Mahfuzur Rahman Manik
শ্রীলঙ্কা : রনিল বিক্ষোভের আগুন থামাতে পারবেন?
জুলাই 22, 2022

মূল : কৃষাণ ফ্রান্সিস
অনুবাদ: মাহফুজুর রহমান মানিক

জনগণের কাছে অজনপ্রিয় শ্রীলঙ্কার প্রধানমন্ত্রী রনিল বিক্রমাসিংহেই দেশটির প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন। বুধবার পার্লামেন্টের গোপন ব্যালটে যেভাবে তিনি প্রেসিডেন্ট হন, তাতে সেখানে পুনরায় মানুষ বিক্ষোভ করতে পারে। দক্ষিণ এশিয়ার এ দেশটির অর্থনীতি ভেঙে পড়ায় যেভাবে মানুষ আন্দোলনে নামে, এমন বিক্ষোভ আবারও দেখা দিতে পারে।
আমরা দেখেছি, শ্রীলঙ্কানরা কয়েক মাস ধরে আন্দোলনে রাস্তায় রয়েছেন, অর্থনৈতিক সংকটের জন্য তাঁরা সেখানকার প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগ দাবি করেন। শ্রীলঙ্কার অর্থনৈতিক সংকটে সেখানকার ২ কোটি ২০ লাখ মানুষ নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের সংকটে পড়ে। ওষুধ, জ্বালানি থেকে শুরু করে খাদ্য সংকটও সেখানে ব্যাপক আকার ধারণ করে। গত সপ্তাহে তাঁরা আন্দোলন করে প্রেসিডেন্ট ভবনসহ কয়েকটি সরকারি ভবন দখল করেন। সর্বশেষ প্রেসিডেন্ট গোটাবায়া রাজাপাকসে শ্রীলঙ্কা থেকে পলায়ন করেন এবং পরে পদত্যাগ করতে বাধ্য হন।
আন্দোলনকারীদের অনেকেই রাজাপাকসে ও তাঁর পরিবারের বংশপরম্পরায় রাষ্ট্রক্ষমতা ভোগের বিষয়টি মেনে নিতে পারছেন না। তাঁদের পরিবার গত দুই দশকের মধ্যে অধিকাংশ সময়ই ক্ষমতায় ছিল। অনেকেই আবার রনিল বিক্রমাসিংহেকেও দোষ দিচ্ছেন। কারণ, ছয়বারের এ প্রধানমন্ত্রীও রাজাপাকসে পরিবারের শাসনের অংশীদার ছিলেন এবং তাঁদের রক্ষায়ও তিনি ভূমিকা রেখেছেন। রনিল বিক্রমাসিংহে রাজাপাকসের অর্থমন্ত্রী ছিলেন এবং গোটাবায়া রাজাপাকসে দেশ ছাড়ার পর তিনিই ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট হন। গত সপ্তাহে জনগণের আন্দোলনে বিক্ষোভকারীরা বিক্রমাসিংহের ব্যক্তিগত বাসভবন পুড়িয়ে দেন এবং তাঁর অফিসের দখল নেন।
বুধবারের ভোটে বিক্রমাসিংহের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার অর্থ, তিনি ২০২৪ সালে শেষ হতে যাওয়া প্রেসিডেন্টের মেয়াদ পূর্ণ করবেন। তাঁর এখন জরুরি কাজ হলো, একজন নতুন বিচক্ষণ প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ করা। ৭৩ বছর বয়সী বিক্রমাসিংহে প্রেসিডেন্ট হিসেবে জয় পাওয়ার পর সহকর্মী আইনপ্রণেতাদের উদ্দেশে বলেন, 'আজ আপনাদের দেশের পরিস্থিতি বর্ণনা করার প্রয়োজন নেই। মানুষ আমাদের থেকে আর পুরোনো রাজনীতি প্রত্যাশা করছে না। তারা প্রত্যাশা করে, আমরা একসঙ্গে কাজ করব।' তিনি দেশকে এগিয়ে নিতে আবেদন জানিয়ে বলেন, 'এখন নির্বাচন শেষ, আর আমাদেরও এই বিভাজন ঘোচাতে হবে।'
কিন্তু প্রতিবাদকারীদের সেদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই। তাঁরা বরং দলবেঁধে প্রেসিডেন্টের বাসভবনের দিকে গিয়ে স্লোগান দিচ্ছেন, 'রনিল, গো হোম', অর্থাৎ রনিল, বাড়ি যাও। বিক্ষোভকারীদের একজন বিসাকা জয়াওয়ারে, যিনি একজন শিল্পীও বটে, তিনি বলেছেন, 'আমরা খুবই দুঃখিত, খুবই হতাশ এ জন্য যে পার্লামেন্টের ২২৫ জন সদস্য যাঁরা আমাদের অধিকার আদায়ের কথা বলার জন্য নির্বাচিত হয়েছেন, অথচ তাঁরা তা করেননি। আমরা শ্রীলঙ্কার মানুষের জন্য যুদ্ধ চালিয়েই যাব। একটি জাতীয় নির্বাচন দেওয়ার দাবি আমাদের জানাতেই হবে।'
বলার অপেক্ষা রাখে না, কূটনীতিক হিসেবে এবং আন্তর্জাতিক বিষয়াদিতে রনিল বিক্রমাসিংহের অভিজ্ঞতার ভান্ডার বেশ সমৃদ্ধ। তিনি বুধবার বলেছেন, পার্লামেন্টে তাঁর জীবনের ৪৫ বছর কাটিয়েছেন। তিনি আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল আইএমএফের সঙ্গে দেউলিয়া রাষ্ট্র হিসেবে অর্থনৈতিক সহায়তা প্যাকেজ নিয়ে কথা বলার জন্য প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দিয়েছেন।
কিন্তু অনেক ভোটারই তাঁকে দেখছেন সন্দেহের দৃষ্টিতে। কারণ, তিনি গত মে মাসে গোটাবায়া রাজাপাকসে কর্তৃক এ আশায় নিযুক্ত হয়েছিলেন, তিনি হয়তো স্থিতিশীলতা আনতে সক্ষম হবেন। বিক্ষোভকারীরা অভিযোগ করেছেন, রাজাপাকসে ও তাঁর শক্তিশালী পরিবার সরকারি কোষাগার থেকে অর্থ অনৈতিকভাবে সরিয়েছে, যে কারণে দেশটির সংকট ত্বরান্বিত হয়েছে এবং অর্থনীতি ধ্বংস হয়েছে। যদিও তাঁর পরিবার দুর্নীতির অভিযোগ অস্বীকার করেছে। তবে সাবেক প্রেসিডেন্ট এটা স্বীকার করেছেন, তাঁর কিছু নীতি শ্রীলঙ্কার সমস্যা বাড়াতে সহায়তা করেছে।
বিক্ষোভকারীদের একজন মানবসম্পদকর্মী নেমেল জায়াবিরা বলেছেন, 'আমাদের দাবি মানা পর্যন্ত আমরা আন্দোলন চালিয়ে যাব। বিক্রমাসিংহের দেশ শাসনের পক্ষে কোনো জনরায় নেই। আমরা তাঁর বিরোধিতা করব।'
পার্লামেন্টে এখনও ক্ষমতাসীন দলের সংখ্যাগরিষ্ঠতার কারণে বুধবারের ভোটে রনিল বিক্রমাসিংহে প্রেসিডেন্ট হিসেবে জয়লাভ করেছেন। তিনি ১৩৪ ভোট পেয়েছেন। যেখানে জনতুষ্টিবাদী ডুলাস আলাহাপেরুমা পেয়েছেন ৮২ ভোট, যিনি রাজাপাকসের দীর্ঘদিনের মিত্র এবং তাঁর সরকারের মন্ত্রী হিসেবেও কাজ করেছেন। অন্যদিকে একজন মার্ক্সসিস্ট পেয়েছেন তিন ভোট। জাতীয় টেলিভিশনে দেখানো ভোটের চিত্র ছিল সুন্দর এবং শান্ত। গোপনে প্রদান করা ভোটের ফল ঘোষণা করা হয়। আইনপ্রণেতারা পার্লামেন্টে টেবিল চাপড়িয়ে তাঁদের প্রার্থীর পক্ষে সমর্থন ব্যক্ত করেন। ভোটের পর কিছু সমর্থক সড়কে রনিল বিক্রমাসিংহের বিজয় উদযাপন করেছেন। আজ বৃহস্পতিবার তিনি শপথ নিচ্ছেন।
অল্প কিছু আইনপ্রণেতা জনসমক্ষে বলেছেন, তাঁরা বিক্রমাসিংহের পক্ষে ভোট দেবেন। তাঁকে ভোট দেওয়া অনেকেই প্রত্যাশা করছেন, তিনি রাজাপাকসেকে পুনরায় ফিরিয়ে আনবেন। তা ছাড়া তিনি তাঁদের নিশ্চয়তা দিয়েছেন, যাঁরা বিশৃঙ্খলার সুযোগে রাজনীতিকদের বাড়িঘর পুড়িয়েছেন, সেসব বিক্ষোভকারীকে তিনি দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদান করবেন।
গত সোমবার ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট হিসেবে বিক্রমাসিংহে জরুরি অবস্থা জারি করেন, যার মাধ্যমে তাঁকে জনস্বার্থে নিরাপত্তা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় বিস্তৃত ক্ষমতা প্রদান করা হয়। কর্তৃপক্ষ যে কাউকে তল্লাশি করতে পারবে এবং তাঁদের জেল দিতে পারবে। বিক্রমাসিংহে যে কোনো আইন পরিবর্তন কিংবা স্থগিত করতে পারবেন।
শ্রীলঙ্কায় রাজনৈতিক হাঙ্গামাই সেখানকার অর্থনৈতিক সংকট আরও গভীরতর করেছে। কিন্তু সোমবার বিক্রমাসিংহে বলেছেন, আইএমএফের সঙ্গে আলোচনা একটি উপসংহারে পৌঁছাতে যাচ্ছে। এমনকি অন্য দেশের সঙ্গে সাহায্যের আলোচনাও ইতিবাচক দিকে এগোচ্ছে। তিনি এও বলেছেন, জ্বালানি ও রান্নার গ্যাস সংকট কাটাতে সরকার প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে।
বুধবারের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ভোটের কয়েক ঘণ্টা আগে আইএমএফের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ক্রিস্টালিনা জর্জিভা অর্থনৈতিক ম্যাগাজিন নিকি এশিয়াকে বলেছেন, সংস্থাটি প্রত্যাশা করে, শ্রীলঙ্কা সম্পূর্ণ উত্তরণের আলোচনা যত দ্রুত সম্ভব শেষ হবে।
প্রধানমন্ত্রী হিসেবে বিক্রমাসিংহে পার্লামেন্টে দেওয়া সাপ্তাহিক বক্তৃতায় সবাইকে সতর্ক করে দিয়ে বলেন, সংকট উত্তরণের পথ কঠিন হবে। তিনি সেখানে প্রেসিডেন্টের হাতে অধিক ক্ষমতার পুঞ্জীভবনের বিষয়টি পুনর্বিবেচনার কথাও তিনি বলেছেন। শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট সাধারণভাবে জনগণের দ্বারা নির্বাচিত হয়। তবে প্রেসিডেন্টের মেয়াদ আনুষ্ঠানিকভাবে শেষ হওয়ার আগে তিনি বিদায় নিলে নতুন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের দায়িত্ব বর্তায় কেবল পার্লামেন্টের ওপর। এমন ঘটনা শ্রীলঙ্কায় এর আগে একবারই ঘটেছে, তখনকার প্রধানমন্ত্রী দিঙ্গিরি বান্দা উইজেতুঙ্গাকে অপ্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে নির্বাচিত করা হয়। এটা ১৯৯৩ সালে ঘটে, যখন সাবেক প্রেসিডেন্ট রানাসিংহে প্রেমাদাসাকে হত্যা করা হয়। রানাসিংহে প্রেমাদাসা বর্তমান বিরোধীদলীয় নেতার বাবা।
কৃষাণ ফ্রান্সিস :অ্যাসোসিয়েটেড প্রেসের সাংবাদিক; এবিসি নিউজ থেকে ভাষান্তর

সমকালে প্রকাশিত ২১ জুলাই ২০২২

ট্যাগঃ , ,

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।