Mahfuzur Rahman Manik
পরীক্ষার ফ্রেমে আবদ্ধ শিক্ষার মান!

শিক্ষায় মান গেল বলে আমাদের চিন্তার অন্ত নেই। মানসম্পন্ন কিংবা গুণগত শিক্ষা আমরা খুঁজছি। শনিবার (২২ জুন ২০১৯) সমকালের একটি প্রতিবেদন তার অন্যতম প্রমাণ। যার শিরোনাম- স্কুল-কলেজ হাজার হাজার, মান কই। মান নিয়ে প্রশ্ন, কিন্তু মানটা আসলে কী? মানের অবয়ব নেই, একে ধরাছোঁয়া যায় না। অথচ আমরা সেটাকে ধরতে চাইছি, কিছু সংখ্যা দিয়ে পরিমাপ করছি। একটা প্রতিষ্ঠান থেকে বেশি জিপিএ ৫ পেল। আমরা ধরেই নিই, প্রতিষ্ঠানটির বুঝি মান খুব বেড়ে গেল। কিংবা কোনো শিক্ষার্থী ভালো রেজাল্ট করলে আমরা ভাবি, শিক্ষার্থীর মান ভালো। কিন্তু আমাদের ভাবনায় ছেদ পড়ে, যখন জিপিএ ৫ পাওয়া শিক্ষার্থী সাধারণ বিষয়টিও বুঝতে অক্ষম। আমরা সেটা টের পেয়ে ছি ছি করি। আমাদের পরীক্ষা পদ্ধতিতেই গলদ রয়েছে, সেটা অনেকেই বলেছেন। ড. মোহাম্মদ মনিনুর রশিদ সমকালেই (৮ মে ২০১৯) তার 'শিক্ষায় মূল্যায়ন ব্যবস্থা এবং গুণগত মান' শিরোনামের লেখায়ও তা তুলে ধরেছেন। আবার মান যে কেবল পরীক্ষার ওপরই নির্ভরশীল নয়, সেটাও বুঝতে হবে।

মানের বিষয়টি যখন আমরা পরীক্ষার ফ্রেমে আবদ্ধ করে ফেলেছি, তখন পরীক্ষাই হয়ে উঠল শিক্ষার একমাত্র ধ্যানজ্ঞান। শিক্ষকরা শেখান পরীক্ষায় পাসের জন্য; শিক্ষার্থী পড়াশোনা করে কেবল পরীক্ষায় ভালো ফলের জন্য। এর সঙ্গে যুক্ত হলো কোচিং সেন্টারের টেকনিক, যুক্ত হলো নোট-গাইড। প্রশ্ন পদ্ধতি সৃজনশীল হলো, নোট-গাইডও সৃজনশীল হয়ে উঠল। এভাবেই জয় হলো পরীক্ষার। বাড়ল পরীক্ষা। প্রাথমিক ও মাধ্যমিকে পাবলিক পরীক্ষা শুরু হলো। পরীক্ষায় পাসের হার কিংবা জিপিএ ৫- সংখ্যায় সবারই উন্নতি ঘটল। রইল বাকি- মান।

তাহলে মানটা কী? মান নিয়ে হাফিংটন পোস্টে 'হোয়াট ডু উই মিন বাই অ্যা কোয়ালিটি এডুকেশন? বা মানসম্মত শিক্ষা বলতে আমরা কী বুঝি- শিরোনামে একটি নিবন্ধে অসাধারণ বিষয় তুলে ধরেছেন লেখক সিয়ান স্লেইড। তিনি বলছেন, যার বিকাশ ঠিক আছে, শিক্ষার অর্জন ঠিক আছে এবং যিনি সমাজের একজন সক্রিয় ও উৎপাদনক্ষম সদস্য, তার শিক্ষার যথাযথ মান অর্জিত হয়েছে। তিনি আরও বলেছেন, মানসম্মত বা গুণগত শিক্ষার কেন্দ্রবিন্দু হবে শিশুর সামাজিক, আবেগিক, মানসিক ও শারীরিক বিকাশ। এটি শিশুকে জীবনের জন্য প্রস্তুত করে; কেবল পরীক্ষার জন্য নয়। বলা বাহুল্য, ঠিক এ বিষয়গুলো আমরা অনেক আগেই বুঝতে পেরেছি। আমাদের প্রাথমিক শিক্ষার লক্ষ্যে শিশুর সার্বিক বিকাশের কথাই রয়েছে। বলা চলে, আমরা আরেক ধাপ এগিয়ে। আমাদের প্রাথমিক শিক্ষার লক্ষ্য হলো- 'শিশুর শারীরিক, মানসিক, সামাজিক, নৈতিক, মানবিক, নান্দনিক, আধ্যাত্মিক ও আবেগিক বিকাশ সাধন এবং তাদের দেশাত্মবোধে, বিজ্ঞানমনস্কতায়, সৃজনশীলতায় ও উন্নত জীবনের স্বপ্নদর্শনে উদ্বুদ্ধ করা।' এমনকি আমাদের মাধ্যমিক শিক্ষার লক্ষ্যেও শিক্ষার্থীর সার্বিক বিকাশের কথা বলা হয়েছে। আমাদের প্রাথমিক শিক্ষার যে ২৯টি প্রান্তিক যোগ্যতা রয়েছে, সেখানেও শিক্ষার্থীর বিকাশসহ সামাজিক সৃজনশীল মানুষ হিসেবে গড়ে ওঠার সব বিষয় সুন্দরভাবে এসেছে।

এসব বিষয় কাগজে-কলমে থাকা সত্ত্বেও এগুলোকে প্রাধান্য না দিয়ে কেবল গৎবাঁধা 'পরীক্ষা' কীভাবে আমাদের মান পরিমাপের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠল, সে এক বিস্ময়! ফলে আমরা দেখি, গবেষণায় বের হয়- শ্রেণিকক্ষে শিশু তেমন কিছু শিখছে না। শিশুর প্রান্তিক যোগ্যতার অধিকাংশই অর্জিত হচ্ছে না। কারণ আমাদের শিক্ষার লক্ষ্য হয়ে উঠছে ভালো পাস করা, সর্বোচ্চ গ্রেড পাওয়া, শ্রেণিকক্ষে প্রথমদিকে থাকা। এ জন্য শিক্ষার্থী যত না দৌড়াচ্ছে, তার চেয়ে বেশি দৌড়াচ্ছেন অনেক অভিভাবক। অনেক মা-বাবার কাছে শিশুর এ প্লাস পাওয়াটা গর্বের; না পেলে যেন সমাজে চলতে পারবেন না। পরীক্ষার চাপে শিশুর ঠিকমতো ঘুম নেই, বিনোদন নেই, বিশ্রাম নেই। ক্লাস, কোচিং, প্রাইভেট- এভাবেই সারাদিন কাটাতে হয় অনেক শিশুকে। কারণ টার্গেট কেবল পরীক্ষা। ভালো রেজাল্টকেই যে আমরা 'মান' বানিয়ে ফেলেছি। অথচ আসল মানের খবর নেই।

আমাদের জন্য সুখবর- শিশুদের পরীক্ষা উঠে যাচ্ছে। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পরীক্ষা বাদ যাচ্ছে। সিঙ্গাপুর ও ফিনল্যান্ডের মতো শিশুদের পরীক্ষা উঠিয়ে দিয়ে আনন্দায়ক পরিবেশে শিক্ষার কথা বলেছেন প্রধানমন্ত্রী। ফিনল্যান্ডে শিশুদের ১৬ বছর পর্যন্ত কোনো পরীক্ষা নেই। উন্নত বিশ্বে প্রায় সবাই শিশুদের হেসেখেলে শিক্ষা নিশ্চিত করছে। তার অনুসরণ করতে পারলে আমাদের জন্যই কল্যাণ; তাতে শিশুর অর্জন যেমন নিশ্চিত হবে, বিকাশও হবে সুষম। এখন তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পরীক্ষার পরিবর্তে শিশুদের বিকল্প মূল্যায়ন নিয়ে কাজ চলছে। এ জন্য খুব মাথা ঘামানোর কিছু নেই। কেবল শিশুর বিকাশ কীভাবে নিশ্চিত করা যায়, সেদিকে নজর দেওয়াই বিকল্প সমাধান। কানাডা প্রবাসী এক বোনের কল্যাণে লেখকের দেখার সুযোগ হয়েছে, সেখানে কীভাবে প্রাথমিক স্কুলপড়ূয়া তার মেয়ের মূল্যায়ন করা হয়। সেখানে পরীক্ষা তো নেই-ই, বরং দুটি কার্ড আছে। একটা শিক্ষার্থী নিজে পূরণ করে, আরেকটি স্কুল পূরণ করে অভিভাবককে দেয়। মাই ওউন রিপোর্ট কার্ড-এ ছবিসহ কিছু বিষয় শিক্ষার্থী নিজেই পূরণ করে দেয়। যেমন :আমি স্কুলের নিয়ম ও রুটিন মেনে চলি, আমি শিক্ষকের কথা শুনি ও নির্দেশনা অনুসরণ করি, আমি পড়তে পছন্দ করি, আমি গ্রুপে কাজ করতে ভালোবাসি, আমি আমার খেলনা ও স্কুলসামগ্রী যত্ন করে রাখি, আমি সাহায্য ছাড়াই কাজ করতে পারি, আমি ক্লাসে কথা বলতে হাত উঠাই, আমি সংখ্যা পছন্দ করি, আমার একজন ভালো বন্ধু আছে আর আমি খেলি। মোটামুটি এর মাধ্যমেই শিশুর মূল্যায়ন হয়ে যায়। আর স্কুল থেকে অভিভাবকদের জানান দেওয়া হয়, শিশুর বিষয়ভিত্তিক অর্জন মোটামুটি, ঠিক আছে নাকি বেশি। এ ব্যাপারে শিশুও কিছু জানে না। এভাবে যদি আমরা শিশুর মূল্যায়ন করতে পারি, তবেই আমাদের শিক্ষার লক্ষ্য যেমন অর্জিত হতে পারে, তেমনি নিশ্চিত হতে পারে শিক্ষার মানও।

আমাদের বিদ্যমান বাস্তবতায় পরীক্ষা পুরোপুরি বাদ দিতে হবে- সেটা আমরা বলছি না। শিক্ষার্থীর অর্জিত জ্ঞান ও দক্ষতার মূল্যায়নের জন্য পরীক্ষা থাকবে। তবে সেটা শিক্ষার্থীর উপযোগী হবে। কিন্তু পরীক্ষা কিংবা তার ফলই কেবল মূল টার্গেট হবে না। তাহলেই হয়তো শিশুর শিখন ভালো হবে এবং প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানই মানসম্মত হয়ে উঠতে পারে। এ জন্য প্রয়োজন আমাদের আন্তরিকতা ও মানসিকতার পরিবর্তন। প্রতিটি বিদ্যালয়ে শিক্ষকরা যদি আন্তরিকভাবে শিশুদের পাঠদান করেন; শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে যদি দক্ষ করে গড়ে তোলা যায়, তাহলে শিক্ষায় ইতিবাচক পরিবর্তন আসবে, শিশুর বিকাশ নিশ্চিত হবে- সে প্রত্যাশা আমরা করতেই পারি।

ট্যাগঃ , , ,

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।