ছুটি নিয়ে লেখার ইচ্ছা অনেক দিনের। অনেক দিন বলতে এক বছর তো হবেই। বিশেষ করে যত দিন ধরে ফুল টাইম সাংবাদিকতা করছি। সাংবাদিকতা আসলে একটা আলাদা জগৎ। নানাদিক থেকেই পেশাটি ব্যতিক্রম। ছুটি তার অন্যতম। ঈদ বা এ রকম জাতীয় উৎসবে যখন সবাই আনন্দ করেন অনেক ক্ষেত্রে সাংবাদিকরা তখন সেটা কাভারেজ দিতে দৌড়ান। ১৬ ডিসেম্বর যখন সবাই উদযাপন করছে সাংবাদিকরা তখন ব্যস্ত তার পেশাগত দায়িত্ব নিয়ে। এ ক্ষেত্রে বড় পার্থক্যটা সপ্তাহের ছুটি নিয়ে। সরকারি কর্মচারীরা সপ্তাহে দুইদিন ছুটি ভোগ করেন। অন্য অনেক পেশায়ও দুইদিন ছুটি। অনেকের অবশ্য একদিন ছুটিও রয়েছে। তবে সাপ্তাহিক এ ছুটির ক্ষেত্রে সবারই একটা কমন থাকে। শুক্রবার। ব্যতিক্রম সাংবাদিকতা। এখানে শুক্র-শনি নাই। সংবাদপত্র প্রতিদিন বের হয়। অনলাইনে অনুক্ষণ সংবাদ আপডেট হয়। টিভি চ্যানেলও চলে প্রতিক্ষণ। এগুলো বন্ধ হয় না। তাই এখানে ছুটিও নাই।
অবশ্য কথা আছে। সাংবাদিকতা যেমন অবিরাম চলমান এর ছুটিও তেমনি চলমান; এটি নির্দিষ্ট দিনের রুটিন মানে না; শুক্রবারের কমন ছুটি মানে না। এখানে প্রতিদিন ছুটি, প্রতিদিন কাজ। কাকতালীয়ভাবে শুক্রবারও কারও ছুটি পড়ে যেতে পারে। সাংবাদিক প্রত্যেকের আলাদা আলাদাভাবে সপ্তাহের একেক দিন ছুটি। পাঠক, গ্রাহক, শ্রোতা, দর্শক যেখানে সবসময় সংবাদ মাধ্যমের দিকে তাকিয়ে থাকেন, প্রতি সকালে নতুন সংবাদপত্র হাতে চান সেখানে সংবাদমাধ্যমগুলোর বিরাম কোথায়। সাংবাদিকদের যদি একদিন কমন ছুটি হতো তাহলে ওইদিন পাঠক বঞ্চিত হবেন। সবচেয়ে বড় কথা হলো সময় ও স্রোত যেমন কারও জন্য অপেক্ষা করে না। সংবাদও কিন্তু কারও জন্য অপেক্ষা করে না। প্রতিনিয়ত সংবাদ ঘটেই চলেছে। যার পেছনে ছুটতে হয় সাংবাদিকদের। এ কাজটা তারা মিলেমিশেই করেন। ফলে ছুটিটাও সবাই একজন আরেকজনের সঙ্গে মিলিয়েই নেন। আজ একজন কাজ করবেন তো কাল আরেকজন। এতে প্রত্যেকের একটা দিন ছুটির ব্যবস্থাও হলো আবার সংবাদ মাধ্যমও অবিরাম চললো।
সাংবাদিকরা এ অবস্থার সঙ্গে মানিয়ে নেন। যেমনটা আমিও মানিয়ে নিয়েছি। এখানে ছুটির গতানুগতিক ধারণা নাই। আমাদের ছোটবেলার সেই শ্লোগান নাই ‘বৃহস্পতিবার হাফ, শুক্রবার মাফ’। তবে সত্যি বলতে কী ছুটির অনুভূতি আছে। ব্যক্তিগতভাবে নিজের কথা বলি- এ অনুভূতি আমার খুব ভালো ভাবেই আছে। প্রাথমিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের মাস্টার্সসহ দীর্ঘ শিক্ষা জীবনে শুক্রবারের ছুটির সঙ্গে যে সখ্যতা, ভাব, আয়েশ জড়িয়ে ছিলো তা হয়তো এখন আমার কাছে স্বপ্নের অতীত। তারপরও বর্তমানের নির্দিষ্ট ছুটির দিনটি আসার আগ থেকেই কেমন যেন ভালো লাগা কাজ করে। একটা দিন অফিসে না গিয়ে স্বাধীনভাবে নিজের মত কাটানোর আনন্দটা আসলে বোঝানোর মত না।
প্রতিদিনের রুটিনমাফিক একগুয়েমি জীবনে অফিস আর বাসার বাইরে বেরুবার আয়োজনটা অন্যরকমই বটে। তবে সে আয়োজন সব সময় সেরকম হয় না। কারণ সব সবাই এখন নিজ কাজে ব্যস্ত। প্রত্যেক মানুষই তার প্রিয় সময়গুলো প্রিয় মানুষের সান্নিধ্যে কাটাতে চায়। এখানেই হয়তো আমাদের সীমাবদ্ধতা। যেমন আমার সাপ্তাহিক ছুটি বৃহস্পতিবারের সঙ্গে নিশ্চয়ই বন্ধু কিংবা অন্য কোনো আপনজনের ছুটি মিলে না। অনেক সময় হয়তো একজন আরেকজনের জন্য সময় স্যাক্রিফাইস করেন। কিন্তু অধিকাংশ সময়ই তা হয়ে ওঠে না। তখন একা একা কাটানো ছাড়া উপায় কি।
তবে অনেকের সঙ্গে থাকলে শূন্যতা কমই অনুভূব হয়। হলে থাকার সময় আমার যেটা হয়েছিলো। গত বছরের ১ মার্চ আমার প্রিয় এসএম হল ছাড়লাম। সে হিসেবে এক বছরের কিছু বেশি সময় হয়ে গেলো। হল ছাড়া মানে কেবল হল ছাড়াই নয়, দীর্ঘদিনের ক্যাম্পাস ও রুমমেটদেরও ছাড়া। প্রথম প্রথম তাই আমার সাপ্তাহিক ছুটির দিনগুলোতে হলে, ক্যাম্পাসে যেতাম। বিশেষ করে আমার যাওয়া হতো বুয়েটের আহসানউল্লাহ হলে। প্রিয় ওয়াসিম ভাই থাকেন। এখনও যে যাই না তা নয়। তবে হলে আগের অনেকেই চলে গেছেন। ওয়াসিম ভাইও ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। মাঝখানে ক’দিন পাবলিক লাইব্রেরীতে যেতাম। এখন অবশ্য ছুটির দিনে বলাচলে নিয়ম করে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে যাই। সেখানকার সদস্য হিসেবে নিয়মিত বই আনা ও জমা দেওয়ার জন্য বৃহস্পতিবারই ভরসা। আগে অনেক আড্ডা, পাঠচক্র ইত্যাদিতে যেতাম এখন আর এসবে আগ্রহ পাই না। লেখালেখি। পড়াপড়ি। বিশেষ কোনো কাজ আর মুভি দেখেই কাটে আমার ছুটি। মাঝে মাঝে আড্ডা ও হয়। আর দুপুরে ঘুমের যে চিরন্তন অভ্যাস সেটা কিন্তু এই ছুটির দিনটাতেই মিলে। ছোটবেলায় কত কষ্টে না ঘুম পাড়াতেন আমার আব্বা। আমাদের ভাইবোন সবাইকে শুইয়ে একেবারে শিয়রে লাঠি নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতেন। তখন ঘুম আসতে চাইতো না। ফাক পেলেই ওঠার চেষ্টা করতাম। কখনো কখনো হয়তো মাইরও খেয়েছি। আর এখন মাঝে মাঝে যখন অফিসের দুপুরের খাবারের পর ঘুমঘুম ভাব আসে সেদিনের কথা মনে করে আফসোস করি। ব্যসিনে চোখটা ধুয়ে আবার কম্পিউটারে বসি। বৃহস্পতিবারের কথা মনে করি। দিনটি যে সাংবাদিকদের ভাষায় ‘ডে অফ’। আমার সাপ্তাহিক ছুটির দিন।
- ছবি: ইন্টারনেট