চারদিক লোকে লোকারণ্য। যেখানেই যাওয়া যাক মানুষের ভিড়ে লম্বা লাইনে দাঁড়ানো কিংবা হারিয়ে যাওয়ার অবস্থা। শহরে তো গিজগিজ করছে মানুষ; বাসে পা ফেলার জায়গা নেই; হাসপাতালে মানুষের অভাব নেই; ব্যাংকে লম্বা লাইন; রেস্টুরেন্টে বসার জায়গা নেই। সর্বত্র মানুষ আর মানুষ। অথচ এই মানুষের ভিড়ে আমরা ভীষণ একাকী। সবাই দৌড়াচ্ছে, যে যার কাজে, পাশের জনকে দেওয়ার মতো সময় নেই; প্রতিবেশীর খোঁজ নেওয়ার ফুরসত নেই; রাস্তায় বিপদে পড়া মানুষের সাহায্যে আসার অবস্থা নেই। স্ত্রী-সন্তানকে সময় দেওয়ার অবকাশ ও প্রিয় মানুষকে কাছে পাওয়ার উপায় নেই। সবাই চলছে যে যার মতো। এই একাকিত্বে বয়সেরও বালাই নেই।
আমরা ভাবি, হয়তো বৃদ্ধ, পঁচাত্তরোর্ধ্ব মানুষই একাকিত্ব বোধ করে। কিন্তু না; ১ অক্টোবর বিবিসি প্রকাশিত এক জরিপ প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ১৬ থেকে ২৪ বছর বয়সীরাই বেশি একাকী থাকে। 'আই অ্যাম সারাউন্ডেড বাই পিপল, বাট ফিল সো লোনলি।' অর্থাৎ আমার চারপাশে মানুষ, কিন্তু আমি ভীষণ একাকিত্ব বোধ করি- শিরোনামে বিবিসির ওই প্রতিবেদনটি মূলত বিশ্বব্যাপী দুই শতাধিক দেশের মানুষের ওপর করা জরিপের ফল। বিশ্বব্যাপী ৫৫ হাজার মানুষের ওপর করা এই জরিপটি এমন দিনে প্রকাশ হলো, যেদিন ছিল বিশ্ব প্রবীণ দিবস। সমাজে নানাভাবে প্রবীণরা উপেক্ষিত। নানা কারণে তাদের অনেক সময় একাকিত্বে কাটাতে হয়। আমাদের পূর্বসূরি শ্রদ্ধেয় মানুষের প্রতি সবার কর্তব্য আছে, সেটা ঠিক। কিন্তু বিবিসি যেটা দেখাচ্ছে, আমাদের নতুন প্রজন্মই বেশি একাকিত্বে ভুগছে। সেটা একটি সংকেতও বটে।
অনেক সময় ১৬-২৪ বছরের ছেলেমেয়েরা অন্যের সঙ্গে বিভিন্ন বিষয় শেয়ার করতে পারে না। তার প্রয়োজন, আবেগ-অনুভূতি পরিবার-নিকটাত্মীয়দেরও খোলাখুলি বলতে পারে না। আবার শহুরে পরিবেশে হয়তো মা-বাবাই তার সন্তানের জন্য প্রয়োজনীয় সময় বের করতে পারেন না। ফলে বিবিসি দেখাচ্ছে, এই বয়স গ্রুপে সর্বোচ্চ ৪০ শতাংশ বলছে, তারা প্রায়শ একাকিত্ব বোধ করে।
এর পর একাকিত্ব বোধ করে ৩৫-৪৪ বয়স গ্রুপের মানুষ। একেবারে কর্মক্ষম এ বয়সে একাকিত্বের একটা কারণ হতে পারে কাজের চাপ কিংবা ব্যস্ততা। এ সময় অনেকেই অফিস-প্রতিষ্ঠানে গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকেন। অনেক কাজের ভার ব্যক্তির ওপর ন্যস্ত থাকে। ফলে এর বাইরে তার চিন্তা করা, অন্যদের সময় দেওয়ার সুযোগ কম থাকে। বলা বাহুল্য, ১৬ থেকে ৭৫ বয়স পর্যন্ত সবাই একাকিত্ব বোধ করে। একাকিত্বের হারও ৩০-এর নিচে নয়। এর মধ্যে জরিপ বলছে, পঁচাত্তরোর্ধ্ব প্রবীণরাই বরং ভালো অবস্থানে, যাদের একাকিত্বের হার ৩০ ছুঁই ছুঁই। এ অবস্থায় যারা সক্ষম একাকিত্ব ঘোচাতে, তারা নানা সৃজনশীল কাজ করেন। উন্নত বিশ্বে বিশেষত তারা লেখালেখি, ছবি আঁকা, কম্পিউটারে ব্যস্ত থেকে সময় পার করেন। আজকাল ফেসবুকেও প্রবীণরা সময় দিচ্ছেন। অনেকের ধারণা, দিনে দিনে ফেসবুক বা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম একদিন বয়স্কদের সময় কাটানোর বড় ক্ষেত্র হয়ে উঠবে। তাই এটা বলাই যায়, শেষ বয়সে যখন চাকরি থেকে অবসর নেন বা কারও জীবনসঙ্গী-সঙ্গিনী মারা যান কিংবা সন্তানরা দূরে থাকে, তখন এটি তাদের একাকিত্বকে কিছুটা হলেও ঘোচাচ্ছে বা ঘোচাবে।
সমস্যাটা আসলে তরুণ প্রজন্ম বা আমাদের নিয়েই, যাদের জীবনের অনেক সময় পড়ে আছে। প্রত্যেক মানুষই কাঙ্ক্ষিত সঙ্গী চায়। একাকিত্ব হয়তো সম্পূর্ণ ঘোচানো সম্ভব নয়। তারপরও প্রত্যেকের উচিত তার প্রিয় মানুষ, পরিবার, সন্তান, বাব-মাকে সময় দেওয়া। প্রত্যেকের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তোলা। তাহলে এ সমস্যার অনেকটা সমাধান সম্ভব। আর হ্যাঁ, বিবিসি একটা বিশেষ বিষয়ে কথা বলেছে। যারা দৃষ্টিজয়ী, বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন, তারা বেশি একাকিত্ব বোধ করে। তাদের প্রতিও দৃষ্টি দেওয়া প্রয়োজন।