দৈনন্দিন যাতায়াতে ঝামেলাহীন, নিরাপদ ও স্বাস্থ্যসম্মত বাহন সাইকেল। যারা যানজট এড়াতে চান, যারা গণপরিবহনে অতিষ্ঠ, এমনকি সময়ও বাঁচাতে চান, তাদের জন্য আদর্শ যান বাইসাইকেল। খরচ বাঁচাতেও পরিবেশসম্মত এ যানটির বিকল্প নেই। পৃথিবীতে সাইকেলের স্বর্গ নেদারল্যান্ডস। বুধবার (১৬ মে) ব্রিটিশ পত্রিকা গার্ডিয়ানে সেটিই লিখেছেন কাইলি ভ্যান ড্যাম, 'ওয়েলকাম টু সাইকেল হ্যাভেন: হোয়াই উই মুভড আওয়ার ফ্যামিলি টু দ্য নেদারল্যান্ডস' যাকে লেখা যায়- যে কারণে আমরা পারিবারিকভাবে সাইকেলের স্বর্গ নেদারল্যান্ডসে চলে আসি। সাইকেলবান্ধব শহর খুঁজতে খুঁজতে ব্রিটেন থেকে এ নারী আসেন নেদারল্যান্ডসের হাউটেনে। হাউটেন উট্রেখট প্রদেশের একটি উপশহর। তিনি লিখেছেন, তার ১৫ বছরের মেয়ে সাইকেল চালিয়ে স্কুলে যায়। আট ও ১৩ বছরের অপর দুই সন্তানও সাইকেল চালায়, বন্ধুদের সঙ্গে খেলতে যায়। সেখানে শিশুরা হাঁটতে শেখার সঙ্গে সঙ্গেই সাইকেল চালানো শেখে, গড়ে প্রত্যেক ঘরে সাইকেল সংখ্যা ৩.৪। শহরটিকে আসলে এভাবেই সাজানো হয়েছে। যেখানে সাইকেল আর হাঁটার পথকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। সেখানে গাড়িকে বরং নিরুৎসাহিত করা হয়, ইচ্ছাকৃতভাবেই গাড়ির গতি নির্ধারিত করে দেওয়া হয়েছে। এমনকি কোথাও যেখানে দুই মিনিটে সাইকেলে বা হেঁটে যাওয়া যায়, সেখানে গাড়ির পথে লাগে দশ মিনিট!
অন্য সূত্রও বলছে, এই নেদারল্যান্ডস বা হল্যান্ডই বিশ্বের সবচেয়ে সাইকেলবান্ধব দেশ, যেখানে প্রায় ৯৯ শতাংশ মানুষেরই সাইকেল আছে। স্বল্প দূরত্বে অধিকাংশ কাজই তারা সাইকেলে করেন। কেবল নেদারল্যান্ডস নয় ডেনমার্ক, জার্মানি, সুইডেন, নরওয়ে, ফিনল্যান্ড, জাপানের মতো উন্নত বিশ্বের অনেক দেশেই সাইকেল বহুল ব্যবহূত। সেখানে সাইকেলের আলাদা লেন আছে। মানুষকে সাইকেলের জন্য উৎসাহিত করা হয় এবং উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা থেকে শুরু করে সর্বস্তরের মানুষ স্বতঃস্ম্ফূর্তভাবে সাইকেল ব্যবহার করেন। এমনকি আমেরিকা ও ইউরোপের কোনো কোনো শহরে বিশেষ বিশেষ রাস্তায় সপ্তাহের নির্দিষ্ট দিনে সাইকেল ছাড়া অন্য যান চলাচল নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
আমাদের দেশেও সাইকেলের ব্যবহার যে একেবারে কম, তা নয়। শহরের তুলনায় গ্রামের দিকে বরং সাইকেল বেশি দেখা যায়। শহরেও বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মের মধ্যে সাইকেলের কদর বাড়ছে। দৈনন্দিন ব্যবহারের বাইরে নানা সাইক্লিস্ট গ্রুপও আমরা দেখছি। তারপরও কাঙ্ক্ষিত নয়। সমস্যা হলো সাইকেল চালানোর আলাদা লেন নেই। সাইকেলকে এখানে উৎসাহিত করা হয় না। এমনকি অনেক ক্ষেত্রে সাইকেলকে 'সাধারণের' বাহন হিসেবেও দেখা হয়। ফলে আমরা সাইকেলের চেয়ে সম্প্রতি মোটরসাইকেলের সংখ্যা বেশি দেখছি। আবার এখন রাইড শেয়ারিং অ্যাপ আসার কারণেও বাড়ছে মোটরসাইকেলের সংখ্যা।
এটা হয়তো ঠিক, আমাদের সে রকম অবকাঠামো নেই, যথেষ্ট রাস্তা নেই। ইউরোপের সঙ্গে আমাদের নানাদিক থেকেই ভিন্নতা রয়েছে। তারপরও আমাদের সীমাবদ্ধতা নিয়ে কি আমরা পারি না? রাস্তাঘাটে সাইকেল আরোহীদের বাস, ট্রাক, মোটর-বাইকের দাপটে কোণঠাসা থাকতে হয়। সাইকেল রাখার নিরাপদ জায়গার অভাবে অনেকেরই সাইকেল চুরি হয়। অনেকে আবার সাইকেল চালাতে দেখে 'নাক সিঁটকায়'। এ জন্য সর্বাগ্রে আমাদের মানসিকতার পরিবর্তন জরুরি। পাশাপাশি নীতিগতভাবেও সাইকেলকে উৎসাহিত করা দরকার। ঢাকা শহরে দিন দিন যানজট যেমন বাড়ছে, তেমনি মানুষও বাড়ছে। বাড়ছে যানও। এ ক্ষেত্রে সাইকেল সংখ্যা বাড়লে নিশ্চয়ই গণপরিবহনের ওপর কিছুটা হলেও চাপ কমবে।
জলবায়ু পরিবর্তন ও বায়ুদূষণ রোধে উন্নত শহরগুলো যখন সাইকেলকে আরও বেশি উৎসাহিত করছে, তখন আমাদেরও ভাবার সময় এসেছে। আমরা দেখেছি, ভারতের বিভিন্ন শহরে সাইকেল নিয়ে আন্দোলন শুরু হয়েছে। সর্বশেষ পরিবেশ সম্মেলনেও সাইকেল নিয়ে অনেক আলোচনা হয়েছে। আমাদের সরকারও নিশ্চয়ই এ নিয়ে ভাববে। হাজার হাজার কোটি টাকার মেট্রোরেল কিংবা ফ্লাইওভার প্রকল্পের পাশাপাশি সাইকেলকেন্দ্রিক চিন্তাও দরকার।