![](https://mahfuzmanik.com/wp-content/uploads/2018/11/Rohingya-1024x576.jpg)
মূল : মাইকেল বসিরকিউ
বাংলাদেশের কক্সবাজারের কাছে রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবির কুতুপালংয়ে বিদেশি সাংবাদিক ও আমাদের একটি দলের সঙ্গে আলাপকালে জামিলা মিয়ানমার থেকে পালানোর অভিজ্ঞতা বলছিলেন। জামিলা বলেছেন, গত বছরের আগস্টে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে যখন সেনাবাহিনীর পোশাক পরিহিতরা তাদের গ্রামের ওপর হামলা করে তার স্বামী ও পুত্রকে হত্যা করে, তখন তিনি পালিয়ে আসেন। 'এখানে আসতে আমার ১৫ দিন সময় লাগে'- তার শিশুকে বুকে জড়িয়ে নিয়ে হাজির হন এ আশ্রয়কেন্দ্রে। সুফিয়া বলেছেন, 'আমি কেবল তখনই ফিরে যাব, যখন মিয়ানমারে স্থিতাবস্থা তৈরি এবং সেখানে আশ্রয়ের নিরাপত্তা দেওয়া হয়।'
আশ্রয় শিবিরে আশ্রয় নেওয়া তিন সন্তানের জনক হাফিজও বলেছেন, তিনি তখনই মিয়ানমার ফিরে যাবেন, যখন কর্তৃপক্ষ তাদের পূর্ণ নাগরিকত্ব প্রদান করবেন।
তাদের গল্প আসলে সাত লাখ রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীরই প্রতিচ্ছবি। যারা গত বছরের আগস্ট মাসের শেষ দিক থেকে তাদের ভাষায় অবর্ণনীয় সহিংসতার মধ্য দিয়ে রাখাইন থেকে বাংলাদেশে আসে। ফলে তাদের প্রত্যাবাসন একটি বড় চ্যালেঞ্জ।
মিয়ানমারে অবাঞ্ছিত রোহিঙ্গারা আশ্রয় নিয়েছে বাংলাদেশে। রাখাইনে এখন সংখ্যালঘুদের খুব অল্পই রয়েছে। এখন এ অঞ্চলের সবার উচিত, একটি টেকসই সমাধানের দিকে এগোনো। এ ক্ষেত্রে নেতৃত্ব দিতে হবে বাংলাদেশকেই। কারণ বাংলাদেশেই সবচেয়ে বেশি রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী আশ্রয় নিয়েছে। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিশ্ব নেতৃত্বের কাছে সে দাবি জানিয়েছেন। শেখ হাসিনার ভূমিকার কারণে তার সমর্থকরা তাকে 'মাদার অব হিউম্যানিটি' হিসেবে আখ্যায়িত করেন। মানবাধিকার রক্ষায় তার ভূমিকার কারণে অনেকেই ৭১ বছর বয়সী এ নেত্রীকে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার দেওয়ার কথা বলছেন। তার সরকার রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়েছিল। তারা হয়তো ভেবেছিল, জাতিসংঘ যেভাবে মিয়ানমারের সহিংসতা 'জাতিসত্তা নির্মূল' হিসেবে চিহ্নিত করেছিল, হয়তো চাপে পড়েও তারা রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেবে। কিন্তু বাস্তবতায় এখনও সে পরিবেশ তৈরি হয়নি। ডিসেম্বরে বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। এ নির্বাচনে শেখ হাসিনা বিজয়ী হওয়ার প্রত্যাশা করছেন। জিতলে নতুন বছরে রোহিঙ্গাদের স্থানান্তর দ্রুত হওয়ার আশা রয়েছে।
রয়টার্সের তরফে জানা যাচ্ছে, কিছু বাংলাদেশি কর্মকতা বলেছেন, এক লাখ রোহিঙ্গা কক্সবাজার থেকে ভাসানচরে স্থ্ানান্তর হতে পারে। ভাসানচর বঙ্গোপসাগরের একটি দ্বীপ। দাতা সংস্থাগুলো অবশ্য সেখানে স্থানান্তরের ক্ষেত্রে বন্যা, ঘূর্ণিঝড়সহ প্রাকৃতিক দুর্যোগের ভয় করছে। 'সেটা এক ধরনের কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পের মতো। কারণ, কেউই সহজে স্থান ত্যাগ করতে পারবে না'- ইউনিসেফ বাংলাদেশের অ্যালাস্টার লওসন টানক্রেড আমাকে বলেছিলেন। ইউনিসেফের আরেকজন কর্মকর্তা জ্যা জ্যাক সিমন ব্যাখ্যা করেছেন, এ রকম বিচ্ছিন্ন দূরবর্তী দ্বীপে দাতা সংস্থাগুলো মানবিক সাহায্য নিয়ে কীভাবে পৌঁছবে। সেখানে ত্রাণ সহায়তা পৌঁছানো আমাদের জন্য সত্যিই জটিল হয়ে পড়বে।
এদিকে কক্সবাজারে রোহিঙ্গাদের কারণে স্থানীয়দের মধ্যে অসন্তোষ বাড়ছে। অক্টোবরের শুরুতে কক্সবাজার সফরের সময় সরকারি কর্মকর্তারা আমাদের বলেছেন- অসন্তোষের কারণ হলো, দেশের মধ্যে অনেক অনুন্নত এলাকার মানুষের চেয়েও কোনো কোনো ক্ষেত্রে রোহিঙ্গা শরণার্থীরা উন্নত জীবনযাপন করছেন। কর্মকর্তারা এও বলেছেন, স্থানীয় মানুষরা আরও বেশি উত্তেজিত এ কারণে, যে স্থানটি ছিল গাছগাছালিতে ভরপুর, হাতি এখানে ঘুরে বেড়াত; সে জায়গাটি এখন পরিণত হয়েছে বিশ্বের সবচেয়ে বড় শরণার্থী শিবির হিসেবে।
বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আমাকে বলেছেন, প্রায় ছয় হাজার রোহিঙ্গা স্বেচ্ছায় মিয়ানমার যেতে রাজি হয়েছে। যদিও এখানকার স্বেচ্ছাসেবী ত্রাণ কর্মকর্তারা বলেছেন ভিন্ন কথা; যেমন- লওসন টানক্রেড বলেছেন 'আমরা দেখেছি বর্তমান অবস্থায় কোনো রোহিঙ্গা তাদের দেশে ফেরত যেতে রাজি নয়।' কূটনৈতিক ও সাংবাদিক যারা রাখাইন গেছেন, তারাও এ কথায়ই সমর্থন দিচ্ছেন- রাখাইনে যেখানে রোহিঙ্গারা থাকত, তাদের অনেক ঘরবাড়িই ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে। মিয়ানমার সরকার অবশ্য যারা বাংলাদেশ থেকে ফিরবে, তাদের জন্য সীমান্তে একটি অভ্যর্থনা কেন্দ্র বানিয়েছে। কিন্তু রোহিঙ্গাদের দাবি অনুযায়ী দুটি জিনিস তথা নিরাপত্তা ও পূর্ণ নাগরিক অধিকারের নিশ্চয়তা রয়েছে সামান্যই।
এ অবস্থায় বিশ্ব সম্প্রদায়ের উচিত হবে, বিকল্প নিরাপদ কোনো দেশ বের করা, যেমন কানাডা। কানাডায় ইতিমধ্যে কিছুসংখ্যক রোহিঙ্গা রয়েছে। বিশেষ করে যারা খুব অসহায় অবস্থায় ছিলো, যেমন অসুস্থ ও সন্তানহারা। এটি অবশ্য এখন আলোচনার টেবিলে রয়েছে। কানাডার তরফ থেকে জানা যাচ্ছে, বাংলাদেশ রোহিঙ্গাদের বিদেশে যাওয়ার বিষয়টি অনুমোদন করছে না এ জন্য যে, এখনও যারা রাখাইনে রয়েছে, তারা এখানে চলে আসতে পারে। তবে সার্বিক বিবেচনায় হয়তো বাংলাদেশ বিষয়টি বিবেচনা করবে।
দ্বিতীয়ত, রোহিঙ্গাদেরই বাংলাদেশের অর্থনীতিতে অবদান রাখার জন্য তৈরি করা, যদিও বিষয়টিতে বাংলাদেশ রাজি নয়। আমরা মনে করি, কক্সবাজারেই তাদের জন্য একটি বিশেষ অর্থনৈতিক জোন তৈরি করে, তাদের প্রশিক্ষণ দিয়ে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে অবদান রাখার মতো অবস্থা তৈরি করা যায়। বিশেষ করে, যেখানে ৭ শতাংশ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির দেশ বাংলাদেশ ২০৩০ সালের মধ্যে ২৬তম বড় অর্থনীতির দেশ হতে যাচ্ছে, সেখানে দেশটির এ রকম জনশক্তির প্রয়োজন হবে।
রোহিঙ্গারা দশকের পর দশক ধরে মিয়ানমারের নির্মম নীতির শিকার হয়ে নির্যাতিত হয়ে আসছে। এ নির্দয় ও অন্যায্য নীতির কারণে তারা না পারছে মিয়ানমারকে নিজ দেশ বলতে, না পারছে শান্তি ও নিরাপদে থাকতে। এখনই সময় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের এগিয়ে আসা। বিশ্বের সবচেয়ে নির্যাতিত, নিগৃহীত ও রাষ্ট্রহীন জনগোষ্ঠীকে রক্ষা করতে, তাদের সক্ষম ও উৎপাদনমুখী করতে এবং সর্বোপরি মানবজাতি হিসেবে তাদের জীবনের সম্মান ফিরিয়ে দিতে সবার ঐকমত্য হওয়া খুব জরুরি।
- সিএনএন থেকে ভাষান্তর মাহফুজুর রহমান মানিক
- সমকালে প্রকাশিত, ১ নভেম্বর ২০১৮
- ই-সমকাল হতে দেখুন
- লেখক : আন্তর্জাতিক বিশ্নেষক ও সাবেক মুখপাত্র অর্গানাইজেশন ফর সিকিউরিটি অ্যান্ড কোঅপারেশন ইন ইউরোপ
- ছবি: অনলাইন