একদিকে ক্ষুধার্ত মানুষের কঙ্কালসার দেহ, আরেকদিকে প্লেটভর্তি নষ্ট করা খাবার- দুটি বিপরীত চিত্র। উভয়টিই পৃথিবীর নিদারুণ বাস্তবতা। সম্প্রতি প্রকাশিত জাতিসংঘের প্রতিবেদনে জানা যায়, বিশ্বব্যাপী বছরে প্রায় ১০০ কোটি টন খাবার নষ্ট হয়। জাতিসংঘ পরিবেশবিষয়ক সংস্থা-ইউএনইপির 'ফুড ওয়াস্ট ইনডেক্স রিপোর্ট ২০২১' অনুযায়ী, বাংলাদেশের প্রতি ঘরে বছরে গড়ে ৬৫ কেজি খাবারের অপচয় হয়। এমনকি পরিসংখ্যান অনুযায়ী, আমেরিকান ও জাপানিদের তুলনায় বাংলাদেশিরা বেশি খাবার অপচয় করে। খাদ্যশস্য উৎপাদন থেকে শুরু করে ঘরে তোলা এবং থালা পর্যন্ত নানাভাবে খাবারের অপচয় হয়। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে চলে যেন খাবার নষ্টের প্রতিযোগিতা। মনে রাখা দরকার, খাবার অপচয় করা কোনো ফ্যাশন নয় বরং এটি অমানবিকতা এবং অপরাধ।
খাবারসহ জীবন ধারণের যে কোনো বিষয়ে অপচয় না করার তাগিদ রয়েছে বিভিন্নভাবে। কেবল খাবার নষ্ট করাই নয়; সময় এবং জীবনের উপায়-উপকরণেও সব ধরনের অপচয় পরিত্যাজ্য। এর মধ্যে খাবার অপচয়ের বিষয়টি একেবারে ভিন্ন। কেউ যদি মনে করেন, আরেকজনের বিয়েতে এসেছেন; খেতে যেমন বারণ নেই, তেমনি ফেলতেও সমস্যা নেই; বিষয়টি তা নয়। এটা মনে করা যাবে না, অপচয়ের ফলে নিজের টাকা খরচ হচ্ছে না। আমাদের মানসপটে যদি আফ্রিকার ক্ষুধার্ত শিশুর চেহারা ভেসে ওঠে কিংবা না খেয়ে থাকা ইয়েমেনের কোনো মানুষের কথা; তখন কেমন লাগবে? বেশি দূরে যাওয়া নয়, হয়তো আমাদের পাশের কোনো ঘরেই সবার ঠিকমতো তিন বেলা খাবার জোটে না। তাহলে কীভাবে খাবার অপচয় সম্ভব! খাবারের যদি কথা বলার সামর্থ্য থাকত, জানি না নষ্ট হওয়া খাবারগুলো ঠিক কী বলত! যে খাবার এত মজা করে খাওয়া হচ্ছে, অর্ধেক খাওয়ার পরই যদি বলা হয়, আর পারছি না, তাহলে এ খাবার যাবে কোথায়? কয়েক মিনিটের ব্যবধানে সুস্বাদু খাবারটা পরিণত হলো স্রেফ ঝুটায়? আপনি কতটুকু খেতে পারবেন, খাবার নেওয়ার আগেই তা চিন্তা করা উচিত।
রেফ্রিজারেটর তথা ফ্রিজ আসায় খাবার অপচয় অনেকখানি রোধ করা সহজ হয়েছে; এটা সত্য। কিন্তু সদিচ্ছা না থাকলে ওই শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত যন্ত্রটি কিছুই করতে পারবে না। আবার ইচ্ছা থাকলে ফ্রিজ ছাড়াও খাবার সংরক্ষণ করা অসম্ভব নয়। ছোটবেলায় আমরা দেখেছি, কীভাবে আমাদের মা-দাদিরা ফ্রিজ ছাড়া খাবার সংরক্ষণ করতেন। অপচয় বন্ধে সদিচ্ছাই যখন প্রধান, তখন ধনী কী, আর গরিবই বা কী? জাতিসংঘের পরিসংখ্যানে আমরা দেখছি, উন্নত দেশগুলোতে যত খাবার অপচয় হয়, তার চেয়ে বেশি অপচয় হয় নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশগুলোতে। অপচয়ে দক্ষিণ এশিয়ায় শীর্ষস্থানে রয়েছে আফগানিস্তান, এর পর নেপাল। এদিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থান ভালো হলেও তাৎপর্যপূর্ণ নয়। তবে আমাদের প্রতিবেশী দেশের অবস্থানের প্রশংসা করতে হবে। ভারতে প্রতি ঘরে গড়ে বছরে ৫০ কেজি খাবার অপচয় হয়, যা দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সর্বনিম্ন।
বিশ্বব্যাপী কেমন খাবার অপচয় হয়, তার সাধারণ হিসাব- মোট খাবারের এক-তৃতীয়াংশ কখনও খাওয়াই হয় না। অথচ ওই খাবার দিয়েই বিশ্বের ক্ষুধার্ত মানুষের খাবারের বন্দোবস্ত করা অসম্ভব নয়। বলা বাহুল্য, খাবার অপচয় কেবল খাবার না পাওয়া কোটি কোটি ক্ষুধার্ত মানুষের সহযোগিতার উদ্যোগকেই ব্যাহত করে না; একই সঙ্গে পরিবেশ বিনষ্টেও ভূমিকা রাখে। জাতিসংঘের প্রতিবেদন বলছে, খাবারের অপচয় একটি দেশের সঙ্গে তুলনা করা হলে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের পর সেটি তৃতীয় সর্বোচ্চ কার্বন নির্গমনকারী দেশ হতো।
খাবার অপচয় করা সহজ, কিন্তু উৎপাদন করা কতটা কঠিন, তা ভেবে দেখা দরকার। কৃষক মাথার ঘাম পায়ে ফেলে শস্য উৎপাদন করেন। আমরা যে ভাত খাই তা থালা পর্যন্ত আসার প্রক্রিয়া শ্রম ও সময়সাধ্য। জমিকে উৎপাদনের উপযোগী করে ধানের বীজ থেকে উৎপন্ন চারা রোপণ করেন কৃষক। সেখানে পানি ও প্রয়োজনীয় সার দিয়ে কৃষককে তত্ত্বাবধান করতে হয়। পাকলে তা কেটে মাড়াই দিয়ে ধান বের হয়। এর পর ধান সিদ্ধ করে শুকিয়ে মেশিনে ভাঙালে চাল হয়। খাবার উৎপাদন, সংরক্ষণ, প্রক্রিয়াজাতকরণ, পরিবহন এবং এরপর রান্নার সময় ব্যবহার হয় জ্বালানি। এমন সব খাবারই দীর্ঘ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে তৈরি হয়। এভাবে তৈরি হওয়া খাবার এত সহজে আমরা ফেলে দিই!
করোনা দুর্যোগের মধ্যে বিশ্বজুড়ে অর্থনীতি ভালো নেই। অনেক মানুষের আয়-রোজগার কমে গেছে। এ পরিস্থিতিতে বিশ্বের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতে সবাই নিজ অবস্থান থেকেই ভূমিকা রাখতে পারেন কেবল অযথা অপচয়টুকু বন্ধ করার মাধ্যমে। মনুষ্যসৃষ্ট যুদ্ধও খাবার সংকট তৈরি করে। জাতিসংঘের খাদ্য কর্মসূচির পরিসংখ্যান বলছে, যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশগুলোতেও সবচেয়ে বেশি মানুষ অপুষ্টি ও ক্ষুধা নিয়ে বেঁচে আছে। ইয়েমেনের প্রায় ৭০ শতাংশ মানুষ ঠিকমতো খাবার পায় না। আফ্রিকার কঙ্গো, দক্ষিণ সুদান ও নাইজারের মানুষও কঠিন সংকট মোকাবিলা করছে। সিরিয়া, ইথিওপিয়া, হাইতিসহ অনেক দেশের অপুষ্টি ও ক্ষুধা শঙ্কিত করে। এসব দেশের শিশুর চিৎকার আমাদের কর্ণকুহরে না পৌঁছলেও উপলব্ধি করা দরকার। বাংলাদেশের অবস্থার উন্নতি হয়েছে সত্য, তবে এখনও দেশের একটি অংশ অপুষ্টির শিকার। করোনা দুর্যোগের ফলে দেশে অনেক পরিবারই খাদ্য সংকটে পড়েছে। বিশ্বের ৮০ কোটি মানুষের ক্ষুধার জ্বালা আমরা নিবারণ করতে না পারি, অন্তত ব্যক্তিগত পর্যায়ে খাবার অপচয় তো আমরা রোধ করতে পারি।
প্রয়োজনের অতিরিক্ত খাবার কেনা, রান্না করা এবং থালায় নেওয়া- এ তিনটি ঘর পর্যায়ে খাবার অপচয়ের মূল কারণ। অতিরিক্ত থাকলেই তখন সংরক্ষণের বিষয় আসে। সংরক্ষণের অভাবেও অনেক খাবার অপচয় হয়। এটি রোধ করার উপায় হলো অতিরিক্ত কিছু না করা। পচনশীল খাবার যেমন ফল, সবজি ইত্যাদি কীভাবে সংরক্ষণ করা যায়, সে উপায়ও বের করা এখন কঠিন নয়। হোটেল-রেস্টুরেন্টেও অতিরিক্ত খাবার নেওয়া উচিত নয়। অপচয় রোধে সদিচ্ছা থাকলে পরিস্থিতি অনুযায়ী যে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া সম্ভব। পৃথিবীর অনেক জায়গায় 'জিরো ওয়েস্ট' রেস্টুরেন্ট রয়েছে, যেখানে খাবার অপচয় নিষিদ্ধ। কোথাও অতিরিক্ত খাবার দরিদ্র কিংবা দাতব্য প্রতিষ্ঠানে দেওয়ার আইনও রয়েছে। আমাদের গ্রামের মানুষ খাবার অতিরিক্ত থাকলে তা দিয়ে হাঁস-মুরগি কিংবা মাছের খাবার তৈরি করতে পারে। কিন্তু শহরে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তা চলে যায় ডাস্টবিনে। খাবার অপচয়ে শহরের মানুষদের বেশি সচেষ্ট হওয়া চাই। যে খাবার জীবন বাঁচায় সে খাবার আমরা কীভাবে অপচয় করি! যে খাবার মানুষ পায় না, তা এভাবে আমরা ফেলে দিই? এমনটি হতে পারে না। হওয়া উচিতও নয়। এ জন্য প্রয়োজন শুধু সদিচ্ছা।