চলার পথে আমাদের কত কিছুই না হারিয়ে যায়। তা পাওয়ার আশা আমরা কতটুকই-বা করতে পারি। প্রিয় মোবাইল হারিয়েছে কতজন, দীর্ঘদিন ব্যবহারের ছাতাও হয়তো ভুলে রেখে আসেন কত জায়গায়। যে কোনো হারানো বস্তু ফিরে পাওয়া কতটা আনন্দের বলার অপেক্ষা রাখে না। আমাদের দেশে এসব ফিরে পাওয়া আশ্চর্যের মনে হতে পারে; কিন্তু জাপানে যে এটাই বাস্তব।
২৩ জুলাই রোববার কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আলজাজিরায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনের শিরোনাম, 'লস্ট ইউর ফোন ইন জাপান? ইউ উইল প্রোবাবলি গেট ইট ব্যাক' অর্থাৎ জাপানে কি আপনি মোবাইল হারিয়েছেন? সম্ভবত আপনি তা ফিরে পাচ্ছেন। জাপান সত্যিই তা পদ্ধতিগতভাবে সম্ভব করেছে। প্রতিবেদনটি শুরু হয়েছে একটি ঘটনা দিয়ে। এক কিশোরী জাপানের সবচেয়ে বড় জীবন্ত আগ্নেয়গিরি মাউন্ট এসোর কাছে ছবি তুলতে গিয়ে মোবাইল পড়ে গেছে বলে এ বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে পুলিশের কাছে জানিয়েছে। দুই মাস পর মোবাইলটি পাওয়া গেছে বলে পুলিশের চিঠি পেল কিয়োটোতে থাকা কিশোরী। এক পরিব্রাজক মোবাইলটি পুলিশের কাছে জমা দিয়েছেন, তার স্ক্রিনটি কেবল ভাঙা ছিল। মোবাইল, মানিব্যাগ, ক্যামেরা, চাবি, ছাতা ইত্যাদি হারানোর পর জাপানে অধিকাংশই পাওয়া যায়। এক অধ্যাপক তাই বলছেন, যাদের হারানোর অভ্যাস তাদের স্বর্গ জাপান। জাপানের সর্বত্র ছড়িয়ে আছে 'কোবান' নামে ছয় হাজারের মতো পুলিশ বক্স। কেউ কিছু পেলে সেখানে জমা দেয়। ২০১৬ সালে টোকিও পুলিশ এ রকম তিন কোটি ২০ লাখ ডলার ও প্রায় চার লাখের মতো হারানো জিনিসপত্র পেয়েছে।
জাপানের নাগরিকদের এ বিষয়টি ছোট থেকেই শেখানো হয়, এমনকি কোনো শিশুও যদি এক ইয়েন বা পাঁচ ইয়েন পায়, তা পুলিশ বক্সে জমা দেয়। পুলিশও তখন বলে, তুমি এক মহান কাজ করেছ, এতে তার উৎসাহ আরও বাড়ে। অবশ্য পুলিশ বক্স হতে যারা হারানো জিনিস নেন, তারা সন্ধানদাতাকে ওই বস্তুর মূল্যের পাঁচ ভাগের এক ভাগ পুরস্কার হিসেবে দেন। এমনকি কখনও কখনও কোনো বস্তুর মালিক পাওয়া না গেলে তা সন্ধানদাতাকে দিয়ে দেওয়া হয়। সাধারণত পুলিশ বক্সে প্রাপ্ত জিনিসপত্রের তিন মাস পর্যন্ত কোনো দাবিদার পাওয়া না গেলে, নির্দিষ্ট কিছু দোকানে পুলিশ তা বিক্রি করে। দোকানিরা সে রকম মূল্যেই তা মানুষের কাছে বেচে।
জাপানে পুরো প্রক্রিয়াটি একটি নির্ধারিত পদ্ধতিতে সম্পন্ন হলেও এর পেছনে সবচেয়ে বড় বিষয় হলো সততা। সততা আছে বলেই সেখানকার মানুষ মূল্যবান কিছু পেয়ে তা নিজে ভোগ করার পরিবর্তে পুলিশ বক্সে জমা দিচ্ছে। এ রকম আমরা জানি, অনেক দেশেই সংবাদপত্র বিক্রি হয় বিক্রেতা ছাড়াই। মানুষ নির্দিষ্ট জায়গা থেকে পত্রিকা নিয়ে তার মূল্যও সেখানে রেখে যায়। অনেক দোকানও এভাবেই চলে।
আমাদের দেশেও বিষয়টি অকল্পনীয় নয়। আমাদের কোথাও কোথাও 'সততা স্টোর' রয়েছে, যেগুলো সফলভাবে চলছে। এমনকি এখানে বিক্রেতা ছাড়া পত্রিকাও বেচা হচ্ছে বলে খবর রয়েছে। আমাদের সিস্টেম ঠিক হলে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, প্রশাসন ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সৎ হলে মানুষও হতাশ করবে না। তখন কেবল হারিয়ে যাওয়া বস্তু পাওয়া তো সাধারণ বিষয়, হয়তো গোটা সমাজই ঠিক হয়ে যাবে।
- সমকাল সম্পাদকীয় বিভাগে প্রকাশিত, ২৪ জুলাই ২০১৭
- ই-সমকাল হতে দেখুন
- ছবি: আল-জাজিরা, অনলাইন