সন্দেহ নেই, জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০ প্রণয়ন বর্তমান সরকারের একটা বড় কৃতিত্ব। কিন্তু পদে পদে শিক্ষা নীতি বা শিক্ষানীতির বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ায় যে ধীরগতি লক্ষ্যনীয়, তাতে এ শিক্ষানীতি চুড়ান্তভাবে কার্যকর হবে কি-না তা নিয়ে সন্দিহান হওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে। বর্তমান সরকারের ক্ষমতা গ্রহণের সঙ্গে শিক্ষানীতির সম্পর্ক ওতপ্রোতভাবে জড়িত। জানুয়ারিতে এ সরকারের মেয়াদ হবে তিন বছর, আর এখন পর্যন্ত শিক্ষানীতিও আড়াই বছর পার করে এসেছে। আড়াই বছর পর শিক্ষানীতি এখনও প্রক্রিয়াধিন
এ বিষয়টা বুঝার জন্য কিছু তারিখের অতিরঞ্জিত ব্যবহার করতেই হচ্ছে। ২০০৯ এর ৬ জানুয়ারি বর্তমান সরকার ক্ষমতাগ্রহন করেই তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে যে শিক্ষনীতির কথা বলা হয়েছে ; বলাচলে তাতেই প্রথম হাত দেয়। ওই বছরের ৪ এপ্রিল জাতীয় অধ্যাপক কবীর চৌধুরীর নেতৃত্বে আঠারো সদস্যের শিক্ষানীতি কমিটি গঠন করা হয়। কমিটি অত্যন্ত দ্রুত সময়ে, মাত্র চারমাসের মাথায় ২ সেপ্টেম্বর খসড়া রিপোর্ট পেশ করে। খসড়া রিপোর্ট শিক্ষা মন্ত্রনালয়ের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করে এবং তার ওপর মন্তব্য জানাতে ১৫ অক্টোবর পর্যন্ত সকলের জন্য উন্মুক্ত করে দেয় সরকার।
দ্রুত খসড়া রিপোর্ট পেয়েই সরকারের শিক্ষাসংশ্লিষ্টরা আশা করেছিলেন ২০০৯ এর ডিসেম্বরের মধ্যে তা চুড়ান্ত করে জানুয়ারি থেকেই বাস্তবায়ন শুরু করবেন। যদিও সে আশায় গুড়েবালি। অবশ্য সে রিপোর্ট চুড়ান্ত হয়েছিলো তারও একবছর পর ২০১০ এর ৭ ডিসেম্বর জাতীয় সংসদে পাশ হওয়ার মাধ্যমে। মাঝখানে এটি মন্ত্রী-পরিষদের বৈঠকে ওঠে ৩১ মে ২০১০, এছাড়া ২৭ জুন গঠন করা হয় শিক্ষানীতি বাস্তবায়নসংক্রান্ত ৩২ জনের উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন জাতীয় কমিটি।
তবে শিক্ষানীতি চূড়ান্ত বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া নির্ধারণের জন্য এ বছরের (২০১১) ২৬ জানুয়ারি ২৪ টি উপকমিটি গঠন করা হয়। যেমন শিক্ষা আইন প্রনয়ণ কমিটি, পাঠ্যপুস্তক আধুনিকীকরণ কমিটি, শিক্ষা কমিশন কমিটি, পঞ্চম থেকে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত প্রাথমিক শিক্ষা বর্ধিতকরণ কমিটি ইত্যাদি। এসব কমিটিকে দুই-তিন মাসের মধ্যে রিপোর্ট দেয়ার কথা বলা হয়। কিন্তু মজার বিষয় হলেও এখন নভেম্বর; অর্থাৎ আট মাস পরও কোনো কমিটি তাদের প্রতিবেদন পেশ করতে পারে নি।
এ বিষয়ে গত সেপ্টেম্বরে যুগান্তরসহ প্রায় প্রত্যেকটি দৈনিক প্রতিবেদন প্রকাশ করে। প্রতিবেদনগুলো দেরির কারণ হিসেবে একটি বিষয়কেই দেখিয়েছে ‘আমলাতান্ত্রিক জটিলতা’। শিক্ষানীতি বাস্তবায়নে উপ-কমিটিগুলোর প্রায় প্রত্যেকটির মূল দায়িত্বে আছে বিভিন্ন মন্ত্রনালয়ের সচিব, যুগ্ম সচিব, অতিরিক্ত সচিব পর্যায়ের আমলারা। যারা নিজেদের দাফতরিক কাজ, জনপ্রতিনিধিদের ডিও লেটার নিষ্পত্তিসহ নানা কাজ সামাল দিতেই ব্যস্ত।
শিক্ষানীতির অগ্রগতি সংক্রান্ত সংবাদপত্রের প্রতিবেদনের পরই শিক্ষামন্ত্রীর নেতৃত্বে শিক্ষানীতি জাতীয় কমিটির এক বৈঠক হয় ২৯ সেপ্টেম্বর। বৈঠকে শিক্ষামন্ত্রী কোনো অজুহাত না দেখিয়ে সকল কমিটিকে ২০ দিনের মধ্যে রিপোর্ট দেয়ার নির্দেশ দেন। অবশ্য শিক্ষামন্ত্রীর দেয়া সে ২০ দিনও ইতিমধ্যে শেষ হয়ে গেছে; কিন্তু এখন পর্যন্ত কোনো কমিটি রিপোর্ট দিয়েছে বলে আমরা জানি না। এটা ঠিক যে কাজ ২০০ দিনেও হয়নি সেটা ২০ দিনে কিভাবে হবে।
এ হলো শিক্ষানীতি ২০১০ এর সর্বশেষ চিত্র। যেটি হতাশা ছাড়া কোনো আশার আলো দেখাচ্ছে না। যদিও বিচ্ছিন্নভাবে শিক্ষানীতির কিছু বাস্তবায়নের কথা সরকার বলছে, যেমন- পঞ্চম শ্রেণীর সমাপনী, অষ্টম শ্রেণীর জেএসসি ইত্যাদি। এছাড়া নতুন কারিকুলামের কাজ শুরু হয়েছে বলেও গনমাধ্যম বলছে, আবার বিনামূল্যে বই বিতরণকেও এরই সাফল্য হিসেবে দেখাতে চায় সরকার।
বর্তমান শিক্ষানীতির বড় বৈশিষ্ট্য আকারে সবাই দেখছে প্রাথমিক শিক্ষাকে পঞ্চম শ্রেণী হতে বাড়িয়ে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত করাকে। ২০১২ সাল থেকেই তা বাস্তবায়নের কথা থাকলেও তা হয়তো হচ্ছে না। এখানে প্রথমত: সংশ্লিষ্ট কমিটির ব্যর্থতা। কমিটি যদি এবছরের আরও আগের দিকে বর্ধিত করণ সংক্রান্ত সুপারিশ পেশ করতে পারতো; হয়তো সরকারের পক্ষে তার বাস্তবায়ন সহজ হতো, বা সরকার ২০১২ হতে বাস্তবায়নের প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে পারতো। আসল কথা হলো সংবাদ মাধ্যম বলছে, বিষয়টা নিয়ে কমিটি নিজেরাই দ্বিধাদ্বন্দ্বে আছে। অস্বীকার করার জো নেই বাংলাদেশের জন্য হুট করেই প্রাথমিককে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত বাড়ানো কষ্টকরই বটে।
আশ্চর্যের বিষয় হলো, প্রাথমিক শিক্ষার উন্নয়নে সম্প্রতি সর্বকালের সেরা বাজেট ২২ হাজার কোটি টাকার পিইডিপি-৩ শুরু হওয়ার কথা। সেখানে খাত হিসেবে কিন্তু শিক্ষানীতি বাস্তবায়নের কথা আসেনি। যদিও বর্তমান প্রাথমিক শিক্ষার যে অবস্থা তাতেই অনেক নতুন বিদ্যালয় প্রয়োজন, প্রয়োজন নতুন শিক্ষক নিয়োগ এছাড়া বিদ্যালয় অবকাঠামোসহ সার্বিক উন্নয়ন ভালোভাবে করতে এ বাজেট প্রয়োজন। এর বাইরে নতুন করে শিক্ষাস্তর বর্ধিতকরণের খরচতো লাগবেই। অবশ্য সরকার চাইলে উভয়কে একীভূত করে একই সঙ্গে উন্নয়ন এবং বর্ধিতকরণের কাজে হাত দিতে পারে।
তবে শিক্ষানীতি অগ্রগতির প্রতিবন্ধকতার অন্যতম কারণ হিসেবে সংশ্লিষ্ট সূত্র যে অর্থনৈতিক কারণকে দেখিয়েছে এটা দুঃখজনক। শিক্ষানীতি বাস্তবায়নের জন্য আলাদা কোনো বরাদ্দ না থাকলে এর কাজ এগুবে না এটাই স্বাভাবিক। অবশ্য বিষয়টা আমরা এবারের ২০১১-২০১২ জাতীয় বাজেটেই দেখেছি। সেখানে শিক্ষার জন্য বরাদ্দ ছিলো বলাচলে আগেকার বছরগুলোর তুলনায় আরও কম- শিক্ষাও প্রযুক্তি উভয় খাত মিলে বরাদ্দ দেয়া হয় মোট বাজেটের ১২.৪ ভাগ মাত্র। যেখানে শিক্ষানীতি বাস্তবায়নের জন্য কোনো বাজেট ছিলো না।
শিক্ষানীতি বাস্তবায়নের কমিটিগুলোতে আমলা নির্ভরতা কমিয়ে যারা যথার্থ শিক্ষা নিয়ে গবেষণা করে তাদেরকে অন্তর্ভূক্তকরণটা তাৎপর্যপূর্ণ হতে পারে। বিশেষ করে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষা নিয়ে যারা পড়াশোনা করে, গবেষণা করছে তারাও এখানে কাজ করতে পারে। তবে কমিটিগুলোর ওপরই এখন নির্ভর করছে শিক্ষানীতির পরবর্তী বাস্তবায়ন কাজ। এক্ষেত্রে মনিটরিং গুরুত্বপূর্ণ। শিক্ষামন্ত্রী এ বিষয়টা নিশ্চয় দেখছেন। তবে ২০ দিন বা এরকম তাড়াহুড়া করে কোনো সময় বেঁধে না দিয়ে প্রকৃত কাজ যাতে হয় তা নিশ্চিত করা প্রয়োজন।
সরকার শুরু থেকেই যে প্রণোদনা নিয়ে কাজটা শুরু করেছে, তাড়াহুড়ো করে করা শিক্ষানীতির শেষটা দেখতেই এখন সবাই আগ্রহী। এটা নানা কারণে, এখনও এ শিক্ষানীতি যে স্তরে আছে তা আগের শিক্ষানীতিগুলোর মতই। এর আগে ২০০৪ এর মনিরুজ্জামান মিয়া শিক্ষা কমিশনও বলা চলে কমিটি পর্যন্তই সীমাবদ্ধ ছিলো। অবশ্য এবারেরটা আরেকটু এগিয়ে আছে। কারণ এটা জাতীয় সংসদে পাশ হয়েছে। সরকারও শুরু থেকেই এটা বাস্তবায়নে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। আর এজন্যই অতীতের ‘খসড়া রোগে আক্রান্ত’ শিক্ষানীতিগুলো থেকে এবারের নীতিকে সবাই ভিন্ন চোখে দেখে আসছে।
বলার অপেক্ষা রাখেনা, শিক্ষানীতি বাস্তবায়ন খুব সহজ কাজ নয়। এর জন্য যে প্রস্তুতি, প্রক্রিয়া দরকার তা সময় সাপেক্ষ বটে। এর জন্য গবেষণারও প্রয়োজন আছে। শিক্ষানীতির সুপারিশক্রমে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় নতুন যে দুটি পাবলিক পরীক্ষা শুরু হয়েছে, তার যথার্থতা বা কার্যকারিতার জন্য গবেষণা হয়েছে বলে জানিনা। এমনকি অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত প্রাথমিক শিক্ষা বর্ধিতকরণের জন্য কোনো স্টাডি হয়েছে বলেও কিছু পাওয় যায়নি। তবুও এ শিক্ষানীতি বাস্তবায়ন হোক, এটি বাস্তবায়নে সরকার যথাযথ পদক্ষেপ নিক। পরে ধাপে ধাপে এর মানানসই উন্নয়ন সম্ভব হবে।