'মানবাধিকার' সৃষ্টির সেরা মানুষের শ্রেষ্ঠত্বেরই নিদর্শন। প্রত্যেক মানুষের রাষ্ট্রীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত কিছু অধিকার রয়েছে। আমাদের সংবিধানের তৃতীয় ভাগে এসব মৌলিক অধিকারের নিশ্চয়তা দেওয়া হয়েছে। মানুষ হিসেবে আপনার চিন্তার স্বাধীনতা আছে, কথা বলার স্বাধীনতা আছে, আছে পেশাবৃত্তির স্বাধীনতাও। স্বাধীনভাবে চলাফেরাও আপনি করতে পারবেন। আপনি নিজে কোথাও গিয়ে হারিয়ে যেতে পারেন। কিন্তু যখনই আপনাকে ইচ্ছার বিরুদ্ধে কেউ নিয়ে যাবে তখনই সেটা হবে মানবাধিকারের লঙ্ঘন। সে অবস্থাকেই বলা হয় গুম বা অপহরণ। এটা মানবাধিকারের কতটা লঙ্ঘন অপহরণের শিকারদের নিয়ে জাতিসংঘের 'ইন্টারন্যাশনাল ডে অব দ্য ভিকটিমস অব এনফোর্সড ডিসঅ্যাপিয়ারেন্সেস' তার প্রমাণ। দিবসটি উপলক্ষে জাতিসংঘ মহাসচিবের বাণীতেও তা ফুটে উঠেছে, 'এই মর্যাদাপূর্ণ দিনে আমি দৃঢ়ভাবে আবার বলছি, কাউকে গোপনে আটকে রাখা আন্তর্জাতিক আইনের সম্পূর্ণ বিরোধী।... একুশ শতকে এসেও গুম-অপহরণের এই রীতি কোনোভাবেই সহ্য করা যায় না।'
তার এ বক্তব্য বাংলাদেশের জন্য কতটা প্রাসঙ্গিক বলাই বাহুল্য। একুশ শতকের এই সময়ে বাংলাদেশে গুম-অপহরণ কতটা বেপরোয়া তা জাতিসংঘ মহাসচিব জানেন কি-না জানা নেই। তবে এ বছর এমন সময়ে দিবসটি আমাদের সামনে হাজির, যখন বছরের আলোচিত নারায়ণগঞ্জের সাতজন অপহরণ ও খুনের ঘটনায় র্যাবের লিখিত প্রতিবেদনে র্যাবেরই জড়িত থাকার চাঞ্চল্যকর তথ্য বেরিয়ে এসেছে; যখন বিএনপি নেতা মুজিবুর মে মাসে অপহরণের পর সম্প্রতি উদ্ধার হন; যখন ২৫ আগস্ট নোয়াখালীর হাতিয়ার নিঝুম দ্বীপের দক্ষিণে বঙ্গোপসাগরে ২০ জেলে ও ২৩ আগস্ট সুন্দরবনে ৯৬ জেলে অপহরণের শিকার হন। এভাবে অপহরণের ফিরিস্তি যে অনেক লম্বা তা সবাই জানেন। বেলার নির্বাহী রিজওয়ানা হাসানের স্বামী আবু বকরের অপহরণ ও উদ্ধারের খবর যেমন কারও অজানা থাকার কথা নয়, তেমনই অজানা নয় বিএনপি নেতা ইলিয়াস আলীর গুম ও এখনও নিরুদ্দেশের খবর। এর বাইরে অপহৃত হয়তো অনেকের খবরই আমাদের অজানা। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্যানুযায়ী, ২০১০ থেকে ২০১৩ সালে মোট ২২৯ ব্যক্তি অপহৃত হয়েছিলেন, আর এই বছরের প্রথম চার মাসে এ সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৫৩, যা ২০১০ সালের সারা বছরের চেয়েও বেশি।
প্রত্যেক গুম-অপহরণ যে কত বড় ঘটনা তা ভুক্তভোগীরাই বলতে পারেন। অপহৃত, অপহৃতের পরিবার, আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধু-বান্ধবের কান্নাই নয়, তার সঙ্গে জড়িয়ে থাকে অনেক স্বপ্ন। স্বপ্নের অপমৃত্যুর। এ ছাড়া এর মাধ্যমে সমাজে যে ভয়, ত্রাস, নিরাপত্তাহীনতা সৃষ্টি হয় তাও কম কথা নয়। যে সমাজের মানুষ নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে, বাইরে বেরোবার সাহস পায় না সেখানে রাষ্ট্র কতটা অসহায় বলার অপেক্ষা রাখে না।
গুম-অপহরণ নিয়ে বরাবরই মানুষ সোচ্চার। তারপরও নানা কারণে, নানাভাবে, নানা জায়গায় অপহৃত হচ্ছে মানুষ। রাজনীতি, অর্থ, ক্ষমতা বিভিন্ন বিষয় এর সঙ্গে জড়িত। তবে যে বা যারাই এর সঙ্গে জড়িত তাদের হাত রাষ্ট্রের চেয়ে বড় হতে পারে না। সংবিধান আমাদের যে অধিকার দিয়েছে তা সর্বতোভাবে রক্ষা করা রাষ্ট্রের নৈতিক দায়িত্ব।
যে মা সন্তানের পথপানে চেয়ে আছে, যে সন্তান পিতার জন্য অপেক্ষা করছে, যে স্ত্রী প্রাণপ্রিয় স্বামীকে খুঁজছে_ রাষ্ট্র ছাড়া কে আছে তাদের এই প্রতীক্ষার অবসান ঘটাবে?
- সমকালে কিঞ্চিত পরিবর্তিতরূপে প্রকাশিত, ৩০ আগস্ট ২০১৪
- ই-সমকাল হতে দেখুন
- ছবি: সংবাদপত্রের অনলাইন হতে সংগৃহীত