Mahfuzur Rahman Manik
ভাটির দেশের নাইয়া
সেপ্টেম্বর 5, 2012
শিল্পী আব্দুল আলীম (২৭ জুলাই, ১৯৩১- ৫ সেপ্টেম্বর, ১৯৭৪)

অগ্রজ অনেকেই অভিযোগ করেন বর্তমান শিল্পীরা নাকি গান গায় গলা দিয়ে। তারা বলেন গান গাইতে হয় হৃদয় দিয়ে। হৃদয়ের আবেগ উজাড় করে দিয়ে যে গান গাওয়া হয় সেটাই তো সঙ্গীত হয়ে ওঠে, হয়ে ওঠে সাধনা। বর্তমান প্রজন্মের একজন হিসেবে আব্দুল আলীমের গান শুনলে মনে হয় তারা ঠিকই বলেছেন। কী অসাধারণ গেয়েছেন তিনি! মানুষের মনের সঙ্গে 'হলুদিয়া পাখি'র কী চমৎকার তুলনা! আব্দুল আলীম যেন সারাটা জীবন গানের মধ্য দিয়ে মানুষ, মন ও প্রকৃতিকেই খুঁজেছেন। বিশেষ করে নদী। আমরা দেখেছি, নদীকে উপজীব্য করে তার গানে বারবারই এসেছে মাঝির কথা. নৌকার কথা, ঘাটের কথা। তিনি গেয়েছেন রূপালি নদী রে... গেয়েছেন কলকল ছলছল নদী করে টলমল... কিংবা মেঘনার কূলে ঘর বান্ধিলাম...।
এক প্রমত্তা পদ্মা দেখেছেন আব্দুল আলীম, গেয়েছেন গলা ছেড়ে_ 'সর্বনাশা পদ্মা নদী...'। এখন পদ্মার আর সেই রূপ নেই, প্রবাহ নেই; নেই আব্দুল আলীমও। সেও ৩৮ বছর; ১৯৭৪ সালের ঠিক আজকের দিনটায় তিনি পাড়ি দেন পরপারে। কিন্তু তার গান এখনও তাঁকে জীবন্ত রেখেছে। এখনও মানুষ তাকে স্মরণ করে শ্রদ্ধাভরে। সঙ্গীতের জগতে এক জীবন্ত কিংবদন্তি তিনি। তার গান মানুষের মুখে মুখে। তিনি পল্লীগীতি, লোকসংস্কৃতি, ভাটিয়ালি সব গেয়েছেন। মারফতি আর মুর্শিদির সুরে তিনি গেয়েছেন। গান দিয়ে তিনি জয় করে নিয়েছেন সাধারণ মানুষের অন্তর।
আব্দুল আলীমের গানের বিষয় যেমন ছিল নদী, তেমনি তার গানগুলোও ছিল নদীর মতো বহমান। নদীর সঙ্গে সঙ্গে তিনি এনেছেন পরিবেশ-প্রকৃতিকে। তার গানে ফুটে উঠেছে আল্লাহ-নবীর কথা, মুর্শিদের কথা। গেয়েছেন নবী মোর পরশমণি... কিংবা মুর্শিদ পথের দিশা দাও। আব্দুল আলীম মানুষের বন্ধুত্ব, প্রেম-ভালোবাসা, সংসার নিয়েও গেয়েছেন অজস্র গান। তার সব সখিরে পার করিতে নিবো আনা আনা.. জনমুখে প্রচলিত এক বিখ্যাত গান। একই সঙ্গে গেয়েছেন বহু দিনের পিরিত গো বন্ধু... বা বন্ধুর বাড়ি মধুপুর। এসব কিছুর মাঝেও যেন আব্দুল আলীম অন্য কিছু খুঁজেছেন। তার শ্রোতাদের নিয়ে গেছেন অন্য কোনো খানে; নদীর ওপারের এক ভিন্ন জগতে। পরের জায়গা পরের জমি... আর সেই পারে তোর বসত বাড়ি... কিংবা চিরদিন পুষলাম এক অচিন পাখী... তা-ই বলছে।
১৯৩১ সালে ভারতের মুর্শিদাবাদে জন্ম নেওয়া আব্দুল আলীম ছোটবেলা সঙ্গীতের প্রতি বিশেষ আকৃষ্ট ছিলেন। আজকের দিনের মতো গান শুনবার কিংবা শিখবার এরকম সাজ-সরঞ্জাম তখনকার সময় না থাকলেও তিনি গ্রামোফোন রেকর্ড শুনতেন। তিনি ঢাকায় আসেন ১৯৪৭-এর দেশ বিভাগের পর। ঢাকায় এসে সঙ্গীতের তালিম নেন মমতাজ আলী খান ও মোহাম্মদ হোসেন খসরুর মতো সঙ্গীতবোদ্ধাদের কাছে। এ সময়ই তিনি কবি জসীম উদ্দীন, বেদার উদ্দিন আহমেদ. আবদুল লতিফ প্রমুখ বিশিষ্ট ব্যক্তিত্বের সানি্নধ্যে আসেন। কবি নজরুলের সঙ্গে আগ থেকেই তার পরিচয়। তারও আগে শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক তো তার গানে মোহিত হয়ে তাকে বিশেষ পুরস্কার দেন। তার রেকর্ড করা গানের সংখ্যা পাঁচ শতাধিক। এ ছাড়া তার গান রয়েছে বেতার স্টুডিওতে। তিনি গান করেছেন পাকিস্তানের প্রথম ছবি মুখ ও মুখোশসহ টেলিভিশন ও অসংখ্য ছায়াছবিতে। আব্দুল আলীমের ঝুলিতে পুরস্কারেরও কমতি নেই, জীবদ্দশায় তো বটেই এরপরও পেয়েছেন অনেক পুরস্কার। উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলো একুশে পদক, জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার, স্বাধীনতা পুরস্কার, বাচসাস চলচ্চিত্র পুরস্কার ইত্যাদি।
মাটি আর মানুষের ভালোবাসায় সিক্ত আব্দুল আলীম বরাবরই বলেছেন ভাটির দেশের কথা। তার গান মানুষকে নিয়ে যায় গ্রামে, সুন্দর বহমান নদীর ধারে, ছলাৎ ছলাৎ চলমান কী সুন্দর সে নদী!

সমকালে প্রকাশিত ৫ সেপ্টম্বর ২০১২

ট্যাগঃ

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।