Mahfuzur Rahman Manik
সম্প্রীতির উদাহরণ

সব পথ, মত ও ধর্মের সহাবস্থান সামাজিক সম্প্রীতির অংশ। এ সম্প্রীতি রক্ষায় কিছু কিছু দৃষ্টান্ত অনুপ্রেরণার। সাম্প্রতিক উদাহরণ বোধ হয় ৪ জুন আনন্দবাজারে প্রকাশিত একটি খবর। 'রমজানে নিয়মিত রোজা রাখে এই হিন্দু পরিবার' শীর্ষক প্রতিবেদনটি বলছে কলকাতার বারাসাতের হিন্দু পরিবারটি কেবল রোজাই রাখে না, একটি মসজিদও দেখাশোনা করে। সেখানে জুমার নামাজ, রমজানে তারাবি-ইফতার সবই হয়। প্রতিবেদনটি বলছে, ৬৭ বছর বয়সী দীপক বসু নিজে রোজা রাখতে না পারলেও তার ছেলে নিয়মিত রোজা রাখেন। মসজিদে ইমামের সঙ্গে ইফতার করেন। দীপক বসুর আদি নিবাস আমাদের খুলনার ফুলতলার আলকাগ্রামে। ১৯৬৪ সালে পূর্ব পাকিস্তানে দাঙ্গার সময় কলকাতার বারাসাতের ওয়াজুদ্দিন মোড়লের বিশাল সম্পত্তি পাল্টাপাল্টি করে ওপারে চলে যান। সে জমির মালিকানায় মেলে একটি মসজিদ। মসজিদটি আজও বসু পরিবারটি রক্ষণাবেক্ষণ করে চলেছে। এমনকি আড়াই দশক আগে যখন উগ্র হিন্দুত্ববাদীরা অযোধ্যার বাবরি মসজিদ ভাঙে, তখনও বসু পরিবার পাহারা দিত যাতে মসজিদের গায়ে কোনো আঁচড় না লাগে। মসজিদটিতে কোনো অনুদান গ্রহণ করা হয় না। ২৭ রমজানে লাইলাতুল কদরে কোরআন পড়া সম্পূর্ণ হলে চাঁদা তুলে পাড়ার সবাইকে খাওয়ান রোজাদাররা।
প্রায় এ রকমই আরেক সম্প্রীতির প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে কলকাতার জোড়াসাঁকোর মার্বেল প্যালেস মসজিদ। মসজিদটি বাঙালি বাবুর মসজিদ নামে পরিচিত হলেও এটি রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে রয়েছে হিন্দু ট্রাস্ট। বিশেষভাবে বললে একটি হিন্দু পরিবার।
ভারতীয় সংবাদমাধ্যম সংবাদ প্রতিদিন ডট আইএন-এ প্রকাশিত 'কলকাতার মসজিদের রক্ষণাবেক্ষণে নিযুক্ত হিন্দুরা!' শীর্ষক প্রতিবেদনে এর বিস্তারিত রয়েছে। প্রতিবেদনটি বলছে, মলি্লক পরিবারের দেবোত্তর জমিতে তৈরি মসজিদটির বয়স ১৮১ বছর। মসজিদটি মলি্লক পরিবার দীর্ঘ সময় ধরে দেখাশোনা করে আসছে।
হিন্দুপ্রধান দেশ ও হিন্দুপ্রধান এলাকায় এ দুটি মসজিদ ও দুটি পরিবারের কাহিনী প্রেরণার। এ রকম দৃষ্টান্ত যুগে যুগে নানা জায়গায় আমরা দেখেছি। ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা হজরত ওমরের (রা.) সময়কার একটি ঘটনাও প্রাসঙ্গিক। ওমর (রা.) আলেকজান্দ্রিয়া বিজয়ের পর রাসূলের (সা.) সাহাবি হজরত আমর ইবনুল আসকে (রা.) সেখানকার দায়িত্ব দেন। তার সময়ে আলেকজান্দ্রিয়ায় একদিন কে বা কারা রাতের অন্ধকারে খ্রিস্টানদের গির্জায় প্রবেশ করে যিশুখ্রিস্টের মূর্তির নাক ভেঙে দেয়। তাই খ্রিস্টান পাদ্রিরা আমির আমর ইবনুল আসের (রা.) দরবারে অভিযোগ নিয়ে যান। ঘটনার বর্ণনা শুনে আমর ইবনুল আস ব্যথিত হলেন। তিনি বললেন, ব্যর্থতা আমারই। তাই এর দায়ভার আমাকেই নিতে দাও। কাল জুমার পরে ভরা মজলিস ও খোলা মাঠে ফয়সালা পাবে। পরের দিন সবাই উপস্থিত হলো। হজরত আমর ইবনুল আস (রা.) নিজের কোমরের তরবারি বের করে পাদ্রির হাতে দিয়ে বললেন, তোমরা আমার নাক কাট। পাদ্রি হতবাক হয়ে গেল। পাদ্রি যখন নাক কাটার জন্য অস্ত্র উপরে তুলল, ঠিক তখনই ভিড় ঠেলে এক মুসলিম সৈন্য এগিয়ে এলো। সে বলল, আমিই নাক ভেঙেছি। আমার আমির নির্দোষ। আপনি আমার নাক কাটুন। এভাবে মুসলমানরাও অন্য ধর্মাবলম্বীদের জানমাল-ইজ্জত-আব্রুর হেফাজত করেছে। আমাদের দেশে বিভিন্ন সময় কিছু দুর্বৃত্ত অন্য ধর্মাবলম্বীদের উপাসনালয় ভাঙাসহ কিছু ঘটনা ঘটালেও আমরা অধিকাংশই শান্তিপ্রিয়। অন্য ধর্মাবলম্বীদের ওপর নির্যাতনের মতো কাপুরুষতা আর নেই। মুসলিম-হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান সকলে মিলে আমরা সোনার দেশ চাই। ওপরের ঘটনা দুটি সে প্রেরণা দিচ্ছে। আর আমাদের নজরুল তো বলেই গেছেন_
গাহি সাম্যের গান_
যেখানে আসিয়া এক হয়ে গেছে সব বাধা-ব্যবধান
যেখানে মিশছে হিন্দু-বৌদ্ধ-মুসলিম-ক্রীশ্চান।

ট্যাগঃ , , , , ,

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।