প্রাক-প্রাথমিকের শিক্ষার্থী ছিল শ্রাবণ দেওয়ান। গত বুধবার খাগড়াছড়ি সদরের খবংপুড়িয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিশুছাত্রটি মায়ের হাত ধরে বিদ্যালয়ে যাচ্ছিল। ঢোকার সময় স্কুলের গেট ভেঙে পড়ে শ্রাবণের ওপর। ৫ বছরের শিশুটির ক্লাসে আর ঢোকা হয়নি। উদ্ধার করে হাসপাতালের নেওয়ার পর কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। ঘটনা এতটুকুই। কিন্তু এটি কতটা বেদনার তা শিশুটির পরিবারই বুঝতে পারবে। এ অঘটনের বার্তাও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
শিশুর জন্য নিরাপদ জায়গা তার নিজের ঘর এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। ঘরে শিশু পারিবারিক আবহে থাকে, অভিভাবকদের যত্নে থাকে আর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষকদের তত্ত্বাবধানে থাকে। সেখানে শিশু সহপাঠী বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে খেলাও করে। সেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান শিশুর ঘাতক হওয়া উদ্বেগজনক। শিশুদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান শিশুবান্ধব না হলে সেখানে শিশুর নিরাপত্তা কীভাবে নিশ্চিত হবে?
চার মাস ধরে খাগড়াছড়ির প্রাথমিক বিদ্যালয়টির গেটের ডান পাশের অংশটি ভাঙা ছিল। অভিভাবকরা গেটটি মেরামত করার জন্য অনুরোধ করার পরও কর্তৃপক্ষ গুরুত্ব দেয়নি। কেন বিদ্যালয়টির প্রধান শিক্ষক এর গুরুত্ব দেননি? সেখানে রুটিন পরিদর্শনে যখন শিক্ষা কর্মকর্তারা যান তখনও কি তাদের চোখে পড়েনি? আমরা জানি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এমন অনেক বিষয় থাকে তা হয়তো দীর্ঘদিন ব্যবহারও হয় না। সেখানে দ্রুত মেরামতের প্রয়োজন থাকে না। কিন্তু গেট তো এমন কিছু নয়। বিদ্যালয়ে ঢুকতে হলে গেট ব্যবহার করতেই হবে। শিশুরাও যেখানে এটি ব্যবহার করবে সেখানে কর্তৃপক্ষের টনক কেন নড়ল না? সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অবকাঠামোগত সংস্কার, টিউবওয়েল মেরামত, লাইট-ফ্যান ঠিক রাখা, চেয়ার-টেবিল মেরামতসহ এ ধরনের কাজে প্রতি বছর বরাদ্দ দেওয়া হয়। এর বাইরেও জরুরি হলে স্থানীয় শিক্ষা প্রশাসনের সঙ্গে আলোচনা করে মেরামত করার ব্যবস্থাও নিশ্চয়ই রয়েছে। অথচ শ্রাবণ দেওয়ানের ওপর যে গেটটি পড়ে তা দীর্ঘদিন ধরে ভাঙা ছিল। এমনকি সেখানকার শিক্ষার্থীরা আসা-যাওয়ার সময় গেট ধরে খেলত বলে স্থানীয়রা জানিয়েছেন। এরপরও কর্তৃপক্ষ গেটটি মেরামত না করে বাঁশের খুঁটি দিয়ে লাগিয়ে রেখেছিল।
বর্তমানে যখন গেট বা ফটক নির্মাণ ও উদ্বোধন এক ধরনের 'ফ্যাশনে' পরিণত হয়েছে তখনও খাগড়াছড়ির বিদ্যালয়টির ভাঙা গেট এতদিন পড়েছিল! সংবাদমাধ্যমে গেট বিষয়ে যত খবর প্রকাশ হয়, এর অধিকাংশই উদ্বোধন-সংক্রান্ত। দেশের নানা জায়গায় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের বিচিত্র গেট নির্মাণ হয় এবং তা বিশিষ্টজনের উপস্থিতিতে উদ্বোধনও হয়। গেট নির্মাণে দুর্নীতির খবরও কম নয়। ২০২০ সালে প্রকাশিত সমকালের এক খবরে প্রকাশ, বিমানবন্দরে একটি গেট নির্মাণে খরচ হয় ১ কোটি ৭০ লাখ টাকা। যে গেট ভেঙে শিশু শ্রাবণ দেওয়ানের প্রাণহানি হয়েছে তা নির্মাণে কত খরচ হয়েছিল আমরা জানি না। তবে এটা জানা কথা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ভবনসহ অন্যান্য অবকাঠামো নির্মাণে নানা ধরনের অনিয়মের বিস্তর অভিযোগ রয়েছে। এর মধ্যে বরাদ্দের পুরো অর্থ খরচ না করা কিংবা নিম্নমানের সামগ্রী দিয়ে ভবন নির্মাণ সাধারণ অভিযোগ। বিদ্যালয়টির গেট নির্মাণে এমনটি হয়েছে কিনা দেখা দরকার।
ইতোমধ্যে সংবাদমাধ্যমকে খাগড়াছড়ি সদর উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা তদন্তের কথা বলেছেন। যে কোনো দুর্ঘটনা ঘটলেই তিন বা পাঁচ সদস্যবিশিষ্ট 'তদন্ত' কমিটি গঠন করা হয়। পরে এ বিষয়ে আর কোনো খবর থাকে না। মনে রাখতে হবে, এটি যেন স্বাভাবিক দুর্ঘটনা নয়? সাধারণ একটি শিশুর মৃত্যু হয়েছে বলে একে খাটো করে দেখার কোনো সুযোগ নেই। কেন এমন অঘটন ঘটল সেজন্য বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এবং ঠিকাদারকে জবাবদিহি করতে হবে।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান যদি শিশুর নিরাপদ আশ্রয় না হয়; শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পাঠিয়ে অভিভাবকরা যদি স্বস্তিতে থাকতে না পারেন, তার চেয়ে দুঃখজনক আর কী হতে পারে। শ্রাবণ দেওয়ান আমাদের অপরাধী করে গেছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আর কোনো শিশুর জন্য যাতে এভাবে মৃত্যুর কারণ না হয়, সে শিক্ষা নিতেই হবে।