মূল লেখক: মারওয়ান বিশারা
ভাষান্তর: মাহফুজুর রহমান মানিক
শিরিনকে অতীতের ঘটনা হিসেবে উল্লেখ করে লেখার জন্য আমি প্রস্তুত নই। আজকে তো নয়ই, সম্ভবত কখনোই লিখতে পারব না। আলজাজিরার সংবাদিক শিরিন কয়েক দশক ধরে ইসরায়েলি আগ্রাসনের নির্মমতার খবর সংগ্রহের দায়িত্বে ছিলেন। যে উন্মত্ততা তুলে ধরার কাজে তিনি সারাজীবন কাটিয়ে দেন, অবশেষে তিনি নিজেই রক্তাক্ত এই উন্মত্ততার শিকার হন। আরব বিশ্বে আবু আকলেহ একটি পারিবারিক নাম। শিরিন হয়তো শারীরিকভাবে অনেক দূরে; কিন্তু তার উপস্থিতি রয়েছে মরক্কোর রাবাত থেকে সৌদি আরবের রিয়াদ পর্যন্ত অগণিত গৃহে।
শিরিন ছিলেন এক অভিজ্ঞ সাংবাদিক। ফিলিস্তিন থেকে ধ্বনিত তার সাহসী কণ্ঠ সারাবিশ্বে প্রতিধ্বনিত হতো। মৌসুমি প্রতিবেদকরা সেখানে স্বল্প সময়ের জন্য ছিলেন; আবার চলে গেছেন। কিন্তু শিরিন সেখানে দিনের পর দিন, বছরের পর বছর ছিলেন। তিনি তার মাতৃভূমি দখলদারদের মুখোমুখি হয়েছেন এবং কণ্ঠহীন ফিলিস্তিনির কণ্ঠস্বর হিসেবে কাজ করে গেছেন। শিরিনের কণ্ঠে দৃঢ়তা ছিল। প্রশান্তিদায়ক ও এক বিশ্বস্ত কণ্ঠ ছিল তার। তিনি সব সময়ই শান্ত ছিলেন। এমনকি শিরিন যখন রক্তাক্ত দৃশ্যাবলি ধারণ করতেন; যখন ভয়ংকর অবস্থার খবর সংগ্রহ করতেন এবং ভয়ানক পরিস্থিতির সম্মুখীন হতেন, তখনও তিনি শান্ত ও স্থির ছিলেন। কীভাবে তিনি নিজেকে ধরে রাখতেন, তা কল্পনা করাও কঠিন। কিন্তু হায় তার পরিণতি!
ফিলিস্তিনের রাস্তায় তিনি যেভাবে ঘুরেছেন; যেভাবে অলিগলি চষে বেড়িয়েছেন, সেখানকার শরণার্থী শিবির কাভার করেছেন; যে ঈর্ষণীয় বাগ্মিতা প্রদর্শন করে স্পষ্টভাবে আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে তিনি তার কথা বিশ্ববাসীকে জানিয়েছেন, তা কেবল বিনয়ই নয়, বরং তা জাদুকরি ক্ষমতারও বহিঃপ্রকাশ। সাংবাদিকতার দৃষ্টিতেও তার সংগ্রহ করা সংবাদ ছিল সব সময় বাস্তব, অর্থপূর্ণ এবং যথাযথ। সর্বাবস্থায় তিনি তার নার্ভ ধরে রেখেছেন। সেটি নিঃসন্দেহে চমকপ্রদ।
যুদ্ধকবলিত এলাকায় অবস্থায় এবং হতাহতের সংবাদ সংগ্রহে নিয়োজিত থাকা একজন সাংবাদিক হওয়া সত্ত্বেও শিরিনের মধ্যে আমরা তার প্রভাব দেখিনি। তিনি অমানবিক জায়গায় থাকা সত্ত্বেও ছিলেন অবিশ্বাস্য মানবিক। তিনি ছিলেন নিবেদিতপ্রাণ এক সাংবাদিক। তার মাতৃভূমি যে সংকট অতিক্রম করছে, সেখানে কাজের প্রতি তার অনুরাগে ভালোবাসা ও বেদনা উভয়েরই প্রকাশ ঘটেছে।
বলা প্রয়োজন, শিরিন জন্মেছিলেন ফিলিস্তিনের একেবারে কেন্দ্র জেরুজালেমে। ইসরায়েল যুদ্ধ ও ইসরায়েলি দখলদারিত্বের বছর ১৯৬৭ সালের পর তার জন্ম। ক্যাথলিক খ্রিষ্টান পরিবার থেকে আসা শিরিন সাংবাদিকতায় পড়াশোনা করেছেন। প্রথমে তিনি কাজ করেছেন ফিলিস্তিনের শরণার্থীদের জন্য জাতিসংঘের ত্রাণবিষয়ক সংস্থা ইউএনআরডব্লিউএতে। পরে সংলাপ ও গণতন্ত্রের প্রসারে তিনি কাজ করেন ফিলিস্তিনি উদ্যোগ মিফতাহের সঙ্গে। এর পরই পূর্ণোদ্যমে সাংবাদিকতায় নিয়োজিত হন। ১৯৯৭ সাল থেকে শিরিন আলজাজিরার সঙ্গে কাজ করেন। একজন অন্তপ্রাণ প্রতিবেদক হিসেবে তিনি কাজ শুরু করেন। শত বছরের এক-চতুর্থাংশ তথা ২৫ বছরে তিনি অন্ধকার সময়ে আলো জ্বালিয়েছেন। তিনি তার সময়ের সঙ্গে এগিয়ে গেছেন। কখনোই কাজে পিছপা হননি। আরব মিডিয়া ও অন্যান্য সাংবাদিকের তুলনায় তিনি আলজাজিরায় বিশেষ অবদান রেখেছেন; আরব বিশ্বের একেবারে কেন্দ্র থেকে সংবাদ সংগ্রহ করে তা প্রচারে সাহায্য করেছেন।
শিরিন যুদ্ধ প্রতিবেদক হলেও বছরের পর বছর ধরে তিনি অনুসন্ধানী সাংবাদিক হিসেবেও কাজ করেছেন। তিনি অপরাধের দৃশ্যাবলি ধারণ, প্রয়োজনীয় প্রমাণ ও ক্লু সংগ্রহ এবং অপরাধীদের মুখোশ উন্মোচনে কাজ করে গেছেন। এখন তার সেসব পুরোনো খবর পুনরায় দেখতে গিয়ে পরাবাস্তব মনে হয়। যদিও পেশাদারিত্বের দিক থেকে তিনি উচ্চস্তরে পৌঁছেছেন। তিনি এমন এক পেশায় ছিলেন, যা তার কারণে তিনি অর্ধশতাব্দীর কিছু বেশি সময় মাত্র বাঁচলেন। তিনি বেঁচে আছেন আমাদের হৃদয়ে। আমরা শিরিনের স্মৃতি তার মৃত্যু সম্পর্কে গতানুগতিক ও ষড়যন্ত্র তত্ত্বের সঙ্গে মিলিয়ে না ফেলি। কে বা কোন সৈন্যের গুলিতে তার প্রাণ গেছে- তা বড় কথা নয়। বড় বিষয় হলো শিরিন ইসরায়েলি আগ্রাসনের শিকার। সকালে তাকে হত্যা করাই যথেষ্ট ছিল না; ইসরায়েলি নিরাপত্তা বাহিনী বিকেলে তার বাড়ি তল্লাশি করে। এর মাধ্যমেই স্পষ্ট- হত্যাকারীদের পরিচয় কী। আমরা যারা তার ভক্ত, বন্ধু ও পরিবারের সদস্য রয়েছি; আমাদের জন্য তিনি নীরবে-নিভৃতে ভালোবেসে যে কাজ করে গেছেন; তার জন্য আমরা যেন তাকে সম্মান করি।
শিরিন আরবি শব্দ, যার অর্থ সতেজ, সুন্দর। এমনটাই ছিলেন তিনি। আজ আমরা শিরিনের জন্য শোক করছি আর আগামী দিনে তার হত্যাকারীদের জন্য রইল আমাদের ঘৃণা।
মারওয়ান বিশারা: আলজাজিরার জ্যেষ্ঠ রাজনৈতিক বিশ্নেষক; আলজাজিরার ওয়েবসাইট থেকে ভাষান্তর