সম্প্রতি বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন (বিএডিসি) দেশের ভূগর্ভস্থ পানি নিয়ে গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে আপডেটিং গ্রাউন্ড ওয়াটার জোনিং ম্যাপ অব বাংলাদেশ নামে। তাতে গত সাত বছরের ভূগর্ভস্থ পানির চিত্র দেখানো হয়েছে। তাতে বলা হয়, সাত বছরে ঢাকার পানির স্তর নেমেছে ছয় মিটার। আজকের আলোচনা ঢাকার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে। তবে এর সঙ্গে ঢাকার নদীগুলোও আসবে।
প্রায় সোয়া কোটি নগরবাসীর প্রতিদিন পানি জোগানের দায়িত্বে রয়েছে ওয়াসা। ওয়াসা জানাচ্ছে, প্রতিদিন পানির চাহিদা রয়েছে ২ হাজার ২৫০ মিলিয়ন লিটার। ওয়াসা প্রতিদিন ২ হাজার ১০০ মিলিয়ন লিটার পানি জোগান দিতে পারে। চাহিদার তুলনায় ওয়াসা পানি কম সরবরাহ করছে, কিংবা সরবরাহকৃত পানির মানের প্রশ্ন আছে, সেটা বিষয় নয়। বিষয়টা হলো ৮৭ শতাংশই তোলা হচ্ছে মাটির নিচ থেকে।
ওয়াসা পানির ক্ষেত্রে ভূগর্ভস্থ পানির ওপর নির্ভরশীল, এতে পানির স্তর দিন দিন দ্রুত নিচে নেমে যাবে, এটা স্বাভাবিক। এখন গবেষণা হচ্ছে, পানির স্তর কতটা নিচে নেমে যাচ্ছে তা নিয়ে। সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, সাত বছরে নেমেছে ছয় মিটার। ২০০৪ সালে যেখানে সমুদ্রস্তর থেকে ঢাকার ভূগর্ভস্থ পানি ছিল ৪৬ মিটার নিচে, ২০১১-এ তা বেড়ে হয় ৫২ মিটার। অবশ্য ‘ওয়াটার এইড বাংলাদেশ’ বলছে, প্রতি বছর ঢাকার পানির স্তর নামছে তিন মিটার হারে।
পানির স্তর এভাবে দ্রুত নামায় একদিকে যেমন ওয়াসার পাম্প কিংবা গভীর নলকূপ থেকে পানি ওঠানো অসম্ভব হয়ে যাচ্ছে, অন্যদিকে এটা নগরবাসীর জন্য ঝুঁকির কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এর ফলে বিরাট প্রতিকূল অবস্থার সৃষ্টি হবে। ভূমিধস, খরা, পরিবেশ বিপর্যয় থেকে শুরু করে বাস্তুসংস্থান শৃঙ্খলা ভেঙে দেবে। আমাদের সামনে যে বাঁচা-মরার কঠিন বাস্তবতা উপস্থিত হয়েছে, এটা আমরা নিজেরাই তৈরি করেছি। এ বিষয়ে বিস্তারিত বলার আগে নদী বিষয়ে যাওয়া যাক।
ওয়াসা ভূগর্ভ থেকে ৮৭ শতাংশ পানি উত্তোলন করে। বাকি ১৩ শতাংশ আসে নদী থেকে। ঢাকার চারপাশে চারটি নদী— বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, বালু ও শীতলক্ষ্যা। এর মধ্যে শীতলক্ষ্যা থেকে আসে ১০ শতাংশ, বাকি ৩ শতাংশ পানি বুড়িগঙ্গার। নদী থেকে উত্তোলিত পানি শোধনাগার থেকে শোধন করে বিতরণ করা হয়। মজার বিষয় হলো, ওয়াসার পানি নিয়ে গ্রাহকদের বিস্তর অভিযোগ রয়েছে— খাওয়ার অযোগ্য, দুর্গন্ধ, দূষিত, ডায়রিয়ার কারণ প্রভৃতি নদীর পানির জন্য। অর্থাত্ আমাদের নদীগুলো এতটাই দূষিত যে, তা শোধনের অযোগ্য। এই ১৩ শতাংশ দূষিত পানি ওয়াসার অন্য উেসর সঙ্গে মিশে পানিকেই ব্যবহারের অযোগ্য করে ফেলে।
চারটি নদীর সবগুলোর দূষণের মাত্রা বলার অপেক্ষা রাখে না। দূষণ আর দখলে এগুলোর অবস্থা সঙ্গিন। সদরঘাটে গিয়ে নদীর পাড়ে দাঁড়ালে যে কেউ অসুস্থ হতে পারেন। এ দূষণও আমাদের দ্বারাই হচ্ছে। হাজারীবাগ ট্যানারির বর্জ্য, ঢাকা ওয়াসার সুয়ারেজ লাইন, কলকারখানার বর্জ্য প্রভৃতির মাধ্যমে ইচ্ছাকৃতভাবে আমরা বুড়িগঙ্গাকে ধ্বংস করেছি। কঠিন ও তরল বর্জ্যে এর অক্সিজেনের পরিমাণ এতটাই কমে গেছে যে, সাম্প্রতিক পরিবেশ অধিদফতরের পরীক্ষায় বলা হয়েছে, এখানে জলজ প্রাণী ও উদ্ভিদ বেঁচে থাকতে পারবে না।
আমাদের নদীগুলোকে এভাবে না মারলে ঢাকা শহরে পানির কোনো সমস্যাই থাকত না। পরিকল্পনা ছাড়াই আমরা পানির বিষয়ে ভূগর্ভস্থ পানির ওপর নির্ভর করেছি আর নদীগুলোকে ইচ্ছামতো দূষিত করেছি। অথচ ঢাকাবাসী শুরু থেকেই পানির বিষয়ে যদি নদীর ওপর নির্ভরশীল হতো, নদীগুলোকে ব্যবহার করে পানির চাহিদা মেটাত, তখন নগরবাসীর স্বার্থেই নদীগুলোকে দূষণমুক্ত রাখতে হতো কিংবা একে ভালো রাখার সব পদক্ষেপ প্রশাসন নিত।
এখন আমরা সব হারিয়েছি। ভূগর্ভস্থ পানি ব্যবহার করে এর স্তর কমিয়ে জীবনের ঝুঁকি বাড়িয়েছি, নদীগুলোকে দূষিত আর দখল করে বর্জ্য ফেলে মৃত করেছি। এসব পর্ব যখন শেষ, তখনই নদী উদ্ধারের তোড়জোড় দেখছি, ফলে যা হওয়ার তা-ই হচ্ছে। নদী উদ্ধারে হাইকোর্ট পর্যন্ত নির্দেশনা দিয়েছে। গত বছর ‘বুড়িগঙ্গা ও তুরাগ রিভার ক্লিনিং প্রজেক্টের’ নামে বাবুবাজার থেকে কামরাঙ্গীরচর পর্যন্ত নদীর তলদেশের বর্জ্য অপসারণ শুরু হয়েছিল। সেটাও এখন বন্ধ। আবার ওই বর্জ্য ব্যবস্থাপনাগত সমস্যায় নদীতেই পড়ছে।
ঢাকাবাসীর পানির সংকট উত্তরণে ভূগর্ভস্থ পানির ওপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে উপরিভাগের বিশেষ করে নদীর পানির ওপর নির্ভরশীলতা বাড়ানো ছাড়া বাঁচার কোনো পথ নেই। কর্তাব্যক্তিরাও তা মনে করছেন। ওয়াসাপ্রধান এ কথাই বলেছেন, ‘আমরা ২০২১ সাল নাগাদ ভূ-উপরিভাগের পানি বর্তমানে ১৩ থেকে ৭০ শতাংশে উন্নীত করব, আর ভূগর্ভস্থ পানি ৮৭ থেকে নামিয়ে ৩০ শতাংশে নিয়ে আসব।’ বাস্তবতা বলছে ভিন্ন কথা। ২০০৪ সালে ওয়াসার গভীর নলকূপ ছিল ৪৪০টি, এখন তা হয়েছে ৫৬০টি। তবুও আমরা আশাবাদী। আশা ছাড়া বাঁচার আর কোনো পথ খোলা আছে কি!