Mahfuzur Rahman Manik
অপরাধবোধ এবং এক নিষিদ্ধ গল্প!


উপন্যাস- গল্পটি শুনতে চেয়ো না
লেখক- সোহেল নওরোজ,
প্রকাশক- দেশ পাবলিকেশন্স
প্রচ্ছদ- সোহানুর রহমান অনন্ত

নাই কাজ তো খই ভাজ। লেখক বলছেন, না খইও ভাজা যাবে না; কারণ এটাও একটা কাজ। অলসভাবে শুয়ে থাকাটাই হতে পারে কাজহীন অবস্থা কাটানোর শ্রেষ্ঠ উপায়। যদিও এর সঙ্গে 'গল্পটি শুনতে চেয়ো না' উপন্যাসের মূল 'গল্পের' কোনো সম্পর্ক নাই। তাহলে গল্পটা কী। যে গল্পটি শুনতে চাওয়া বারণ? যে গল্পটি হাফিজুল হক তার মেয়ে অর্পাকেও শুনতে দেননি। গল্পটা ঠিকই সোহেল নওরোজ পাঠকদের শুনিয়েছেন। কিন্তু সব পাঠকই যে তা ধরতে পারবে, সে নিশ্চয়তা দেওয়া যাচ্ছে না। লেখকের মুনশিয়ানা বোধহয় এখানেই।

মোচড়ের পর মোচড় আর মন খারাপ করে দেওয়া উপন্যাসটি শুরু হয়েছে হাফিজুল আর মেয়ে অর্পার কথোপকথন দিয়ে। হাফিজুল হক লেখক মানুষ। একটি উপন্যাস তিনি দাঁড় করাচ্ছেন। উপন্যাসের চরিত্রগুলো লেখার সঙ্গে সঙ্গে হাতেও আঁকছেন। প্রথমে এসেছে এতিমখানার নাহিদ আর অনিকেত। মেধাবী নাহিদ অনিকেতের খপ্পরে পড়ে সামান্য অন্যায়ের শাস্তির মুখোমুখি হওয়ার ভয়ে এক রাতে বেরিয়ে পড়ে অজানার উদ্দেশে। তারা ওঠে অনিকেতের পরিচিত এক কাকির বাসায়। সেখানে নাহিদকে চিঠি দিয়ে আবারও অনিকেতের নিরুদ্দেশ যাত্রা। এরপর নাহিদকে কেন্দ্র করে আগায় উপন্যাসটি। যেখানে নাহিদের এগিয়ে চলার প্রেরণা ছিল অনিকেতের চিঠি।

নাহিদ এসএসসি পাস করে ওই কাকির বাসা থেকে চলে যায়। মেসে থেকে কলেজে পড়াশোনা করে। মেসে পরিচিত হয় মমিন ভাইয়ের সঙ্গে। এর মধ্যে লেখক হাফিজুল স্বয়ং উপন্যাসে হাজির হন। হাফিজুল আর নাহিদ একত্রে কলেজে পড়াশোনা করে। নাহিদসূত্রে লেখকের পরিচয় তাহিয়ার সঙ্গে। বিপদে উদ্ধারকারী কাকি মারা যাওয়ার পর তার মেয়ে তাহিয়া একা হয়ে পড়ে। তাহিয়াকেও পরবর্তীতে প্রাণ হারাতে হয় বখাটের হাতে; সে ঘটনায় নাহিদ ও হাফিজুল ব্যথা পান, প্রতিশোধ পরায়ণ হয়ে ওঠেন।

এভাবেই নিজ গতিতে হাঁটে উপন্যাসটি। হাঁটতে হাঁটতে আমরা আবিস্কার করি হাফিজুল ধীরে ধীরে নিজেকে মেয়ে থেকে গুটিয়ে নিচ্ছেন। উপন্যাসের পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহে মেয়েকে আর জড়াতে চান না। বিশেষ করে যখন জানতে পারেন মেয়ের অফিসের বসের জীবনকাহিনী হাফিজুলের সঙ্গে মিলে যাচ্ছে। কিংবা হাফিজুল যেন ধরা পড়ে যাচ্ছেন।

এভাবে উপন্যাসটির এক অসাধারণ কিন্তু মর্মস্পর্শী সমাপ্তি আছে। পাঠক হিসেবে হয়তো আমরা মেনে নিতে পারব না। কিন্তু লেখক সেটা হয়তো সযতনেই করেছেন কিংবা অবচেতন মনে চরিত্র সেখানে গিয়ে থেমেছে। ঘটনার ঘনঘটায় হাফিজুল যেখানেই দাঁড়াক, সেটাই একমাত্র বিবেচ্য নয়। আসলে উপন্যাস তো কেবল চরিত্র বিনির্মাণ, কাহিনী বুনন কিংবা সাবলীল বর্ণনাই নয়। বরং এর বাইরেও অনেক বিষয় থাকে। লেখক কীভাবে সময়কে ধারণ করেন। উপন্যাসটি কীভাবে ঘটনার বাইরের কথাও বলে। ঘটনার মধ্যেই দার্শনিক, সামাজিক, রাজনৈতিক, মনস্তাত্ত্বিক দিকও থাকে। বলাবাহুল্য, 'গল্পটি শুনতে চেয়ো না' উপন্যাসে তার অধিকাংশেরই উপস্থিতি রয়েছে। বর্ণনার দক্ষতা, চরিত্রের যথার্থতা কিংবা অসাধারণ কাহিনী যেমন রয়েছে এখানে একইসঙ্গে সচেতন পাঠকের কাছে বাইরের অনেক কিছুই ধরা পড়বে।

গল্প লিখে পরিচিতি পাওয়া লেখকের এটিই প্রথম উপন্যাস। যথেষ্ট সময় নিয়ে যে তিনি উপন্যাসে হাত দিয়েছেন তা বোঝা যায়। অবশ্য বাউণ্ডুলেপনা কিংবা কথায় কথায় ঘর ছেড়ে অজানার উদ্দেশ্যে বেরিয়ে যাওয়ার বিষয়টি একই উপন্যাসে যখন কয়েকজনের ক্ষেত্রে ঘটে, সেখানে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। তবে ব্যক্তিগত জীবনে প্রতিষ্ঠিত সোহেল নওরোজ উপন্যাসটির মেধাবী নাহিদকে প্রতিষ্ঠিত করে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক পর্যন্ত বানিয়েছেন। যদিও শেষতক যে অপরাধের কারণে হাফিজুল বাড়িছাড়া হলেন, মেয়েকে চিরকুট দিয়ে তার চাকরি ছাড়তে বললেন। সেখানে হাফিজুলের অপরাধ কতটা আর কতটা সামাজিক পারিপার্শ্বিকতার- তা উপন্যাসটি না পড়ে বোঝা যাবে না।

ট্যাগঃ , , , ,

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।