Mahfuzur Rahman Manik
প্রাথমিক শিক্ষায় ঝরে পড়ার হার আসলে কত?
সেপ্টেম্বর 29, 2011


শিরোনামটা একটা প্রশ্ন। উত্তরটা শিক্ষা গবেষক, শিক্ষাবিদ বা সচেতন ব্যক্তিমাত্রই দিতে পারবেন। সবচেয়ে সঠিকভাবে উত্তর দিতে পারবেন সরাসরি এ নিয়ে যার কাজ— সরকারের প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী। মন্ত্রী মহোদয় উত্তরটা দিয়েছেন, কিন্তু তার উত্তর পেয়ে গণমাধ্যম সংশয় প্রকাশ করেছে তো বটেই, উল্টো এর সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে।
বিষয়টা খুলে বলা যাক। সম্প্রতি (২১ সেপ্টেম্বর) প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী আফছারুল আমীন তার মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে সংবাদ সম্মেলন করে মন্ত্রণালয়ের ২০১১-১২ অর্থবছরের বার্ষিক প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন। সংবাদ সম্মেলনে তিনি প্রাথমিক শিক্ষাসংক্রান্ত বিভিন্ন বিষয় তুলে ধরেছেন, তার মধ্যে ঝরে পড়া বা ড্রপ আউট অন্যতম। মন্ত্রী বিষয়টা নিয়ে এক নতুন আশ্চর্যজনক তথ্য দিয়েছেন— প্রাথমিক শিক্ষায় ঝরে পড়ার হার ২১ শতাংশ। সংবাদটি ২২ সেপ্টেম্বর বণিক বার্তাসহ, প্রায় প্রত্যেকটি জাতীয় দৈনিকে এসেছে। ‘২১’ এমন কোনো আহামরি সংখ্যা নয় যে তা নিয়ে বিস্ময় প্রকাশ করতে হবে। প্রশ্ন হলো, কিসের ভিত্তিতে মন্ত্রী এ তথ্য দিয়েছেন। অবশ্য মন্ত্রী মহোদয়ের সচিব বিষয়টার ন্যায্যতা প্রমাণের চেষ্টা করছেন— ‘এটা কোনো জাতীয় গণনা নয়, আমরা ৩৪ হাজার বিদ্যালয়ের তথ্য বিশ্লেষণ করে এটা পেয়েছি।’
বলার বিষয় হলো, বাংলাদেশ শিক্ষা তথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর (ব্যানবেইজ) সর্বশেষ (২০০৯) তথ্যমতে, দেশে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা ৮১ হাজার ৫০৮। ৩৪ হাজার যার অর্ধেকও নয়। সচিবের কথামতো এটা জাতীয় গণনাও নয়। অথচ এর ওপরই মন্ত্রী গোটা দেশের চিত্র বলে দিলেন!
সমস্যাটা আসলে এখানে নয়। সমস্যা হলো, শিক্ষামন্ত্রীসহ সরকারের কর্তাব্যক্তিরা সাম্প্রতিক সময়ে প্রায়ই বলে আসছেন, দেশে প্রাথমিকে ঝরে পড়ার হার ৪০ ভাগের ওপরে। এটাও তারা কোন গবেষণা থেকে পেয়েছেন জানি না। তবু এ সংখ্যাটা ধরলেও রাতারাতি ঝরে পড়ার হার ২১ শতাংশ তথা অর্ধেক হওয়ার মতো কোনো ঘটনা বাংলাদেশে ঘটেছে বলে কেউ জানে না। সরকার এ ক্ষেত্রে আলাদিনের চেরাগ বা এ জাতীয় কোনো কিছু পেয়েছে বলেও কোনো সূত্রে জানা যায়নি।
গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, প্রাথমিক শিক্ষায় ঝরে পড়ার হার নির্ণয়ে সর্বশেষ গবেষণা হয়েছে ২০০৮ সালে। ‘Participatory Evaluation : Causes of Primary School Drop-Out’ শিরোনামে গবেষণাটি করেছে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতর। গবেষণার প্রতিবেদনটি এখনো যে কেউ প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরের ওয়েবসাইট (http://www.mopme.gov.bd/index.php?option=com_content&task=view&id=482&Itemid=516) থেকে ডাউনলোড করে দেখতে পারেন। ২০০৯-এ গবেষণার প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। এখানে দেখানো হয়েছে, ৫০ দশমিক ৭ শতাংশ শিক্ষার্থী প্রাথমিক শিক্ষা সম্পন্ন করতে পারে, অর্থাত্ ঝরে পড়ার হার ৪৯ দশমিক ৩। এটা সরকারি গবেষণার ফল। এ ছাড়া বেসরকারি প্রতিষ্ঠান গণসাক্ষরতা অভিযানের এডুকেশন ওয়াচ প্রতিবেদন ২০০৮ অনুযায়ী, পঞ্চম শ্রেণী শেষ করতে পারে ৫০ দশমিক ১০ শতাংশ শিক্ষার্থী।
আলোচিত দুটি গবেষণার কোনোটিই ৪৯ শতাংশের কম শিক্ষার্থী ঝরে পড়ছে, এ কথা বলতে পারছে না। তবে দুই বছরে নিশ্চয়ই অবস্থার উন্নতি ঘটেছে। তাই বলে তা ২১ শতাংশ হয়ে গেছে, এটা অবিশ্বাস্য।
বিষয়টা আরও সহজ করে বোঝার জন্য গত বছর চালু হওয়া প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষাই যথেষ্ট। এ পরীক্ষা চালু হওয়ায় সহজেই প্রাথমিক শিক্ষার হিসাবটা বের করা সম্ভব। গত বছর ২৫ লাখ শিক্ষার্থী প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষার জন্য রেজিস্ট্রেশন করে। ২২ লাখ পরীক্ষায় অংশ নেয়। পাস করে ২০ লাখ শিক্ষার্থী। এ হিসাব থেকে আমরা দেখছি, পঞ্চম শ্রেণী থেকেই ৫ লাখ শিক্ষার্থী ঝরে গেছে। শতকরা হিসাবে এটা ২০ শতাংশ।
এ প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষার মাধ্যমেই গোটা প্রাথমিক শিক্ষার ঝরে পড়ার হার বের করা যায়। ব্যানবেইজের হিসাবে, এখন প্রাথমিক স্তরে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ১ কোটি ৬৫ লাখের কিছু বেশি। একে পাঁচটি শ্রেণীতে ভাগ করলে গড়ে ৩৩ লাখ। স্বাভাবিকভাবেই প্রথম শ্রেণীতে শিক্ষার্থী বেশি থাকে, ফলে এ শ্রেণীতে ৪০ লাখ ধরা যায়। সুতরাং প্রাথমিকের ৪০ লাখ শিক্ষার্থী থেকে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষাশেষে আমরা দেখলাম ২০ লাখ শিক্ষার্থী। তার মানে অর্ধেক শিক্ষার্থী ঝরে পড়েছে।
লক্ষ্যনীয় যে, বাংলাদেশে শিক্ষাসহ গুরুত্বপূর্ণ সকল বিষয়ে কেবল জরিপ টাইপের গবেষণা হয়, যার মাধ্যমে শুধু একটা সুপারফিসিয়াল তথ্য পাওয়া যায়। যেমন বাংলাদেশর শিক্ষার হার কত, কতভাগ মানুষ স্যানিটেশন পাচ্ছে কিংবা জনসংখ্যা কত। এ জাতীয় গবেষণা যার মাধ্যমে তথ্যটিই জানা যায়। এর বাইরে গুনগত মান পরিবর্তনে বিস্তর গবেষণা কমই হয়। উদাহরণত: গত বছর থেকে যে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী এবং জেএসসি পরীক্ষা শুরু হলো এর জন্য কোন গবেষণা হয়েছে বলে কেউ জানেনা। দুঃখের বিষয় হলো মাননীয় মন্ত্রীর বক্তব্যের মাধ্যমে জরিপ টাইপের গবেষণার দুর্দশা প্রমাণ করছে আর অন্য গবেষণার কথা নাইবা বললাম।
প্রাথমিক শিক্ষার সাম্প্রতিক ইতিবাচক পরিবর্তনের কথা মেনে নিয়েও বলছি। এতে ২১ ভাগে ঝরে পড়া নেমে আসার কথা নয়। সরকার দাবি করছে, বিদ্যালয় গমনোপযোগী (৬ থেকে ১০ বছর বয়সী) শিশুদের ৯৯ দশমিক ৪৭ শতাংশ এখন বিদ্যালয়ে যাচ্ছে। এ সংখ্যা নিয়েও যথেষ্ট সন্দেহ আছে। আবার কিছু দিন আগে সাক্ষরতা দিবসে (৮ সেপ্টেম্বর) এ মন্ত্রীই বলেছিলেন, সাক্ষরতার হার ৫৮ ভাগ— যদিও সরকারের গবেষণায় রয়েছে ৫৩। এ নিয়েও গণমাধ্যম সমালোচনা করেছে।
এভাবে সবকিছুর হারকে শুধু শুধু বাড়িয়ে বললে কাজের কাজ তো কিছুই হবে না। জনগণকে ফাঁকি দেয়া বা দাতাগোষ্ঠীকে এভাবে খুশি করার চেষ্টা আসলে বৃথা। এখন সবাই সচেতন। আর আন্দাজে বলাটা একদিকে যেমন প্রশ্নবিদ্ধ হয়, অন্যদিকে বিষয়গুলো হাস্যকর। মন্ত্রীদের এসব কাজ করার কোনো মানে হয় না।
প্রাথমিক শিক্ষাটা আমাদের দেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, এটা বলার অপেক্ষা রাখে না। এর জন্য পিইডিপি-৩ নামে ইতিহাসের রেকর্ড ২৩ হাজার কোটি টাকার একটা প্রজেক্ট বাস্তবায়নের অপেক্ষায়। ঠিক এ মুহূর্তে প্রাথমিক ও গণশিক্ষামন্ত্রীর ঝরে পড়ার এ রকম তথ্যে কতটা খারাপ প্রভাব পড়বে, বোদ্ধারাই বলতে পারবেন। তবে মন্ত্রীরা কি সাবধান হবেন না?

২৯ সেপ্টম্বর ২০১১

ট্যাগঃ

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।