দেশের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে দুই বছরের প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা চালুর ব্যাপারে সরকারের নীতিগত সিদ্ধান্ত নিঃসন্দেহে ইতিবাচক। কিন্তু প্রশ্ন হলো- এ শিক্ষা এক বছরের বদলে দুই বছর করার ক্ষেত্রে আমাদের প্রস্তুতি কতটা। যেহেতু ৪-৫ বছর বয়সী শিশু প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণ করবে, সে জন্যই প্রস্তুতির বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ।
প্রাক-প্রাথমিক মানে প্রাথমিকের আগের স্তর। প্রাথমিকের আগে ইতোমধ্যে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে এক বছরের প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা রয়েছে এবং কিন্ডারগার্টেনে চালু রয়েছে দুই-তিন বছরের শিক্ষা কার্যক্রম। প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের করা ২০২১ সালের বার্ষিক প্রাথমিক বিদ্যালয় শুমারির তথ্য অনুযায়ী, দেশে সরকারি-বেসরকারি বিদ্যালয়, কিন্ডারগার্টেনসহ সব মিলিয়ে প্রাথমিক বিদ্যালয় আছে ১ লাখ ৩৩ হাজার। এর মধ্যে কিন্ডারগার্টেনেই প্রধানত শিশুদের ভর্তি করা হয়। সেখানে ঠিক প্রাক-প্রাথমিক নামে না থাকলেও প্লে, নার্সারি ও কেজি নামে তিন বছরের তিনটি শ্রেণি কার্যক্রম চালু রয়েছে। শিশুর ৩ বছর বয়স থেকেই অনেক অভিভাবক সন্তানদের প্লে-তে ভর্তি করে দেন। যে শিশু প্লে-তে ভর্তি হয়, অধিকাংশ ক্ষেত্রে তাকে এর পরের নার্সারি ও কেজি সম্পন্ন করতে হয়। এর পর আসে প্রথম শ্রেণি। প্রথম শ্রেণির আগের এ সময়গুলোতে শিশু কতটা শিশুবান্ধব পরিবেশ পায়, তা নিঃসন্দেহে বড় প্রশ্ন। কিন্ডারগার্টেন বা যেসব বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে প্রাথমিকের আগে একাধিক শ্রেণি রয়েছে, সেখানকার অধিকাংশ প্রতিষ্ঠান সে অর্থে শিশুবান্ধব নয়। শিশুদের বিকাশ, বয়স, চাহিদা অনুযায়ী সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সাজানো নয় বললেই চলে। এ অবস্থায় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়সহ সব প্রতিষ্ঠানে দুই বছরের প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা চালু করার ক্ষেত্রে প্রস্তুতি জরুরি।
বস্তুত জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০-এ দুই বছরের প্রাক-প্রাথমিকের ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছিল। ২০১০ সালে যখন শিক্ষানীতি প্রণীত হয়, তখন ৫ বছর বয়সী শিশুদের জন্য এক বছরের কথা বলা থাকলেও সেখানে উল্লেখ ছিল, পরবর্তীকালে ৪ বছর বয়সী শিশু পর্যন্ত সম্প্রসারিত করা হবে। সে হিসেবেই এখন দুই বছরের পরিকল্পনা হচ্ছে প্রাক-প্রাথমিকে। বলাবাহুল্য, এক বছরের প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা চালুর পর থেকে অনেকেই এর সফলতার কথা বলেছেন। বলা হচ্ছে, প্রাক-প্রাথমিকে যারা পড়াশোনা করে তারা প্রাথমিকে ভালো করে। প্রাথমিকে ঝরে পড়ার হার কমাতেও প্রাক-প্রাথমিকের ভূমিকা রয়েছে। তা ছাড়া, সরকারি বিদ্যালয়ে দুই বছরের প্রাক-প্রাথমিক চালু হলে অপরিকল্পিতভাবে গড়ে ওঠা কিন্ডারগার্টেনে শিশুদের দিতে অভিভাবকরা অনুৎসাহিত হবেন। এর সঙ্গে যখন যোগ করছি- শিশুর প্রথম পাঁচ বছরে মস্তিস্কের বিকাশ ঘটে বলে এ সময়ে শারীরিক, সামাজিক, আবেগীয় ও বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশের জন্য উপযুক্ত পরিবেশ প্রয়োজন; তখনই পরিকল্পিত প্রাক-প্রাথমিকের কথা আসে। যথাযথ প্রস্তুতি নিয়ে সেভাবে ২ বছরের প্রাক-প্রাথমিক চালু হলেই শিশুর বিকাশ নিশ্চিত হতে পারে।
বলাবাহুল্য, শিশুর ৬ বছরের আগের সময় আনুষ্ঠানিক শিক্ষার বয়স নয়। এ সময়ে শিশু সাধারণত প্রকৃতি ও পরিবেশ থেকে শেখে। এ সময়ে শিশুকে প্রতিদিনের শিক্ষার রুটিনে বেঁধে ফেললে তার বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়। তবে ৬ বছর থেকে শিশু যাতে আনুষ্ঠানিক শিক্ষা শুরু করতে পারে, তার প্রস্তুতি হিসেবে শ্রেণিকক্ষে যাওয়ার অভ্যাস করাতে প্রতিদিন বিদ্যালয়ে গেলেও তাকে তথাকথিত ক্লাসের ফ্রেমে আবদ্ধ করা চলবে না। প্রাক-প্রাথমিকে শ্রেণিকক্ষ এমনভাবে সাজানো উচিত, যাতে শিক্ষার্থী মনে করে, সে খেলতে এসেছে। অন্য শিশুর সঙ্গে মেশা, খেলাধুলা করা শিশুর সহজাত হিসেবে সে যাতে অন্যান্য বাচ্চার সঙ্গে খেলাধুলা করতে পারে, তা নিশ্চিত করতেই হবে। এ পর্যায়ে খেলাচ্ছলে শিক্ষার ব্যবস্থা থাকা চাই। তাদের জন্য আনন্দময় পরিবেশে শিক্ষার ব্যবস্থা নিশ্চিত করা প্রয়োজন।
এখন প্রশ্ন- বর্তমানে প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোর শ্রেণিকক্ষের অবকাঠামো এবং পরিবেশ কতটা শিশুবান্ধব। ইতোমধ্যে এক বছর মেয়াদি যে প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা রয়েছে, সেখানকার অবকাঠামো নিয়েও প্রশ্ন অনেক। বলাবাহুল্য, অবকাঠামো ক্ষেত্রে বাচ্চাদের জন্য টয়লেট ও পানির বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। ৪ বছর বয়সী শিশুর জন্য শ্রেণিকক্ষ লাগোয়া টয়লেট থাকা প্রয়োজন। অথচ সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদন অনুসারে, ২৬ শতাংশ প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ব্যবহারোপযোগী টয়লেট নেই; আর ১১ শতাংশ বিদ্যালয়ে নেই পানির ব্যবস্থা। এমনটা নিশ্চয় কাম্য নয়। অবকাঠামোগত অন্যান্য দিকও দেখা জরুরি। সম্প্রতি আমরা দেখেছি, খাগড়াছড়ির একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রাক-প্রাথমিকের এক শিক্ষার্থীর ওপর গেট ভেঙে পড়ায় শিশুটি মারা গেছে। অবকাঠামোগত এমন ফাঁদ যাতে না থাকে, সেদিকে মনোযোগী হতে হবে।
এটা ঠিক, সাম্প্রতিক সময়ে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অবকাঠামোগত উন্নতি হয়েছে এবং এতদিন এক বছরের যে প্রাক-প্রাথমিক চলছে, সে ক্লাসটিও অন্যান্য শ্রেণিকক্ষ থেকে 'আকর্ষণীয়'। সেখানে শিশুদের খেলার ব্যবস্থা রয়েছে। এটাও মনে রাখতে হবে, এখানে অবকাঠামোই শেষ কথা নয়। শিশুবান্ধব শিক্ষা কীভাবে হবে, সেটিই বড়। ইতোমধ্যে এক বছরের প্রাক-প্রাথমিক চালু থাকায় প্রাথমিক শিক্ষা প্রশাসনের তরফ থেকে সে ধরনের নির্দেশনাও দেওয়া আছে। কিন্তু বিদ্যালয় পর্যায়ে তা কতটা বাস্তবায়ন হচ্ছে, তার তদারকি প্রয়োজন।
প্রাক-প্রাথমিকের জন্য শিক্ষক প্রশিক্ষণও গুরুত্বপূর্ণ। শিশুদের প্রবণতা ও মানসিক অবস্থা অনুধাবনে সক্ষম এবং শিশুর উপযোগী করে উপস্থাপনায় পারঙ্গম শিক্ষকই প্রাক-প্রাথমিকের শিশুদের দেখাশোনা করবেন। তিনি ঠিক শিক্ষক হবেন না; 'ফ্যাসিলিটেটর'-এর ভূমিকা পালন করবেন। সে জন্য প্রাক-প্রাথমিক মাথায় রেখে বিশেষ শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া প্রয়োজন। তা ছাড়া বর্তমানে প্রাথমিকের যেসব শিক্ষক রয়েছেন, তাঁরা প্রাক-প্রাথমিকের দুটি শ্রেণি পরিচালনা করলেও আগেই তার প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ দিয়ে নিতে হবে।
দুই বছরের প্রাক-প্রাথমিক চালুর ক্ষেত্রে অবশ্যই সংশ্নিষ্ট বিশেষজ্ঞদের দিয়ে পুরো কার্যক্রমটি সাজাতে হবে। শিশুবান্ধব পরিবেশ নিশ্চিত না করে এবং যথাযথ প্রস্তুতি না নিয়ে ২ বছরের প্রাক-প্রাথমিক অর্থাৎ ৪ বছর বয়স থেকেই শিশুকে বিদ্যালয়ে আনার কর্মযজ্ঞ ব্যাপকভাবে চালু হলে শিশুর বিকাশে ব্যাঘাত ঘটবে এবং এ শিক্ষা চালুর উদ্দেশ্য ব্যাহত হবে।