Mahfuzur Rahman Manik
জাতীয় শিক্ষানীতি
মার্চ 24, 2010

জাতীয় শিক্ষানীতি-২০০৯ এর খসড়া প্রকাশিত হয়েছে গত বছরের ২ সেপ্টেম্বর। পরামর্শের আলোকে এ বছরের জানুয়ারিতেই শিক্ষানীতি চূড়ান্ত হওয়ার কথা ছিলো। জানুয়ারি, ফেব্রুয়ারি শেষ হয়ে মার্চও শেষ হওয়ার পথে। এখনও শিক্ষানীতি চূড়ান্ত হয়নি। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর, ১৯৭৩ এর কুদরত-এ-খুদা শিক্ষা কমিশনসহ অনেক শিক্ষা কমিশন গঠিত হয়েছে, কমিটি প্রতিবেদনও পেশ করেছে, কার্যত এ প্রতিবেদন বাস্তবে ফলেনি। এরপরও বর্তমান সরকার ক্ষমতায় এসে করলো ‘জাতীয় শিক্ষানীতি-২০০৯। এ শিক্ষানীতির প্রয়োজনীয়তাটা কী। মৌলিকভাবে যদি শুধু শিক্ষানীতির প্রশ্নে আসি, কী প্রয়োজন একটি শিক্ষানীতির? আমাদের শিক্ষাতো জগাখিচুড়ি বলি আর যাই বলি এক রকম চলছেই। এর আর নীতির কী আছে?উত্তরটা শিক্ষানীতির নাম পড়লেই স্পষ্ট হয়। আমাদের শিক্ষানীতির নাম ‘জাতীয় শিক্ষানীতি’। অর্থাৎ আমরা একটি জাতি, বাংলাদেশ নামক একটি রাষ্ট্রের নাগরিক। এ রাষ্ট্রটি তার স্বাতন্ত্র্যবোধ থেকে, তার জাতির জন্য শিক্ষার একটি নীতি প্রণয়ন করছে। শিক্ষার এ নীতি রাষ্ট্র করছে তার জাতিকে টিকিয়ে রাখতে। ঠিক এ প্রশ্নে অর্থাৎ জাতীয় ও জাতীয়তার প্রশ্নে জাতীয় শিক্ষানীতি ২০০৯ কতটা আন্তারিক বা আমাদেও রাষ্ট্র যে ধরনের জাতি গড়তে চাচ্ছে, সে জাতি গড়তে এ শিক্ষানীতির নির্দেশনা, লক্ষ্য উদ্দেশ্য, কর্মসূচি কী-সেটাই এখন দেখা যাক।স্বাভাবিকভাবেই শিক্ষানীতির সূচনায় জাতীয়তার বিশ্লেষণ আসার কথা, কিন্তু সূচনাতে ভূমিকা শিরোনামে তিন পৃষ্ঠার বয়ানে চোখে পড়ার মত সে রকম কিছুই নেই। আছে কিছুটা রাজনৈতিক বয়ান, কমিটির কাজের বয়ান আর কিছু আপ্ত বাক্য (গণতান্ত্রিক উপযুক্ত মানসম্মত শিক্ষা ব্যবস্থা নির্মাণ, আইনের শাসন, মানবাধিকার, সুশাসন, প্রতিযোগিতাপূর্ণ পৃথিবীতে যোগ্য হয়ে টিকে থাকা ইত্যাদি)ভূমিকার পর যে শিক্ষানীতি করা হলো তার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য থাকাই ছিল যথার্থ্য, বাস্তবে শিক্ষানীতির লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যেও বর্ননা না দিয়ে অধ্যায় -১ শিরোনামে দেয়া হলো শিক্ষার উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য, ধরে নেয়া যাক এটিই শিক্ষানীতির উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য। এখানে উদ্দেশ্য হিসেবে কতগুলো গুণের কথা বলা হয়েছে-মননশীল, যুক্তিবাদী, নীতিবান, কুসংস্কারমুক্ত, পরমত সহিষ্ণু, দেশপ্রেমিক ইত্যাদি গুণ সমৃদ্ধ নাগরিক তৈরি।নীতি হিসেবে শিক্ষানীতিতে সেক্যুলার, গনমুখী, সুলভ, সুষম, সার্বজনীন, সুপরিকল্পিত এবং মানসম্মত শিক্ষাব্যবস্থা দেয়ার কথা বলা হয়েছে। এখানে মোট ২৮ টি লক্ষ্য-উদ্দেশ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। বলা হয়েছে মুক্তিযুদ্ধেও চেতনায় অনুপ্রাণিত, জাতীয় ইতিহাস ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির ধারার প্রজন্ম ইত্যাদি। এগুলো ‘জাতীয়’ কথাটিকে প্রতিনিধিত্ব কওে বটে কিন্তু কোনটাই, পূর্ণাঙ্গ, সুস্পষ্ট এবং বিস্তারিত আসেনি। বর্ণনা এতো ঢিলেঢালা মনে হয় (আপাত দৃষ্টিতে) এগুলো না হলেও চলে। নীতির কথায় আসা যাক। অবশ্য এ নীতির কথা আগেই কিছুটা এসেছে। প্রথম বিষয়টা হলো জাতীয় শিক্ষানীতি হিসেবে জাতির নীতি বা জাতীয়তার নীতি আসেনি। গোটা শিক্ষানীতির ২৯ টি অধ্যায় আর সাতটি সংযোজনীর মধ্যে সবগুলো বিষয়ই নীতির প্রশ্নে যৌক্তিক হওয়া ছিলো বাস্তবতা। কিন্তু শিক্ষানীতিতে এমন কিছু বিষয়ের অবতারণা করা হয়েছে যেসব বিষয় নীতির বাইরে স্রেফ কর্মসূচি হিসেবে আনা যায়। ভালোভাবে দেখলে মনে হবে এটি শিক্ষানীতি না হয়ে শিক্ষাকর্মসূচি হয়ে গেছে। জাতীয়তার প্রশ্নতো আগেই উধাও। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জাতীয়তাকে যদি আমরা টিকিয়ে রাখতে চাই, বা জাতি হিসেবে একজাতি উপহার দিতে চাই এখানে শিক্ষার বিভিন্ন ধারা থাকবে কেন? কেনইবা আলাদে স্রোতে মাদ্রাসা আর ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল থাকবে। আমাদের জাতিকে কোথায় দাঁড় করাতে চাই, রোডম্যাপ কী ইত্যাদি বিষয় না এসে শুধু একুশ শতকের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় তৈরি এ মুখস্ত বুলিই আওড়ানো হয়েছে।স্বাধীনতা পরবর্তী কুদরাত-এ-খুদা শিক্ষা কমিশন ছিলো জাতীয়তার প্রশ্নে কিছুটা আন্তরিক। এ কমিশন তার প্রতিবেদনের অধ্যায় এক এ শিক্ষার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যাবলী শিরোনামে যে আলোচনা করেছে, সেখানে তখনকার সংবিধানের মূলনীতির আলোকে জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গনতন্ত্র এবং ধর্মনিরপেক্ষতার বিষয়টি ভালোভাবে বলতে চেয়েছে। সাথে সাথে কেমন নাগরিক গড়তে চায় তার আলোচনাও সেখানে মোটামুটি স্পষ্ট। আর শিক্ষানীতির নীতির কথা বললে এর আগের মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান মিয়া শিক্ষা কমিশন-২০০৩ প্রথমেই স্পষ্ট করেছে। ২০০৩ এর এ কমিশন রিপোর্টেও শুরুতেই এসেছে মৌলিক নীতিসমূহ শীর্ষক শিরোনাম। সেখানে নীতির প্রশ্নে শিক্ষার মূল লক্ষ্য কী হবে, শিক্ষার সুযোগ কারা পাবে, শিক্ষার গুণগত মান কেমন হবে, বিদ্যালয়ে ভর্তিও বয়স কত হবে, শিক্ষা কাঠামো কী হবে, উচ্চ শিক্ষা কেমন হবে, ভাষা নীতি কী হবে ইত্যাদি ৩০ টি মৌলিক নীতি এসেছে।এবারের শিক্ষানীতির মৌলিক সংস্কার বলা যায় স্তর বিন্যাস। বিদ্যমান শিক্ষাস্তর চারটি (প্রাথমিক, মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক এবং উচ্চশিক্ষা) কে ভেঙ্গে এ শিক্ষানীতি তিনটি স্তরের সুপারিশ করেছে। নতুন স্তর বিন্যাস হলো প্রাথমিক, মাধ্যমিক এবং উচ্চশিক্ষা। এর সাথে প্রাথমিকের আগে যোগ করেছে প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষাকে। আগের প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণীর প্রাথমিক শিক্ষা হবে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত। মাধ্যমিক শিক্ষা এখন নবম শ্রেণী হতে দ্বাদশ শ্রেণী পর্যন্ত। এরপর উচ্চশিক্ষা আগের মতই থাকছে।এ স্তরবিন্যাস শিক্ষানীতির বিরাট চ্যালেঞ্জ বটে তবে প্রাথমিক শিক্ষায়, এ শিক্ষানীতি রচনার আগে এবং রচনাকালে যে একমুখী শিক্ষার ব্যাপক তোড়জোড় শোনা গিয়েছিলো এবং শিক্ষানীতি কমিটির যে গর্জন ছিলো বিষয়ে অন্তত বর্ষণটা তেমন ছিলো না। সমন্বয়ের জন্য মাদ্রাসা শিক্ষার কথা আসলেও আসেনি ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের কথা।মাধ্যমিক শিক্ষাকে দ্বাদশ শ্রেণী পর্যšত্ম করে, বৃত্তিমূলক শিক্ষা করার একটা প্রয়াস লক্ষ্য করা গেছে, যাতে শিক্ষার্থীরা উচ্চশিক্ষা অর্জন না করেও এ স্তরের পরই কর্মজীবনে প্রবেশ করতে পারে। তবে আগের মতই মাধ্যমিক স্তরের সূচনা থেকেই বিভাজন অর্থাৎ বিজ্ঞান, মানবিক এবং ব্যবসায় শিক্ষায় ভাগ করা হয়েছে। এরপর শিক্ষানীতি উচ্চশিক্ষায় যাওয়ার আগে বৃত্তিমূলক ও কারিগরি শিক্ষা, মাদরাসা শিক্ষা ধর্ম ও নৈতিক শিক্ষার বিষয়ে আলোকপাত করেছে।তিন মাসের মধ্যে তাড়াহুড়ে করা শিক্ষানীতি সবকিছুর সন্নিবেশ ঘটালেও সবই পুরনো প্যচাল।তবুও আগেকার শিক্ষা নীতি/কমিশনগুলোর অবস্থান যে হিমাগারে সেখানে এটি যাবেনা, নীতি, জাতীয়তা, বিশ্বায়ন, ভবিষ্যতকে সামনে রেখে এটি চুড়ান্ত করে বাস্তবায়নের কাজে হাত দেয়া যেতে পারে।

দৈনিক ডেসিটিনতে প্রকাশিত ২৪ মার্চ ২০১০

ট্যাগঃ

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।