Mahfuzur Rahman Manik
সীতাকুণ্ড ট্র্যাজেডি এবং আমাদের দায়িত্বহীনতা
Sitakunda-tragedy-fire-claims death

রোববার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বিশেষ করে ফেসবুকের দেয়ালজুড়ে শুধু লাশ দেখছি। অনলাইনে সংবাদমাধ্যমগুলোর খবরের উল্লেখযোগ্য অংশ জুড়ে রয়েছে সীতাকুণ্ডের বিভীষিকা। শনিবার রাত ৯টার দিকে সীতাকুণ্ডে বিএম কনটেইনার ডিপোতে যে আগুন লাগে ২১ ঘণ্টা পরও সেখানে তা পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে না আসার খবর যখন সমকাল অনলাইনে দেখছি, একই সঙ্গে এও দেখেছি, নিহতের সংখ্যাটি বাড়ছে পাল্লা দিয়ে। রোববারের মুদ্রিত সমকালে চারজনের মৃত্যুর খবর ছাপা হয়। ২১ ঘণ্টা পর সংখ্যাটি দাঁড়িয়েছে ৪৯-এ। সোমবারের পত্রিকায় কত দাঁড়াবে আমরা জানি না। এখন সব ছাপিয়ে এই সংখ্যাটিই প্রধান হয়ে উঠবে।

এর মধ্যে অন্তত ৯ জন ফায়ার সার্ভিস কর্মীর মৃত্যুও নিশ্চিত করেছে প্রশাসন। উদ্ধার করতে এসেছে নিজেরাই এমন পরিণতির শিকার হয়েছেন। ফায়ার সার্ভিস কর্তৃপক্ষের মতো, সাম্প্রতিক সময়ের দুর্ঘটনায় একসঙ্গে তাঁদের এত কর্মী হতাহত হয়নি। মৃত্যুর সংখ্যা বৃদ্ধির কারণ নিয়ে কথা উঠছে। ডিপোতে 'হাইড্রোজেন পারঅপাইড' নামের বিপুল পরিমাণ দাহ্য রাসায়নিক মজুত থাকায় আগুন আরও বেপরোয়া হয়েছে এবং মৃত্যুর সংখ্যাটি বাড়ার অন্যতম কারণও সেটি। এর আগে আমরা পুরান ঢাকার চুড়িহাট্টা কিংবা নিমতলী ট্র্যাজেডিও দেখেছি। ওইসব ঘটনায়ও দাহ্য পদার্থে অগ্নিকাণ্ড ছড়িয়েছে। যে কারণে হতাহতও বেড়েছে। যখনই অগ্নিকাণ্ড ঘটে, তখনই কেবল ওই রাসায়নিক পদার্থের বিষয় আলোচনায় আসে। ঘটনার পর আমি তা ভুলে যাই। কিন্তু নতুন ট্র্যাজেডি আবার জানান দেয় এবং আমাদের অবহেলার বিষয়টি প্রমাণ করিয়ে দেয়।

একেকটা ট্র্যাজেডি নানা মানবিক ঘটনারও জন্ম দেয়। মানুষের প্রতি মানুষের ভালোবাসার প্রকাশ আমরা দেখি। রানা প্লাজার ট্র্যাজেডিতে যেমন আমরা দেখেছি অগণিত মানুষ আটকে পড়াদের উদ্ধারে এগিয়ে এসেছিলেন। সীতাকুণ্ডের ঘটনায়ও আমর দেখছি, শত শত মানুষ তরুণ-তরুণী সেবা দিয়ে যাচ্ছেন। রক্ত, ওষুধ সংগ্রহে এগিয়ে এসেছেন। অগ্নিদগ্ধ মানুষের সেবায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ছুটে এসেছে।

ডিপোতে কর্মরত তরুণ শ্রমিক অলিউর রহমান নয়ন ঘটনাস্থল থেকে একটু দূরে থেকে নিজের ফেসবুক আইডি থেকে লাইভ করছিলেন। কিন্তু হঠাৎ সেখানে ভয়াবহ বিস্ম্ফোরণে সবকিছু অন্ধকার হয়ে যায়। নয়নও চলে যায় না ফেরার দেশে। সীতাকুণ্ড ট্র্যাজেডিতে নিহত অধিকাংশই তাঁর মতো শ্রমিক। দেশের বিভিন্ন স্থানে তাঁদের বাড়ি। ২০২০ সালে চট্টগ্রামেই পতেঙ্গা এলাকায় একটি ডিপোতে তেলের ট্যাঙ্ক বিস্ম্ফোরণ হয়; ওই ঘটনায় তখন তিন শ্রমিকের মৃত্যু হয়। ২০১৩ সালের রানা প্লাজা, তাজরীন ফ্যাশন প্রতিটি ট্র্যাজেডিতে শ্রমিকরা প্রাণ হারিয়েছেন। নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে হাসেম ফুড বেভারেজের সেজান জুস কারখানার আগুনের ঘটনা ঘটেছে এক বছরও হয়নি। গত বছরের ৮ জুলাই ওই কারখানার অগ্নিকাণ্ডে ৫২ শ্রমিক প্রাণ হারিয়েছিলেন। প্রতিটি ঘটনায়ই আমরা দেখেছি, ক্ষতিপূরণ হিসেবে অল্প কিছু অর্থ ঘোষণা করা হয়। সীতাকুণ্ডের ঘটনায়ও আগুনে নিহতদের পরিবারকে ২ লাখ টাকা করে দেওয়া হবে বলে জানানো হয়েছে। কোনো প্রাণই ক্ষতিপূরণযোগ্য নয়। কিন্তু তাই বলে ১ লাখ বা ২ লাখ টাকা কেন?

ঢাকায় বসেও চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের উত্তাপ অনুভব করা কঠিন নয়। বিস্ম্ফোরণের শব্দও কানে শুনছি প্রযুক্তির কল্যাণে। সেখানকার মানুষের আহাজারিও আমরা দেখছি। অনেক স্বজন এখনও তাদের কাঙ্ক্ষিত মানুষকে খুঁজছেন। ছবি হাতে প্রিয়জনকে খুঁজছেন। জীবিত কিংবা নিহত যা-ই হোক, খুঁজে বের করে দেওয়ার আকুতি। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে একদিকে আগুনে ঝলসে যাওয়াদের ছটফটানি অন্যদিকে মর্গে শোকাহত স্বজন। হাসপাতালে সারি সারি মৃতদেহ সাদা কফিনে ঢাকা। আরেকটি ওয়ার্ডে নতুন অস্থায়ী বার্ন ইউনিটে বেঁচে যাওয়া শ্রমিক; অগ্নিকাণ্ডে এঁদের কারও পা, কারও হাত, কারও মুখ, কারও শরীরের বেশিরভাগ অংশই পুড়ে গেছে। কাজ শেষ করে প্রতিদিনের মতো তাঁদের কেউ বাড়িতে কিংবা বাসায় স্ত্রী-সন্তানদের কাছে ফেরার কথা ছিল; কিন্তু হায় নিয়তি! কেউ হয়েছেন লাশ, কেউ হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন। তাঁরা এখন সংবাদের উপজীব্য। সীতাকুণ্ড ট্র্যাজেডির চিত্রনাট্য কবে লেখা হয়েছিল? আমরা জানি না। তবে সর্বত্র আমরা যে দায়িত্বহীনতা দেখছি, এটা তার ব্যতিক্রম নয়।

সমকাল অনলাইনে প্রকাশিত ৫ জুন ২০২২

বিস্তারিত
ট্যাগঃ , , ,

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।