Mahfuzur Rahman Manik
শিক্ষার্থীদের বারোটা বাজানোর কত দেরি
ডিসেম্বরে (২০২০) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে হল খোলার আন্দোলন করে শিক্ষার্থীরা

করোনা দুর্যোগের প্রভাব সব খাত কাটিয়ে উঠতে পারলেও শিক্ষা খাত পিছিয়ে থাকার পেছনে প্রশাসনের দায় কম নয়। গত বছরের মার্চ থেকে বিশ্ববিদ্যালয়সহ সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকলেও কিছু স্তরে সম্ভাব্য পদ্ধতি গ্রহণ করা হয়েছে। যেমন উচ্চ মাধ্যমিক ও সমমানের ফল নির্ধারণ করে শিক্ষার্থীরা উত্তীর্ণ হয়েছে। মাধ্যমিক পর্যায়ে অটোপাসের মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা পরবর্তী শ্রেণিতেও উঠেছে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ও অনলাইনে শ্রেণি কার্যক্রম ও পরীক্ষা সম্পন্ন করছে। সে বিবেচনায় দেখা যাচ্ছে, শুধু পিছিয়ে আছে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় বা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়েও অনলাইনে শ্রেণি কার্যক্রম সম্পন্ন হয়েছে সত্য। কিন্তু অনলাইনে পরীক্ষা না হওয়ায় সেশনজটে পড়েছেন শিক্ষার্থীরা। খুবই আশ্চর্যের বিষয়, অনলাইনে ক্লাস হলে পরীক্ষা কেন হতে পারবে না? এখন ১৪ মাস পর এসে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় অনলাইনে পরীক্ষার সিদ্ধান্ত নিয়েছে!

পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের করোনার প্রভাব মোকাবিলায় প্রস্তুতি ছিল না বললেই চলে। বিশ্বের অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয় এমনকি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকেও তারা শিক্ষা নেয়নি। অজুহাত হিসেবে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের আর্থিক সামর্থ্যের বিষয়টি সামনে আনা হয়েছে। যদি অনলাইনে শ্রেণি কার্যক্রম সম্পন্ন করা যায়, তবে পরীক্ষা কেন হতে পারবে না!

প্রশ্ন শুধু অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রম কিংবা পরীক্ষা নিয়ে নয়, বরং বিশ্ববিদ্যালয় এবং আবাসিক হল খোলা নিয়েও প্রশাসনের সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে না পারার খেসারত শিক্ষার্থীদের দিতে হচ্ছে। গত বছরের সেপ্টেম্বর থেকেই দেশের যখন সব কার্যক্রম স্বাভাবিকভাবে চলছিল; প্রশাসন চাইলে তখনই বিশ্ববিদ্যালয় ও হল খুলে দিতে পারত। বিষয়টি আগেও আলোচনায় এসেছে। কারণ করোনা দুর্যোগ থেকে নিজেদের সুরক্ষায় বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীরা যথেষ্ট পরিপকস্ফ। তখন আমরা এবং গোটা বিশ্ব 'নিউ নরমালে' অভ্যস্ত হলেও আমাদের শিক্ষা পিছিয়ে থাকার দায় কি প্রশাসন এড়াতে পারবে? এ ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সামনে থেকে নেতৃত্ব দিলে অন্যান্য পর্যায়ের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানও খোলার সম্ভাবনা তৈরি হতো। তাতে আজ আমাদের শিক্ষার্থীদের এই দীর্ঘ সংকটে পড়তে হতো না।

অনেক জল ঘোলা করে যখন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার ঘোষণা এলো, তারপরই শুরু হলো করোনার দ্বিতীয় ঢেউ। বিস্ময়ের বিষয়, শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে বিশ্ববিদ্যালয় খোলার তারিখ ঘোষণা করা হয় মে মাসে; অথচ অন্যদের ৩০ মার্চ থেকেই খোলার কথা বলা হলো। যা হোক, বিদ্যালয় খোলার পরবর্তী তারিখ ঘোষণা করা হয়েছে ২৩ মে। ১৭ মে থেকে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর আবাসিক হল খোলার সিদ্ধান্ত নেওয়া হলেও ওই দিনই যে হল খুলছে না- তা নিশ্চিত এবং তার পেছনে যুক্তিও ইতোমধ্যে খাড়া হয়ে আছে। বলা হয়েছিল, ১৭ মের মধ্যেই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের টিকা দেওয়ার পর হল খোলা হবে। টিকার চলমান সংকটে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ১৭ মে হল খোলার সিদ্ধান্ত স্থগিত করে। খোদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েরই যখন এ অবস্থা, তখন অন্যদের কথা বলাই বাহুল্য।

তার মানে, ১৭ মে থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হল খুলছে না। আর তাতে ২৩ মে থেকে শ্রেণি কার্যক্রমও শুরু হচ্ছে না। এ ক্ষেত্রে অবশ্য করোনা পরিস্থিতির বিষয়টি বিবেচনায় রাখতে হবে। সরকার ইতোমধ্যে দেশে ১৬ মে পর্যন্ত চলমান বিধিনিষেধ বৃদ্ধি করেছে। যদিও শহরে গণপরিবহন চালু হয়ে গেছে। মার্কেট তো খোলা আরও আগ থেকেই। করোনা পরিস্থিতির উন্নতি সাপেক্ষে ১৭ মে থেকে যদি সরকার সব বিধিনিষেধ তুলে নেয়, তাহলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর আবাসিক হল সেদিনই খোলা উচিত। যদি অফিস-আদালত, কলকারখানা, বাজার-ঘাট, গণপরিবহন- সব চলে স্বাস্থ্যবিধি মেনে; বিশ্ববিদ্যালয়ও খোলা উচিত। কোনোভাবেই আর দেরি করা ঠিক হবে না। এ বিষয়কে টিকার সঙ্গে যুক্ত করাও অযৌক্তিক সিদ্ধান্ত। টিকা নিয়ে যে অনিশ্চয়তা ও রাজনীতি শুরু হয়েছে, তাতে টিকা পেতে এবং সব শিক্ষার্থীর জন্য তা নিশ্চিত করতে কেমন সময় লাগবে, আমরা কেউই জানি না। ফলে বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা আবাসিক হল খোলার বিষয়কে নিজের গতিতেই ছেড়ে দেওয়া উচিত।

আমার ক্ষুদ্র পর্যবেক্ষণের পরামর্শ হলো, অনলাইনে ক্লাস কিংবা পরীক্ষার চেয়ে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কত দ্রুত খুলে দেওয়া যায়, সে ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত সর্বাগ্রে। যে মুলা ঝুলিয়ে এতদিন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের অনলাইনে পরীক্ষা নেওয়া হয়নি, এখন সে আলোচনা বাদ দিয়ে আবার অনলাইনে ফেরা কেন? কয়েক দিন ধরে করোনার উন্নতির ধারা স্পষ্ট। এ অবস্থার আলোকে আগের মতো সব খুলবে অথচ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলবে না- তা তো হতে পারে না। আর হ্যাঁ, পরিস্থিতির উন্নতি না হলে অনলাইনের কথা শুরুতেই বলেছি, অনলাইনে ক্লাস হলে পরীক্ষাও অবশ্যই হতে হবে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যেখানে ইতোমধ্যে দুই-তিনটি সেমিস্টার শেষ করে ফেলেছে, সেখানে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সেশনজটে আটকে থাকা কেন? যে সেশনজট থেকে জাতি মুক্তি পেয়েছে; অযৌক্তিকভাবে সেটি ফিরিয়ে আনার প্রভাব পড়বে নানাদিকে। শিক্ষার্থীদের ডিগ্রি পেতে দেরি হবে। চাকরিতে বয়সের দিক থেকেও তারা পিছিয়ে পড়বেন। অতিরিক্ত এ সময়ে তাদের ভার পড়বে পরিবারের ওপর। তা ছাড়া শিক্ষার্থীরা এখন যেভাবে সময় কাটাচ্ছেন; ইতোমধ্যে তাদের 'বারোটা বেজে গেছে'।

বলা হয়, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা বেশি মেধাবী; এখানে অন্যান্য শিক্ষা উপকরণ এবং বরাদ্দও বেশি। অতীতের মতোই এ দুর্যোগে তারা কেন নেতৃত্বের আসনে থাকবেন না?

ট্যাগঃ , , ,

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।