
সাফজয়ী নারী ফুটবল দলের কীর্তিগাথা উদযাপনের মাধ্যমে সবাই যখন নারীর বন্দনা করছেন; ঠিক সেই সময় ইডেন মহিলা কলেজে দেখা যাচ্ছে নারীর অবমাননা। এ সময় কলেজটিতে ছাত্রলীগ নেত্রী কর্তৃক ছাত্রীর শরীরে গরম চা ঢেলে দেওয়ার অঘটনের খবর যেমন সংবাদমাধ্যমে এসেছে; তেমনি ক্ষমতার দ্বন্দ্বে দলীয় কর্মীদের হাতে ছাত্রলীগ নেত্রীর প্রহূত হওয়ার খবরও আমরা দেখছি। সবচেয়ে বড় অঘটন ঘটে রোববার। অন্তদ্র্বন্দ্বের ঘটনা সেদিন রূপ নেয় সংঘাতে। দুই পক্ষের মধ্যে চেয়ার ছোড়াছুড়ি, ধাওয়াধাওয়ি ও চুলাচুলিতে আহত হন অন্তত ১০ জন।
ইডেন কলেজ ছাত্রলীগের দুটি পক্ষ স্পষ্ট। এক পক্ষে রয়েছেন সংগঠনটির কলেজ সভাপতি তামান্না জেসমিন রিভা ও সাধারণ সম্পাদক রাজিয়া সুলতানা। অপর পক্ষে আছেন কলেজটির সহসভাপতিসহ বেশ কয়েকজন, যাঁরা সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের বিরুদ্ধে সিট বাণিজ্য করার বিষয়ে সংবাদমাধ্যমে অভিযোগ করেন। এ অভিযোগের যে সত্যতা রয়েছে এবং সাধারণ ছাত্রীরাও যে এই সিট বাণিজ্যের বিপক্ষে- সেটি প্রমাণ হয় রোববার দুই নেত্রীকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করে ক্যাম্পাসছাড়া করার মাধ্যমে। কিন্তু সেখানে যখন সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদককে ক্যাম্পাসছাড়া করার আনন্দে মিছিল হচ্ছিল, তার পরই রোববার রাতে 'বিদ্রোহী' হিসেবে কলেজটির ১২ জন নেত্রী এবং চারজন কর্মীকে স্থায়ীভাবে বহিস্কার করে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ। সেখানে ছাত্রলীগের কমিটিও স্থগিত করা হয়। কিন্তু সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের বিরুদ্ধে তাদের কোনো বক্তব্য নেই কেন? অথচ সমকালসহ অন্যান্য সংবাদমাধ্যমে ইডেন কলেজ ছাত্রলীগ সভাপতি তামান্না জেসমিন রিভার নানা অপকর্ম প্রকাশিত হয়। ২৬ আগস্ট সমকালে রিভার বিভিন্ন বিতর্কিত কর্মকাণ্ড নিয়ে "ইডেনের 'ডন' রিভা" শীর্ষক প্রতিবেদনে তাঁর বিরুদ্ধে 'দুই ছাত্রীকে বিবস্ত্র করে ভিডিও ভাইরাল করার হুমকি', 'ছাত্রলীগের মিছিল-মিটিংয়ে শিক্ষার্থীদের জোর করে নিয়ে যাওয়া'সহ 'সিট বাণিজ্য, ক্যান্টিন থেকে চাঁদা দাবি' প্রভৃতি বিষয় উঠে আসে। ইডেন কলেজে ছাত্রলীগ নেত্রীদের সিট বাণিজ্য বহু পুরোনো বিষয়। সেখানে নিয়ম অনুযায়ী প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীরা ছাত্রীনিবাসে সিট না পেলেও নেত্রীদের এককালীন ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকা দিয়ে ছাত্রীনিবাসে উঠতে পারেন। সমকালের প্রতিবেদন অনুসারে, এ সিট বাণিজ্যে তামান্না জেসমিন রিভা সবাইকে ছাড়িয়ে গেলেও তাঁর কর্মকাণ্ড বিষয়ে ছাত্রলীগ কিংবা ইডেন কলেজ প্রশাসন; কেউই কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। কর্তৃপক্ষ উল্টো ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীদেরই হল থেকে বের করে দেয়।
বস্তুত ইডেন কলেজের ঐতিহ্য অনেকটা এ রকমই। সেখানে যে সরকার ক্ষমতায় থাকে; ক্ষমতাসীনদের ছাত্র সংগঠন সাধারণ ছাত্রীদের ওপর ছড়ি ঘুরায়। তাদের কারণে সাধারণ ছাত্রীদের তটস্থ থাকতে হয়। নব্বইয়ের দশকে বিএনপির সময়ে আমরা প্রভাবশালী নেত্রী হেলেন জেরিনের দাপট দেখেছি। এর পর থেকে যারাই ক্ষমতায় এসেছে, তাদের ছাত্র সংগঠনের নেত্রীরা কলেজে প্রভাব খাটিয়ে আসছেন। তাঁরা কোনো নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করে নিজেরাই যেন 'প্রশাসন'। এমনকি অনেকে দলীয় শৃঙ্খলারও বাইরে চলে যান। এর পরও তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয় না বলে তাঁরা আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠেন। আমরা দেখছি, অবশেষে ছাত্রলীগ ইডেন কলেজের কমিটি স্থগিত করতে বাধ্য হয়েছে। এ পর্যায়ে আসার আগেই সংগঠনটির তামান্না জেসমিন রিভার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত ছিল।
ছাত্রলীগ তাও সাংগঠনিক ব্যবস্থা নিয়েছে; কিন্তু কলেজ প্রশাসনের ভূমিকা কী? এ ঘটনাটি এত দূর গড়ানোর ক্ষেত্রে প্রশাসন দায় এড়াতে পারে না। ঘটনার সূত্র ২২ সেপ্টেম্বর। ওই দিন ইডেন কলেজ ছাত্রলীগ সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের বিরুদ্ধে সিট বাণিজ্য ও চাঁদাবাজির অভিযোগে সংবাদমাধ্যমে কলেজটির সহসভাপতি জান্নাতুল ফেরদৌস বক্তব্য দেওয়ায় তাঁকে হেনস্তা ও মারধর করা হয়। জান্নাতুল ফেরদৌস বিচার চেয়ে কলেজ প্রশাসনের কাছে লিখিত অভিযোগ জানানোর পরও কর্তৃপক্ষ কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। রোববার ক্যাম্পাসে এমন অস্থিরতার পরও তাদের বিন্দুমাত্র ভূমিকা চোখে পড়েনি। এমনকি সাংবাদিকরা এ বিষয়ে অধ্যক্ষের সঙ্গে কথা বলতে দফায় দফায় চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন। কলেজটির একজন একাডেমিক সদস্য বলেছেন, 'বাধ্যবাধকতার অধ্যক্ষ কথা বলতে পারবেন না।' কোন বাধ্যবাধকতার কথা তিনি বলেছেন, আমরা জানি না। দায়িত্বশীল হিসেবে ভূমিকা রাখার মতো মেরুদণ্ড তাঁদের নেই? অবশ্য, অনেক প্রতিষ্ঠানে যাঁরাই ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার চেষ্টা করেছেন; তাঁদের অপমানজনক পরিণতি আমরা দেখেছি।
তবে ইডেন কলেজের অঘটনের মাধ্যমে এটা স্পষ্ট- সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সিট বাণিজ্য আর সংঘাতের রাজনীতি চলতেই থাকবে। সিটের কারণে শিক্ষার্থীরাও ছাত্রনেতা-নেত্রীদের হাতে জিম্মি হয়ে থাকবেন। ইডেন কলেজের ক্ষেত্রে যেটা দেখা গেল; এখানে বাণিজ্য তো রয়েছেই; একই সঙ্গে ছাত্রীদের ইজ্জত রাখাও দায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। একজন নেত্রী নারী হয়েও যখন বিবস্ত্র করে ভিডিও ভাইরাল করার হুমকি দেন; সেখানে আমাদের আর বলার কিছু নেই। রাজনীতি, প্রশাসন ও সমাজের বিভিন্ন পর্যায়ে নারী এগিয়ে এলেও এখনও কাঙ্ক্ষিত পর্যায়ে আসেনি। এ ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতার ক্ষেত্রে পুরুষতন্ত্রকে দায়ী করা হয় বটে, কিন্তু নারীই কীভাবে নারীর প্রতিবন্ধক হয়ে উঠতে পারে- ইডেন কলেজেন অঘটন তার প্রমাণ। এ অবস্থা চলতে দেওয়া যায় না। শিক্ষাঙ্গনে ছাত্র রাজনীতির এ কদর্য রূপ থেকে বের হতে রাজনীতিকদেরই সিদ্ধান্ত নিতে হবে।