'পানির দর' বলতে যে কথা প্রচলিত; তার কার্যকারিতা রয়েছে কিনা, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠতেই পারে। সামান্য দাম কিংবা দাম নেই বললেই চলে- এমন অবস্থা বোঝাতে পানির দর বলা হয়। পানির দরে বিক্রির বিকল্প না হয় ভাষাবিজ্ঞানীরাই ভাবুন। কিন্তু পানি যে নিজেই মূল্যবান এবং দিনে দিনে আরও দামি হয়ে উঠছে, তা বলাই বাহুল্য। বোতলজাত পানি আধালিটার কিনতে গেলে গুনতে হবে ১৫ টাকা। অবশ্য গরমে যখন মানুষ অতিষ্ঠ, একটু ঠান্ডা পানি আপনাকে স্বস্তি দেবে, ঠিক ওই সময় বাস-লঞ্চ বা অন্যান্য যানবাহন কিংবা বিশেষ জায়গায় ২০ টাকার নিচে তা পাওয়া যায় না। দোকানে দোকানে আগে বিনামূল্যে যে পানি পাওয়া যেত, তার জায়গা দখল করেছে জারের পানি। জারের ১ গ্লাস পানি আগে ১ টাকায় পাওয়া গেলেও এখন তার দ্বিগুণ দাম। এদিকে রাজধানীতে নিত্যপ্রয়োজনে মানুষ ঢাকা ওয়াসার যে পানি ব্যবহার করছে, তার দামও ফি বছর বাড়ছে। সম্প্রতি নতুন করে পানির দাম বাড়ানোর প্রস্তাব করেছে ঢাকা ওয়াসা।
ঢাকা ওয়াসার এবারের প্রস্তাব অবশ্য অভিনব। নিম্নবিত্ত গ্রাহকদের পানির দাম কমিয়ে উচ্চবিত্তের গ্রাহকদের দাম বাড়ানোর কথা বলছে প্রতিষ্ঠানটি। প্রস্তাবটি শুনতে যতটা ভালো লাগছে, বাস্তবতা ততটা সহজ নয়। এটি বাস্তবায়িত হলে ৯৭ শতাংশ গ্রাহকেরই পানির দাম বাড়বে। ইউনিটপ্রতি তাদের সাড়ে ৩ থেকে ২২ টাকা পর্যন্ত বর্ধিত দাম গুনতে হবে। এর বিপরীতে প্রায় ৩ শতাংশ গ্রাহকের পানির দাম কমবে ইউনিটপ্রতি ২ টাকার কিছু বেশি। এর মাধ্যমে ওয়াসা নিজে লাভবান হলেও গ্রাহককে অস্বাভাবিক অতিরিক্ত দাম দিতে হবে। বিপরীতে পানির গুণগত মান কি বাড়বে? ওয়াসার পানির অবস্থা এতটাই শোচনীয় যে, তা খাবারের অযোগ্য এবং প্রায়ই অভিযোগ ওঠে- ডায়রিয়াসহ পানিবাহিত রোগের জন্য দায়ী এ পানি।
ওয়াসা পানি পেতে এখন শ্রেণিভিত্তিক বিভাজনের প্রস্তাব করছে। এ বিভাজন কার্যকর হলে হয়তো পানির ক্ষেত্রেও বিভাজন দেখা দেবে। নিম্নবিত্তের মানুষ ঠিকভাবে পানি না পেলে কিংবা গুণগত দিক থেকে খারাপ পানি পেলেও তারা কিছু বলতে পারবে না। সুতরাং এমন প্রস্তাব কতটা সুবিবেচনাপ্রসূত? ঢাকা ওয়াসার আইন অনুযায়ী প্রতি বছর ৫ শতাংশ পানির দাম বাড়াতে পারে। কিছুদিন আগেই ৫ শতাংশ পানির দাম বাড়ানো হয়েছে। এখন নতুন করে আবার দাম বাড়ানোর প্রস্তাব কেন?
ঢাকা ওয়াসার কর্মকর্তারা নিজেদের বেতন-ভাতা বাড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে পানির দাম বাড়াতেও মনোযোগী। সরকারের ভর্তুকিতে চললেও এবং বছর বছর পানির দাম বাড়লেও সেখানকার কর্মকর্তারা ঠিকই 'পারফরম্যান্স বোনাস' পান। পানির যে অপচয় হয় সেখানে কেন তাদের নজর নেই; কেন এ ক্ষেত্রে অনিয়ম-দুর্নীতি বন্ধ হবে না? অপচয়, অনিয়ম-দুর্নীতি বন্ধে মনোযোগ না দিয়ে যখন পানির দাম বাড়াতেই ওয়াসা ব্যস্ত; তখনও তাদের 'পারফরম্যান্স' ভালো বটে! ভর্তুকি কমাতে হলে ওয়াসাকে এদিকেই নজর দিতে হবে। ফাঁকফোকর বন্ধ না করে শুধু গ্রাহকের ঘাড়ে ওয়াসার ঋণের বোঝা চাপানো তো সমাধান হতে পারে না।
নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম যখন ঊর্ধ্বমুখী; যখন গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বাড়ছে এবং পানির দামও ইতোমধ্যে বেড়েছে তখন ওয়াসার নতুন করে পানির দাম বাড়ানোর প্রস্তাব অভিনব হলেও গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। পানি মানুষের নাগালের বাইরে চলে গেলে, নাগালের মধ্যে আর কী থাকবে? তা ছাড়া রাজধানীর ৯৭ শতাংশ মানুষই তো ধনী নয়। এমনিতেই মধ্যবিত্ত কিংবা নিম্ন-মধ্যবিত্ত রয়েছে সংকটে। তার ওপর ওয়াসার উদ্ভট প্রস্তাব পাস হয়ে গেলে মানুষের ওপর চাপ আরও বাড়বে বৈকি। আমরা সংবাদমাধ্যমে দেখেছি, সম্প্রতি খুলনায় ওয়াসার পানির দাম বাড়ার কারণে সেখানে আন্দোলনে নেমেছে মানুষ।
অস্বীকার করার উপায় নেই, নিরাপদ পানি নিশ্চিত করা এখন বিশ্বের জন্য চ্যালেঞ্জ। এমনকি বলা হয়, পানি নিয়েই হবে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ। সেই পানির সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা এবং মানুষের পানির অধিকার নিশ্চিতে সরকারকে নজর দিতেই হবে। ঢাকা ওয়াসার দ্বারা সেটি সম্ভব না হলে খোদ ওয়াসার সংস্কারেই আগে মনোযোগ দিতে হবে। পানির দরের জন্য কেবল গ্রাহকই বলির পাঁঠা হবে কেন?