Mahfuzur Rahman Manik
শিশু যখন চালকের আসনে

সিনেমার দৃশ্য হিসেবে হয়তো বিষয়টির চমক ছিল। বাস্তব বলেই তা ঘটনা হয়ে ওঠেনি, হয়েছে দুর্ঘটনা। গত ২৪ মের সমকালের খবর, 'ধানমণ্ডিতে শিশুচালকের গাড়িচাপায় শিশু আহত'। গাড়ির চালক তখন শিশুই ছিল, যদিও শিশুটি আসল চালক নয়। ধানমণ্ডি ১৫নং সড়কে চলছিল গাড়িটি। ছায়ানট ভবনের সামনে এসে হঠাৎ করে প্রাইভেটকারটি সড়কে চলাচলকারী দু'জনকে ধাক্কা দেয়। আহত দু'জন বাবা ও মেয়ে। বাবার আঘাত তেমন গুরুতর না হলেও চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ূয়া মেয়েকে স্থানীয় হাসপাতালে নিতে হয়েছে। উত্তেজিত জনতা যখন প্রাইভেটকার ভাঙতে উদ্যত, তখন জানা যায় মূল ঘটনা। দুর্ঘটনার সময় লালমাটিয়ার একটি বিদ্যালয়ে ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্র গাড়িটি চালালেও তার আসল চালক পাশেই ছিল। শিশুটি মালিকের ছেলে। ১১ বছরের শিশু তখন রাস্তা খালি দেখে গাড়ি চালানোর বায়না ধরে। চালক তার আবদার রক্ষায় তখন শিশুটিকে চালাতে দেয়। বলা বাহুল্য_ চালকের দাবি, গাড়ি চালানোর কিছুটা অভিজ্ঞতাও নাকি রয়েছে শিশুটির!
১১ বছর বয়সে শিশুর গাড়ি চালানোর অভিজ্ঞতা থাকে কীভাবে! তার প্রয়োজনই-বা কী? যেখানে বাংলাদেশের আইনে ১৮ বছরের নিচে কেউ ড্রাইভিং লাইসেন্স পেতে পারে না। একটি শিশুর হাতে এভাবে গাড়ি ছেড়ে দেওয়া কেবল দায়িত্বহীনতাই নয়, অজ্ঞানতাও বটে। শিশুমন অনেক অসম্ভব কিছু চাইতে পারে, তাকে বোঝানো বড়দের কাজ। শিশু আবদার করলেই তাকে সড়কে গাড়ি চালাতে দেওয়া ভয়ঙ্কর ও বিপজ্জক প্রবণতা। ধানমণ্ডির দুর্ঘটনা এর চেয়েও মারাত্মক হতে পারত। শিশু চালক, সড়ক দুর্ঘটনা,
এটা হয়তো ঠিক, তিনি মালিকের গাড়ি চালান। তাই বলে মালিকের ছেলের অন্যায় আবদার তিনি মেনে নিতে পারেন না। শিশুটিকে বোঝানো দরকার ছিল। শিশুকে গাড়ি চালাতে দিতে যে দুর্ঘটনা ঘটবে এটা তার অজানা থাকার কথা নয়।
এমনিতেই আমাদের দেশে সড়ক দুর্ঘটনা মহামারী আকার ধারণ করেছে। পরিসংখ্যান বলছে, দেশে প্রতিবছর ১২ থেকে ২০ হাজার মানুষ মারা যাচ্ছে সড়ক দুর্ঘটনায়। আর ব্র্যাকের গবেষণায় বলা হয়েছে, দেশে প্রতিবছর সড়ক দুর্ঘটনায় অকালেই প্রাণ হারাচ্ছে ১০ থেকে ১২ হাজারেরও বেশি মানুষ। আহত হয়ে কর্মক্ষমতা হারাচ্ছে এর কয়েকগুণ মানুষ। এর সিংহভাগ যদিও ঘটছে জাতীয় সড়ক-মহাসড়কে। তারপরও রাজধানীতে দুর্ঘটনার সংখ্যা একেবারে কম নয়। সাংবাদিক জগ্লুল আহ্মেদ চৌধূরী এ রাজধানীতেই সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান। সড়ক দুর্ঘটনার পেছনে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দায়ী করা হয় চালককে। অন্যান্য কারণ রয়েছে যদিও। এ অবস্থায় চালকদেরই সর্বাগ্রে সচেতন হতে হবে। অথচ আমরা ধানমণ্ডির ঘটনায় তার অনুপস্থিতি দেখলাম। শিশুর খেলনা হিসেবে তার হাতে আগুন তুলে দেওয়া কোনোভাবে মেনে নেওয়ার নয়।
একই সঙ্গে সে শিশুদের নিয়েও ভাবতে হবে, যারা রাজধানীতে ১০-১১ বছর বয়সেই বাস-লেগুনায় (হিউম্যান হলার) হেলপারি করছে। এমনকি খবর বলছে, শতাধিক শিশু রাজধানীর বিভিন্ন রুটে নিয়মিত লেগুনা চালাচ্ছে। তাদের ড্রাইভং লাইসেন্স নেই। যে বয়সে তাদের বিদ্যালয়ে থাকার কথা, সে বয়সে তারা ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করছে। আবার শিশু চালক হওয়ায় দুর্ঘটনার আশঙ্কা থাকছে, আরেকজনের জীবনও ঝুঁকিতে ফেলছে।
শিশুরা আমাদের ভবিষ্যৎ। সুন্দর আগামীর জন্য তাদের সেভাবেই গড়ে তুলতে হবে। এ ক্ষেত্রে মা-বাবার দায়িত্বই প্রধান। গাড়ি আছে বলে তাকে শিশু বয়সেই চালনা শেখাতে হবে তা কিন্তু নয়। প্রয়োজন হলে আইন অনুযায়ী গাড়ি চালনার বয়স হলেই তা শেখানো যেতে পারে। সচেতনতা ও দায়িত্ববোধই পারে আমাদের এগিয়ে নিতে। যাকে যখন যে আসনে রাখা দরকার তাকে সেখানেই রাখতে হবে। আপাতত শিশুর আসন পেছনেই, চালকের আসনে নয়।

ট্যাগঃ ,

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।