়ারম্যানের বনানী কার্যালয়ে ঢাকা মহানগর উত্তরের সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটির সভায় তিনি বলেন, অধিকাংশ রাজনৈতিক দলের মতামত উপেক্ষা করে দেড়শ আসনে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনে (ইভিএম) ভোট নেওয়ার সিদ্ধান্তে নির্বাচন কমিশন নিজেকেই প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। জি এম কাদেরের আশঙ্কা, নির্বাচন কমিশন (ইসি) সরকারের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করছে। কিন্তু এ বক্তব্যের মাধ্যম জি এম কাদের নিজেই সরকারের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করছেন কিনা- রাজনৈতিক বোদ্ধারা সে প্রশ্নটিও রাখছেন। এটা স্পষ্ট, শারীরিক নাজুক অবস্থা এবং দলে 'দুর্বল' অবস্থানের কারণে রওশন এরশাদ ২০১৪ সালের নির্বাচনে কিংবা ২০১৮ সালে যেভাবে নির্বাচনের পক্ষে কাজ করেছিলেন; এবার তাঁর সে ভূমিকা রাখা অনেকটা অসম্ভব। সে কারণে আগামী নির্বাচনে বিএনপি যদি নাও আসে; তাতে জি এম কাদেরকে দিয়ে 'শক্তিশালী' বিরোধী দল বানানো গেলে তাতে সরকারেরই লাভ।
তারপরও কিন্তু থেকে যায়। বিশেষ করে, ক্ষমতাসীনরা যদি ২০১৪ সালে জি এম কাদেরের ভূমিকার কথা স্মরণে রাখেন। সেদিক থেকে আবারও রওশন এরশাদ সরকারের ভরসার জায়গা হতে পারে। বলাবাহুল্য, সংসদে তিনি এখনও বিরোধীদলীয় নেতা। সে জন্য যতদিন রওশন এরশাদ বেঁচে আছেন, ততদিন তিনি দলে প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করবেন এবং নির্বাচন পর্যন্ত অন্তত এ ধরনের তৎপরতা আমরা দেখতে থাকব। বলার অপেক্ষা রাখে না, জাতীয় পার্টি অধিকাংশ সময়েই ক্ষমতার বলয়ের সুবিধাভোগী। সে সুবিধার জন্য দলটির নেতারা যে অনেক কিছুই করতে পারেন- ইতোমধ্যে তা প্রমাণিত।
নির্বাচনে জাতীয় পার্টি তাহলে কী করবে? নির্বাচন যত ঘনিয়ে আসবে, রাজনৈতিক সমীকরণ তত বাড়বে। সংসদে বিএনপির অবস্থান যা-ই হোক, তাদের জনসমর্থন আছে এবং দলটি আওয়ামী লীগের প্রধান প্রতিপক্ষ। দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে আসার ক্ষেত্রে এখনও বিএনপি তাদের অবস্থান সে অর্থে পাল্টায়নি। যদিও তারা ভেতরে ভেতরে প্রস্তুতি নিচ্ছে। এমনকি বর্তমান আন্দোলনের ক্ষেত্রে বিএপির পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, যাঁরা নির্বাচনে মনোনয়নের আশা করেন, তাঁদের মাঠে থাকতে হবে। জামায়াতও তাদের মতো প্রস্তুতি নিচ্ছে। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগও নির্বাচনের নানামুখী হিসাব-নিকাশ করছে। সে জন্যই নির্বাচনের দিক থেকে জাতীয় পার্টির ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। সেদিক থেকে জাতীয় পার্টিও রাজনৈতিক 'অনুশীলন' শুরু করে দিতে পারে বৈকি। কিন্তু দেবর-ভাবির পুরোনো বিরোধের সঙ্গে বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতাও বিবেচনা করে দেখতে হবে।