Mahfuzur Rahman Manik
অনলাইনে ভর্তি পরীক্ষায় শিক্ষার্থীদের কথা ভাবতে হবে- অধ্যাপক ড. এ কে আজাদ চৌধুরী
অক্টোবর 28, 2020

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক ড. এ কে আজাদ চৌধুরী বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ও ভারতের নয়াদিল্লির সাউথ এশিয়ান ইউনিভার্সিটির বোর্ড অব গভর্ন্যান্সের চেয়ারম্যান হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। এর আগে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লিনিক্যাল ফার্মাসি ও ফার্মাকোলজি বিভাগে দীর্ঘদিন অধ্যাপনার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। যুক্তরাজ্যের ম্যানচেস্টার ইউনিভার্সিটি থেকে ঔষধবিজ্ঞানে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জনকারী এ কে আজাদ চৌধুরী ১৯৪৬ সালে ফেনী জেলায় জন্মগ্রহণ করেন
সমকাল: কয়েক বছর ধরে উচ্চশিক্ষায় সেশনজট ছিল না বললেই চলে। করোনায় নতুন করে সেশনজটের কথা শোনা যাচ্ছে। আপনার কী মনে হয়।
এ কে আজাদ চৌধুরী: হ্যাঁ, দীর্ঘদিন উচ্চশিক্ষায় সেশনজটের সমস্যা ছিল না। আমি যখন (১৯৯৬-২০০১) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ছিলাম, তখনই সেশনজটমুক্ত করার উদ্যোগ গ্রহণ করি। এরপর ধীরে ধীরে অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ও এ থেকে মুক্ত হয়। এটা সত্য যে, করোনাদুর্যোগের কারণে সেশনজটের আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। তবে সেশনজট খুব বেশি হবে বলে আমি মনে করি না। কারণ ইতোমধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অনলাইন শিক্ষা চালু করেছে।
সমকাল
: প্রশাসন কি চাইলে বিশ্ববিদ্যালয় খুলতে পারত?
এ কে আজাদ চৌধুরী: করোনার মধ্যেও আমরা দেখেছি পোশাক শিল্পকারখানাসহ অর্থনৈতিক সবকিছুই খোলা রয়েছে। অথচ বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার সে সাহসিকতা প্রশাসন দেখাতে পারেনি। এর বাস্তব কারণ অস্বীকার করা যাবে না। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষার্থীরা স্বাস্থ্য সচেতন বটে। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে তো আবাসিক হলও খুলতে হবে। আমরা জানি, বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলের কোনো কোনো রুমে ১৬/১৭ জনও থাকে। সেখানে কীভাবে শারীরিক দূরত্ব থাকবে?
সমকাল: করোনাদুর্যোগের এ সময়ে উপচার্যগণ অনলাইনে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা নেওয়ার কথা বলেছেন। বিদ্যমান বাস্তবতায় অনলাইন পদ্ধতি কতটা যৌক্তিক বলে মনে করেন?
এ কে আজাদ চৌধুরী: অনলাইনে বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষা গ্রহণ একেবারে অসম্ভব হবে বলে আমি মনে করি না। তবে, অনলাইনে ভর্তি পরীক্ষা গ্রহণের অনেক চ্যালেঞ্জ রয়েছে বলে এটি আমাদের জন্য কঠিন হবে। আমরা জানি, এবার ১৩ লক্ষাধিক শিক্ষার্থী উচ্চশিক্ষার জন্য প্রস্তুত হচ্ছে। সেখানে শহরের শিক্ষার্থী যেমন রয়েছে, তেমনি গ্রামের শিক্ষার্থীও কম নয়। ফলে অনলাইনে পরীক্ষা দেওয়ার সক্ষমতা সবার সমানভাবে নেই।
সমকাল: অনলাইন সক্ষমতা মানে কী?
এ কে আজাদ চৌধুরী
: অনলাইনে পরীক্ষা নিতে হলে শিক্ষার্থীদের কম্পিউটার কিংবা ল্যাপটপে বসতে হবে। কিংবা অন্তত স্মার্টফোনে পরীক্ষা দিতে হবে। সব শিক্ষার্থীর এসব ডিভাইস নাও থাকতে পারে। এর সঙ্গে যুক্ত হবে ইন্টারনেট নেটওয়ার্ক, ইন্টারনেটের গতি ও বিদ্যুৎ থাকা না থাকা। এর সঙ্গে অর্থনৈতিক বিষয়ও চলে আসে। এমনিতেই করোনার কারণে দেশের অধিকাংশ পরিবারের আয় কমে গেছে।
সমকাল: বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষা নেওয়ার ক্ষেত্রে আপনার পরামর্শ কী?
এ কে আজাদ চৌধুরী: আমার মনে হয় ভর্তির ক্ষেত্রে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, সেটি যথোপযুক্ত। সেখানে সরাসরি ভর্তি পরীক্ষা হবে। করোনার কারণে তারা নম্বর কমিয়েছে। ২০০ নম্বরের পরিবর্তে এবার ১০০ নম্বরের ভর্তি পরীক্ষা নেওয়া হবে। তারা ঢাকার বাইরে ভর্তি পরীক্ষা নেওয়ার কথা বলেছে। আমিও মনে করি, অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ও এ রকম শহরগুলোতে পরীক্ষা নিতে পারে।
সমকাল: আপনি কি উপজেলা পর্যায়ে ভর্তি পরীক্ষার কথা বলছেন?
এ কে আজাদ চৌধুরী
: উপজেলা পর্যায়ে না হোক, জেলা পর্যায়ে স্বাস্থ্যবিধি মেনে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা হতে পারে। এতে সংশ্নিষ্ট জেলার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর সহযোগিতার প্রয়োজন হবে। এক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) সারাদেশে সমন্বয়কের ভূমিকা পালন করতে পারে। সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা এভাবেই হতে পারে।
সমকাল: আপনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার কথা বলেছেন। তারা সমন্বিত কিংবা গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষায় নেই...
এ কে আজাদ চৌধুরী: ইউজিসির চেয়ারম্যান থাকাকালে আমি নিজেও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষার জন্য চেষ্টা করেছিলাম। আমরা জানি, এ বছরের শুরুতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা নিয়ে সিদ্ধান্ত হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ রাজশাহী, জাহাঙ্গীরনগর ও চট্টগ্রাম তথা চারটি স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয় এবং বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ও এর বাইরে থাকছে। বড় বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তাদের নিজস্ব চাহিদার আলোকে পরীক্ষা নেবে- সেটাও আমরা অস্বীকার করতে পারি না। তাদেরও নিজস্ব যুক্তি রয়েছে।
সমকাল: জেএসসি ও এসসসি পরীক্ষার ভিত্তিতে তৈরি এইচএসসির ফল নির্ধারণ ছাড়া আমাদের ভালো বিকল্প ছিল কি?
এ কে আজাদ চৌধুরী: করোনা পরিস্থিতির আলোকে এই সিদ্ধান্ত মন্দের ভালো। করোনার বাস্তবতা আমরা অস্বীকার করতে পারি না। সারাবিশ্বেই একই বাস্তবতা। এমন বাস্তবতা একশ বছরে একবার আসে। ১৯১৮ সালে যেমন বিশ্ব স্প্যানিশ ফ্লু দেখেছে। এবার দেখছে করোনা।
সমকাল: আগে বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তির মেধা তালিকা তৈরিতে এইচএসসি ও এসসসির ফল বিবেচনা করা হতো। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় তো সে ফলের আলোকেই ভর্তির সিদ্ধান্ত নিয়েছে...
এ কে আজাদ চৌধুরী: এমনিতেই এবারের এইচএসসি ও সমমানের ফল আগের দুটি পরীক্ষার সমন্বয়ে করা হচ্ছে, তার ওপর এ ফল যদি উচ্চশিক্ষায় ভর্তির ক্ষেত্রেও বিবেচনা করা হয়, তার মানে এর প্রতি দ্বিগুণ জোর দেওয়া হবে। এটি বুদ্ধিমত্তার পরিচায়ক হবে বলে আমি মনে করি না। এতে দেখা যাবে, আগে যারা ভালো করেছে তারাই এগিয়ে যাবে। এবার যারা ভর্তি পরীক্ষার জন্য কিংবা এইচএসসির জন্য ব্যাপক প্রস্তুতি নিয়েছে অথচ আগে আগে কাঙ্ক্ষিত মানের ফল অর্জন করতে পারেনি, তারা পিছিয়ে পড়বে।
সমকাল: বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন ভর্তি পরীক্ষার ক্ষেত্রে কী ভূমিকা রাখতে পারে?
এ কে আজাদ চৌধুরী: বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) কাজ বহুবিধ। ইউজিসি যেমন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে ভর্তি পরীক্ষা কী পদ্ধতিতে হতে পারে সে বিষয়ে পরামর্শ দিতে পারে, তেমনি তা বাস্তবায়নে পর্যবেক্ষণ ও তদারকি করতে পারে। আগেও বলেছি, ইউজিসি সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষার ক্ষেত্রে সমন্বয়কের ভূমিকা পালন করবে।
সমকাল: সর্বোপরি করোনায় উচ্চশিক্ষার যে ক্ষতি হয়েছে, তা পুষিয়ে নিতে আপনার পরামর্শ কী?
এ কে আজাদ চৌধুরী: করোনায় উচ্চশিক্ষাসহ শিক্ষার সর্বস্তরেই ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। আমরা হয়তো শিক্ষার ক্ষতি তৎক্ষণাৎ বুঝতে পারি না। অর্থনীতির ক্ষতি সঙ্গে সঙ্গে ধরা যায়। যেমন একজন শ্রমিক এক সপ্তাহ কাজে না গেলে এরপর তার পেট চলবে না। কিংবা সে কাজ না করলে উৎপাদন হচ্ছে না। এটা ধরা যাচ্ছে। কিন্তু শিক্ষার্থীরা যে মাসের পর মাস আনুষ্ঠানিক শিক্ষার বাইরে থাকছে, তার ক্ষতি এখনই ধরা যাচ্ছে না। তবে দীর্ঘমেয়াদে এর প্রভাব পড়তে বাধ্য। অনলাইন সহায়ক ভূমিকা পালন করছে বটে তবে অনলাইনে সবাই আসতে পারছে না। আর আনুষ্ঠানিক বা সরাসরি শিক্ষার চাহিদা অনলাইনে পূরণ করা সম্ভবও নয়। এ অবস্থায় সবাই মিলে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে হবে। সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নিলে হারজিতের প্রশ্ন থাকে না।
সমকাল: সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
এ কে আজাদ চৌধুরী: আপনাকেও ধন্যবাদ। সমকালের জন্য শুভ কামনা।

ট্যাগঃ , , ,

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।