Mahfuzur Rahman Manik
ইতিহাসের ধারায় এবারের শিক্ষানীতি:সরকারের বড় চ্যালেঞ্জ
মার্চ 24, 2010

ইতিহাসের ধারায় এবারের শিক্ষানীতি:সরকারের বড় চ্যালেঞ্জ (ৈদিনক েডসিটিন ০৯ িডেসম্বর ২০০৯ প্রকািশত)

মাহফুজুর রহমান মানিক
আমাদের ইতিহাসের সঙ্গে শিক্ষানীতির ইতিহাস ওতপ্রোতভাবে জড়িত। ১৭৫৭ সালে পলাশীর আম্রকাননে স্বাধীন বাংলার সূর্যাস্তের মধ্যদিয়ে যার সূচনা। ব্রিটিশরা এ সময়ে রাজত্ব পায়। শিক্ষানীতি/শিক্ষা কমিটি/শিক্ষা কমিশন কিংবা শিক্ষা ভাবনা অবশ্য আরো আগের। পৃথিবীর প্রথম মানব হযরত আদমকে (আ.) আল্লাহতায়ালা জ্ঞানে শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছেন, ফলে ফেরেস্তারা সেজদা করে আদমকে। বলা চলে শিক্ষার শুরুটা সেখানে। তবে জাতি হিসেবে, ভারতীয় উপমহাদেশের বাসিন্দা হিসেবে আমাদের ইতিহাসকে পনের শ’ শতক থেকে ধরি। ভারতীয় উপমহাদেশ ছিল অতুল ঐশ্বর্যে ভরপুর। পঞ্চদশ শতকের শেষ ভাগে এখানে আসে পর্তুগিজরা। ধীরে ধীরে আসে ওলন্দাজ, ফরাসি, ইংরেজ এবং দিনেমাররা। শুরুতে তাদের ব্যবসায়িক উদ্দেশ্য থাকলেও তারা শিক্ষা বিস্তারের কাজও শুরু করে। তাদের সঙ্গে আসে মিশনারি দল, যারা এ শিক্ষা বিস্তারের কাজ করে। ১৭৫৭ সাল পর্যন্ত যতদিন ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসেনি ততদিন এ মিশনারিরাই তাদের শিক্ষা ও ধর্ম বিস্তারের কাজ করে। এরপর ১৭৯২ সালে চার্লস গ্রান্টের শিক্ষা সংক্রান্ত সুপারিশ, ১৮১৩ সালে কোম্পানির শিক্ষা সনদ, ১৮৫৩ সালে লর্ড মেকলে কমিটি, ১৮৫৪ সালের চার্লস উডের শিক্ষা বিষয়ক ডেসপ্যাচ, ১৮৮২ সালের হান্টার কমিশন, ১৯৩৪ সালের সাপ্রু কমিটি এবং ১৯৪৪ সালের সার্জেন্ট কমিটি-ইত্যাদি ছিল ব্রিটিশ আমলের শিক্ষার নীতি/কমিটি/কমিশন। ইংরেজদের এসব শিক্ষা চিন্তা কখনোই আমাদের কল্যাণে ছিল না। তাদের পদানত জাতি হিসেবে ব্যবহারই ছিল মূল লক্ষ্য। এগুলোর মাধ্যমে আমাদের চিন্তা, চেতনা ব্রিটিশদের মতো করাও ছিল অন্যতম লক্ষ্য। এ ক্ষেত্রে লর্ড মেকলের শিক্ষার তত্ত্বটি প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেছেন- ডব সঁংঃ ধঃ ঢ়ৎবংবহঃ ফড় ড়ঁৎ নবংঃ ঃড় ভড়ৎস ধ পষধংং যিড় সধু নব রহঃবৎঢ়ৎবঃবৎং নবঃবিবহ ঁং ধহফ ঃযব সরষষরড়হং যিড়স বি মড়াবৎহ-ধ পষধংং ড়ভ ঢ়বৎংড়হং ওহফরধহ রহ নষড়ড়ফ ধহফ পড়ষড়ঁৎ নঁঃ ঊহমষরংয রহ ঃবংঃবং রহ ড়ঢ়রহরড়হং রহ সড়ৎধষং ধহফ রহঃবষষবপঃ.অর্থাৎ- এই মুহূর্তে এমন এক শ্রেণী সৃষ্টির ক্ষেত্রে আমাদের সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালাতে হবে যে শ্রেণী আমাদের এবং লাখ লাখ শাসিতদের মধ্যে ব্যাখ্যাকারীর ভূমিকা পালন করবে। এ শ্রেণী এমন এক শ্রেণী হবে যারা রক্তে ও বর্ণে হবে ভারতীয়। কিন্তু রুচি, অভিমত, নীতিবোধ ও বুদ্ধিবৃত্তিতে হবে ইংরেজ। এ ছিল ইংরেজদের শিক্ষা চিন্তা।ইংরেজ শাসনের অবসান ঘটিয়ে ১৯৪৭ এ ভারত ও পাকিস্তান দুটি রাষ্ট্রের উদ্ভব। বাংলাদেশ ছিল পূর্ব পাকিস্তান। এ পাকিস্তান আমলেও শিক্ষা নিয়ে নানা কমিটি ও কমিশন হয়। ১৯৪৯ সালের পূর্ববঙ্গ শিক্ষা পুনর্গঠন কমিটি, ১৯৫২ সালের মাওলানা আকরম খা কমিটি, ১৯৫৭ সালের আতাউর রহমান খানের এডুকেশন রিফর্ম কমিশন, ১৯৫৯ সালের নূর খান কমিশনের রিপোর্ট ইত্যাদি এর অন্যতম চিত্র। ইসলামী চেতনা নিয়ে গঠিত মুসলিম অধ্যুষিত পাকিস্তানে এসব শিক্ষা চিন্তায় সাধারণ শিক্ষাসহ মাদ্রাসা শিক্ষার বিষয়টিও উঠে আসে। কিন্তু বছর বছর কমিশন আর কমিটির তোড়ে তেমন কিছুই বাস্তবায়ন হয়নি। এ সময়ে ধর্মীয় বাধা, ভাষাগত বাধা এবং সুবিধাভোগীদের বাধার কারণে এসব রিপোর্ট বাস্তবায়ন হয়নি। ১৯৭১-এর ১৬ ডিসেম্বর স্বাধীন সাবভৌম দেশ হিসেবে বিশ্ব মানচিত্রে স্থান করে নেয় বাংলাদেশ। যে চেতনা নিয়ে, স্বপ্ন নিয়ে এ নবীন সূর্যের প্রকাশ, তার জন্য শিক্ষাও ছিল অপরিহার্য। ’৭১-এর স্বাধীনতার পরের বছরই ১৯৭২ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর বিজ্ঞানী ড. কুদরত-ই-খুদাকে প্রধান করে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম শিক্ষা কমিশন গঠন করা হয়। ১৯৭৪ সালে কমিশন প্রতিবেদন জমা দিলেও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হত্যাকা-ের পর ওই প্রতিবেদন বাক্সবন্দি হয়ে পড়ে। এরপর ১৯৭৯ সালে সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান শিক্ষা উপদেষ্টা কাজী জাফরের নেতৃত্বে জাতীয় শিক্ষা উপদেষ্টা কমিটি গঠন করে।১৯৮৩ সালে সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ, আব্দুল মজিদ খানের নেতৃত্বে শিক্ষানীতি ও ব্যবস্থাপনা কমিশন গঠন করলেও ছাত্র বিক্ষোভের মুখে এ কমিশন বাতিল হয়। ১৯৮৬ সালে মফিজউদ্দিন আহমেদের নেতৃত্বে শিক্ষা কমিশন গঠন করা হয়। স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের মুখে এ কমিশনও বাতিল হয়।১৯৯৩ সালে বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিএনপি সরকার প্রাথমিক ও শিক্ষাবিষয়ক টাস্কফোর্স গঠন করে। এর সভাপতি ছিলেন বিজ্ঞানী আব্দুল্লাহ আল- মুতী-শরফুদ্দিন। আওয়ামী লীগ সরকার এসে আবার ১৯৯৭ সালের ১৪ জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক শামছুল হকের নেতৃত্ব ৫৬ সদস্যের জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়ন কমিটি গঠন করে। সে বছরের সেপ্টেম্বরে কমিশন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে প্রতিবেদন জমা দেয়। এটি বাস্তবায়নে সুপারিশ মূল্যায়ন ও অর্থায়নের জন্য ১৯৯৮ সালে ড. নজরুল ইসলামের নেতৃত্বে তিন সদস্যের একটি কমিটি গঠিত হয়।২০০২ সালে বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোট সরকার রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য এমএ বারীর নেতৃত্বে শিক্ষা সংস্কার বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করে। চারদলীয় জোট সরকার ২০০২-এর ২১ অক্টোবর মন্ত্রিসভার বৈঠকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক মনিরুজ্জামান মিঞার নেতৃত্বে জাতীয় শিক্ষা কমিশন গঠনের সিদ্ধান্ত নেয়। ২০০৪ সালের মার্চে কমিশন প্রতিবেদন জমা দেয়।এ ছিল আমাদের শিক্ষানীতির ইতিহাস। যে সরকারই ক্ষমতায় এসেছে, সে সরকারই করেছে শিক্ষানীতি, শিক্ষা কমিশন। স্বাধীনতার ৩৮ বছরে গড়ে ৪টি করে রিপোর্ট তৈরি হয়েছে। সংখ্যাধিক্যের বিচারে রিপোর্টগুলো যতটা গর্বের, এর ইতিহাস কিন্তু ততটা সুখকর নয়। দেশের অর্থ, মেধাবীদের সময়ও শ্রম গেলেও আলোর মুখ দেখেনি একটি রিপোর্টও। রাজনৈতিক মতদ্বৈততা, সংকীর্ণ মন, সুদূরপ্রসারী চিন্তার অভাবেই রিপোর্টগুলো খসড়া রোগে আক্রান্ত হয়েছে।২০০৪ সালের মনিরুজ্জামান মিঞা শিক্ষা কমিশনের পর ২০০৬-এর চারদলীয় জোটের মেয়াদ শেষ হয়। ২০০৭-০৮ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতায়। ২০০৮-এর ২৯ ডিসেম্বর হয় নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচন। নির্বাচনপূর্ব ১৩ ডিসেম্বর ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ নির্বাচনী ইশতেহার ঘোষণা করে। ইশতেহারের ১০ নং পয়েন্টে শিক্ষা ও বিজ্ঞান শিরোনামে আওয়ামী লীগের শিক্ষা ওয়াদা বর্ণিত হয়। বলা হয় ১০.১ মানব উন্নয়ন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে শিক্ষা, বিজ্ঞান, ও তথ্য প্রযুক্তি খাতে সর্বোচ্চ বরাদ্দ দেয়া হবে। এ লক্ষ্যে যুগোপযোগী নতুন শিক্ষানীতি প্রণয়ন করা হবে। ২০১০ সালের মধ্যে প্রাথমিক স্তরে নিট ভর্তি ১০০ শতাংশে উন্নীত করা এবং ২০১৪ সালের মধ্যে দেশকে নিরক্ষরতামুক্ত করা হবে। শিক্ষার মানোন্নয়ন, শিক্ষাঙ্গনকে দলীয়করণমুক্ত, শিক্ষকদের জন্য উচ্চতর বেতন কাঠামো ও স্থায়ী বেতন কমিশন গঠন এবং স্বতন্ত্র কর্মকমিশন গঠন করা হবে। পর্যায়ক্রমে স্নাতক পর্যন্ত শিক্ষাকে অবৈতনিক সেবায় পরিণত করা হবে।১০.২ নারী শিক্ষা উৎসাহিত করার লক্ষ্যে উপবৃত্তি অব্যাহত রাখা হবে।১০.৩ শিক্ষাঙ্গন সন্ত্রাস, সেশনজটমুক্ত করা হবে। মাদ্রাসা শিক্ষাকে যুগোপযোগী করে তোলা হবে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি শিক্ষাকে বিশেষভাবে উৎসাহিত করা হবে। বিজ্ঞান চর্চা ও গবেষণাকর্মের সুযোগ বৃদ্ধি করা হবে।নির্বাচনী এ ওয়াদা মতে ক্ষমতায় এসেই আওয়ামী লীগ জাতীয় শিক্ষানীতি-২০০৯ কমিটি গঠন করে। জাতীয় অধ্যাপক কবীর চৌধুরীকে প্রধান করে এবং ড. কাজী খলীকুজ্জমানকে কো-চেয়ারম্যান করে মোট ১৮ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করে। এর মধ্যে অন্যতম সদস্য অধ্যাপক সিদ্দিকুর রহমান, অধ্যাপক মুহম্মদ জাফর ইকবাল। ৮ এপ্রিল-২০০৯ কমিটি ঘোষণা হয়। ৩ মে কমিটির প্রথম বৈঠক বসে। ২ সেপ্টেম্বর কাজ শেষ হয়। কাজ করে শিক্ষানীতি-২০০৯ এর চূড়ান্ত খসড়া শিক্ষামন্ত্রীর কাছে জমা দেয়। আরো পরে এসে খসড়াটি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ওয়েব সাইট িি.িসড়বফা.মড়া.নফ-তে দেয়া হয়। এখনও পিডিএফ ফরমে এ ওয়েব সাইটে আছে। ২৯টি অধ্যায় এবং সাতটি সংযোজনীর সমন্বয়ে করা হয় এ নীতি। খসড়া শিক্ষানীতি প্রকাশ করে এর ওপর পরামর্শ, মতামত জানানোরও সুযোগ দেয়া হয়। প্রথম ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত মতামত জানানোর সুযোগ ছিল, পরে অবশ্য অনেকের অবেদনের প্রেক্ষিতে ১৫ দিন সময় বাড়িয়ে ১৫ অক্টোবর পর্যন্ত রাখা হয়। এখন ডিসেম্বর মাস। এ ডিসেম্বরেই এ নীতি চূড়ান্ত হওয়ার কথা। জানুয়ারি-২০০৯ থেকে বাস্তবায়নের কাজে হাত দেয়ার কথা আছে। এবারের শিক্ষানীতি সরকারের একটি বড় চ্যালেঞ্জ। চ্যালেঞ্জ যেমন বাস্তবায়নের আবার জাতীয় ঐকমত্যেরও। ৮৮ ভাগ মুসলমানের দেশে এ নীতি কতটা জনসমর্থিত। কত ভাগ মানুষ সেক্যুলার শিক্ষানীতি চান সেটা দেখার বিষয়। শিক্ষানীতির সূচনাতেই এসে বিতর্কিত একটি বিষয়ের অবতারণা কখনোই বাস্তবসম্মত ছিল না। কারণ সেক্যুলার বললেও কিন্তু সেটা বাস্তবে ফলেনি। প্রাক-প্রাথমিকে যে মসজিদ, গির্জা, প্যাগোডার কথা বলা হয়েছে সেটা এর সাংঘর্ষিক। আমার মনে হয় শিক্ষানীতির চূড়ান্ত কপিতে সেক্যুলার শব্দটি অযথা রাখার প্রয়োজন নেই। এবারের শিক্ষানীতির প্রধান বৈশিষ্ট্যের কথা বললে প্রথমেই আসবে স্তরবিন্যাসের কথা। প্রাথমিক স্তর পঞ্চম শ্রেণী থেকে বাড়িয়ে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত করা। আর মাধ্যমিক শিক্ষাকে অষ্টম শ্রেণী থেকে দ্বাদশ শ্রেণী। এরপর উচ্চ শিক্ষা। মাঝখানের উচ্চ মাধ্যমিককে বাদ দিয়ে প্রাথমিকের প্রথম শ্রেণীর পূর্বে প্রাক প্রাথমিক স্তর বাড়ানো হয়েছে। এখন আমরা স্তরবিন্যাসে বলবো প্রাথমিক, মাধ্যমিক আর উচ্চ শিক্ষা। আরেকটু বলতে হবে প্রাথমিকের আগে রয়েছে প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা। শিক্ষার এ স্তরবিন্যাস বাস্তবে রূপ দেয়া সরকারের আরেকটি চ্যালেঞ্জ, এর সঙ্গে আবার আছে শিক্ষকদের বেকারত্বের ঝুঁকি। সরকারের অর্থায়ন এখানে বড় ভূমিকা পালন করবে। এটা ঠিক বাস্তবতা বলে এ স্তরবিন্যাস যথার্থ, তবে সেটা বাস্তবায়নের জটিলতা কম নয়। কারণ বিদ্যমান প্রতিষ্ঠানগুলোরই প্রয়োজনীয় অবকাঠামো, শিক্ষক, আসবাবপত্রের দারুণ সংকট। এগুলো কাটিয়ে উঠে নতুন করে স্তরবিন্যাস, দুটি স্তরের সমন্বয়সাধন যেমন ব্যয়বহুল তেমনি সময়সাধ্য ব্যাপার। তারচেয়ে বড় কথা হলো যে উদ্দেশ্যে প্রাথমিক শিক্ষাকে ৮ম শ্রেণী পর্যন্ত করা হবে সে উদ্দেশ্য কতটা সফল হবে, বাস্তবতা হচ্ছে প্রাথমিকে ভর্তি হওয়া অর্ধেক শিশুই পঞ্চম শ্রেণীর মধ্যে ঝরে পড়ে। এদেরকে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত টিকিয়ে রাখতে সরকারের যে কৌশল তা কতটা কার্যকর হবে।এবারের শিক্ষানীতি কমিটি গঠনের প্রাককালে এবং এর পরবর্তীতে একমুখী শিক্ষার অনেক তোড়জোর শুনেছি। আসলে একমুখী শিক্ষার ব্যাপারে গর্জন যতটা ছিল, বর্ষণটা সেভাবে পরিলক্ষিত হয়নি। প্রাথমিক শিক্ষায় মাদ্রাসার কথা আসলেও আসেনি ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের কথা। এখানে প্রাথমিক ও মাধ্যমিকে বাংলাদেশ স্টাডিজ বিষয়টি দিয়ে সমঝোতার চেষ্টা করা হয়েছে মাত্র। মাদ্রাসা শিক্ষার যুগোপযোগী করার সঙ্গে এর স্বকীয়তা রক্ষায় আন্তরিকতার অভাব রয়েছে। মাদ্রাসা শিক্ষায় ১ম ও ২য় শ্রেণীতে আবশ্যিক হিসেবে বাংলা, ইংরেজি, গণিত রাখা হয়েছে আর অতিরিক্ত হিসেবে আরবি রাখা হয়েছে, এখানে কুরআন রাখা অপরিহার্য। মাধ্যমিকে এসেও মাদ্রাসার কিছু বিষয় কমিয়ে ফেলা হয়েছে। স্কুলে ললিতকলা বিষয়টি দেয়ার ব্যাপারে অনেকেই দ্বিমত পোষণ করেছে। ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষা প্রাথমিকে আবশ্যিক হিসেবে আছে। অবশ্য মাধ্যমিকে সেভাবে নেই।উচ্চ শিক্ষায় আমাদের যে গবেষণার অভাব তার ওপর শিক্ষানীতিতে গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। কিন্তু চ্যালেঞ্জ হলো এ গবেষণার জন্য যা প্রয়োজন, যে বাজেট দরকার সরকার তার কতটা দিবে। ভোকেশনাল শিক্ষা, কৃষি শিক্ষা তথা বাস্তবমুখী শিক্ষার বিষয়টিও শিক্ষানীতিতে গুরুত্বের সঙ্গে উঠে এসেছে। এর জন্য প্রয়োজনীয় প্রতিষ্ঠান নির্মাণ, প্রয়োজনীয় অবকাঠামো আর শিক্ষক সংকট সরকারের বড় চ্যালেঞ্জ। মোদ্দাকথা হলো গোটা শিক্ষানীতিতে ভালো চিন্তার অভাব ছিলো না। কিন্তু এসব কিছুর বাস্তবায়ন আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে সরকারের জন্য চ্যালেঞ্জই বটে। আমরা ২০১২ সালের মধ্যে প্রাথমিক শিক্ষায় শিক্ষার্থী ১০০ ভাগ ভর্তি করাতে পারবো কি না, ৪৭ ভাগ নিরক্ষর মানুষকে অক্ষরজ্ঞান বা সাক্ষর করতে আমাদের কতদিন প্রয়োজন সেটা মৌলিক প্রশ্ন। ডিজিটাল বাংলাদেশের কথাই বলি আর স্বপ্নের বাংলাদেশের কথাই বলি, আমরা বাংলাদেশকে একটি পর্যায়ে নিয়ে যেতে চাই। এজন্য প্রথম প্রয়োজন শিক্ষা। আর শিক্ষার জন্য প্রয়োজন শিক্ষানীতি। এটা সত্য যে জাতি হিসেবে আমাদের স্বাধীন সার্বভৌম দেশ নিয়ে আমরা ৩৮ বছর অতিক্রম করছি, অথচ আমাদের এ পর্যন্ত নির্দিষ্ট কোনো শিক্ষানীতি নেই। এ পর্যায়ে এসে আমাদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে আগামী দিনে বা আগামী কত দিনে দেশকে কোন পর্যায়ে নেব। চলমান বিশ্ব প্রেক্ষাপট কেমন। প্রযুক্তির, জ্ঞানের, মেধার, প্রতিযোগিতার বর্তমান বাজার বিরূপ। আগামী ১০০ বছর পর এটা কোন পর্যায়ে পৌঁছবে। আমাদের বাধা কি কি। প্রাধান্যের ক্ষেত্র কোনগুলো ইত্যাদি ভেবে একটি সুচিন্তিত, সুদূরপ্রসারী শিক্ষানীতি প্রয়োজন। সে ক্ষেত্রে এ শিক্ষানীতি ঠিক কতটা উপযোগী, এর বাস্তবায়ন কতটা সহজসাধ্য কিংবা কঠিন, কতদিনে বাস্তবায়ন হবে, বাস্তবায়ন হলে আদৌ কোনো পরিবর্তন হবে না ইত্যাদি ভেবেই এটা চূড়ান্ত করা দরকার। শিক্ষানীতিতে বাস্তবায়নের রোডম্যাপ ২০১৮ সাল পর্যন্ত রাখা হয়েছে। এত দীর্ঘ সময় ধরে বাস্তবায়নের যৌক্তিকতা আছে বটে কিন্তু সেটা পারতপক্ষে আমাদের কতটা ফল দেবে তা দেখতে বাস্তবায়নে যত চ্যালেঞ্জই থাকুক তার মোকাবিলায় প্রথমে প্রয়োজন জাতীয় ঐকমত্য। এ জন্য শিক্ষানীতি চূড়ান্ত করার ক্ষেত্রে জাতির মতামত ও পরামর্শগুলো গ্রহণ করা দরকার। আমরা ঐকমত্যে পৌঁছলে যে সরকারই আসুক সেটা বাস্তবায়ন করতে বাধ্য থাকবে শিক্ষানীতি বা কমিটি/কমিশনগুলোর অতীত ইতিহাস কখনোই সুখকর ছিল না। অতীতের দিকে না তাকিয়ে এবারের শিক্ষানীতি দ্রুত বাস্তবায়নে হাত দিতে হবে। অবশ্য সূচনাটা এবারের ভালোই- মাত্র তিন মাসে রিপোর্ট জমা দিয়েছে কমিটি, যদিও শেষ দু’সপ্তাহ অনেক কষ্ট করেছেন সদস্যরা। সরকারও ক্ষমতায় এসেই ৯ মাসের মধ্যেই জাতিকে খসড়া শিক্ষানীতি উপহার দিয়েছেন। প্রথম থেকে সরকারের এ নীতি বাস্তবায়নে দৃঢ়কণ্ঠ রয়েছে। শিক্ষাখাতে সামনে বরাদ্দের পরিমাণ আরো বাড়িয়ে ডিসেম্বরের শেষ নাগাদ চূড়ান্ত শিক্ষানীতি প্রকাশ করে। জানুয়ারি-২০১০ থেকে বাস্তবায়নের কাজ দিলে সরকার তার চ্যালেঞ্জে সফল হবে বলে মনে হয়।

ট্যাগঃ

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।