প্রথম আলোতে প্রকাশিত ওয়াসিম ভাইয়ের গল্পের একাংশ |
গুগলে সার্চ দিয়ে দেখলাম ফ্রেন্ডশীপ ডে মানে অনেকে যাকে বন্ধু দিবস বলেন সেটা কবে। আগস্ট মাসের প্রথম রোববার। কিছুটা বিব্রতই হলাম, এখন আবার ২০০৯ এর দিনটা বের করতে হবে; দেখলাম ২ আগস্ট ২০০৯। দিনটা বের করা খুব জরুরী ছিলো কিনা জানিনা তবে প্রাসঙ্গিকতা অস্বীকার করার জো নেই। তখন আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় বর্ষ শেষ হওয়ার পথে। লেখালেখির ঝোঁকটা মাথায় আরো আগ থেকেই । তো সেদিন আসলে বন্ধু দিবস ছিলো কি-না জানিনা, সেদিন অথবা তার আগের কিংবা পরের দিন বা সে সপ্তাহই হবে। দিনটি উপলক্ষে সাপ্তাহিক-২০০০ বিশেষ আয়োজন করে। বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মের বন্ধুত্বের স্মৃতি টাইপের কিছু ছিলো। দেখেই কিনে ফেললাম।
হলে নিয়ে এসে রাতে পড়তে লাগলাম। পড়তে পড়তে হঠাৎ বুয়েটের একজনের লেখা পেলাম। পড়ে বেশ ভালোই লাগলো। সেসময় প্রায় প্রত্যেকের লেখার নিচে নাম্বারও দেয়া ছিলো। বুয়েট দেখে বিছুটা কৌতুহল হলো। লেখাটি ভালো লেগেছে বলে একটা এসএমএস পাঠিয়ে দিলাম। কিছুক্ষনের মধ্যেই রিপ্লাই পেলাম, বুঝলাম আসলে নাম্বারটা ভুয়া না। এরপর কয়েকটি এসএমএস। ফোন আর এসএমএস চালাচালি ভালোই চলছিলো। বিশেষ করে আমার লেখা পত্রিকায় আসলে আমি জানাতাম, তখন পাঠকদের জায়গাগুলোতেই লিখতাম। উনিও দেখে রিপ্লাই দিতেন। বেশ প্রশংসা করে রিপ্লাই করতেন। জানিনা প্রশংসা করার মতো আদৌ কোন লেখা ছিলো কি-না। হঠাৎ একদিন প্রায় সকালে তার ফোন পেলাম ‘প্রথম আলো সাহিত্য পাতায় আমার একটা গল্প ছাপা হয়েছে, দেখবেন’। প্রথম আলো আমাদের রুমে রাখা হয়, সুতরাং গল্পটা ওইদিনই পড়ে ফেলি। আমার কয়েকজন রুমমেটকেও পড়াই। বেশ ভালো গল্প। কিছুটা অবিশ্বাস্য। বর্ষার রাতে শিরোনামে গল্পটা এখন খুজে দেখলাম প্রকাশ হয়েছে ৪ ডিসেম্বর ২০০৯। তাকে জানালাম খুব সুন্দর লিখেছেন।
ওয়াসিম ভাইয়ের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার শুরু এভাবেই। জাহের ওয়াসিম নামে লিখতেন; পুরো নাম আবু জাহের ওয়াসিম। লিখতেন শব্দটা ব্যবহার করলাম। আসলে অনেক দিন তিনি কিছু লিখেননি। একদিন জিজ্ঞেস করলাম লিখেন না কেন- ‘রাইটার্স ব্লকে ভুগছি’ তার উত্তর। টার্মটা আমি তার কাছ থেকেই শিখেছি। জানি না সেটা তিনি কবে উতরাবেন, আবার কবে লিখবেন। তার কয়েকটা কবিতা দেখেছি, আমার মনে হয় গল্পের চেয়ে কবিতাই তিনি ভালো লিখেন।
আমার কাছে তিনি ওয়াসিম ভাই-ই। যদিও তিনি আমার চেয়ে এক বছরের জুনিয়র। বুয়েটে সিভিলে ভর্তি হয়েছেন ২০০৭-০৮ ব্যাচে। তার সঙ্গে দেখা হওয়ার আগে ফোনে স্বভাবসুলভ ভাইটা-ই প্রচলিত হয়ে গেছে। আমাকে বলেন- মাহফুজ ভাই। অথচ আমার গোটা ইউনিভার্সিটি লাইফে আড্ডা বলতে যা বুঝায় সবটাই তার সঙ্গে। যদিও আমি আড্ডাবাজ নই। তার খাতিরেই আমাদের টিএসএসসি, বুয়েটের ক্যাফেটেরিয়া, বুয়েট ক্যাম্পাসে আড্ডা হয়েছে। আমার যখন ল্যাপটপ ছিলো না, তার রুমে গিয়েই লিখতাম। সুবিধা ছিলো উনি আমার হলের পাশেই আহসান উল্লাহ হলে থাকতেন। আমি সলিমুল্লাহ মুসলিম হলে থাকি বলে, উনি বলতেন আপনাদের সলিমুল্লাহ কিন্তু আমাদের আহসান উল্লাহর ছেলে। অনেক সময় লেখার কাজ বেশি থাকলে তার রুমেও রাত কাটিয়েছি।
ওয়াসিম ভাইকে দেখতাম অনেকের লেখা নিয়েই সমালোচনা করতে, কিন্তু পত্রিকায় প্রকাশ হলে যখনই বলতাম আমার লেখাটা দেখেন, বলতেন বেশ ভালো হয়েছে। তার সঙ্গে আবার অনেক জায়গায় ঘুরেছিও, যেমন একবার আমরা পদ্মার পাড়ে গিয়ে বেশ মজা করেছি। পরস্পর ভাই সম্বোধন করলেও আমরা কিন্তু বন্ধুই। একবার বিজয় দিবসে আমরা সাভার স্মৃতিসৌধে গেলাম। লেখালেখি সূত্রেই এক নেপালি বন্ধু হয়েছিলো আমার সাভার গনবিশ্ববিদ্যালয়ে। ওয়াসিম ভাই বলতেন ওরা কিন্তু ‘গঞ্জিকা সেবন করে’ , সেদিন গণবিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে ঠিকই তিনি গঞ্জিকা উদ্ধার করলেন। দু’জন যখন সিগেরেটের মত টানছিলেন, জিজ্ঞেস করলেন- টানবেন নাকি? না। না, দু’জনের অনুরোধেও সেটা সেবন করা হয়নি। তবে বইমেলা আসলে সবচেয়ে মজা হতো। বইমেলায় ওয়াসিম ভাইয়ের সঙ্গে যাওয়ার মজাটাই অন্যরকম।
ওয়াসিম ভাইকে অনেক সময় পাওয়া কষ্টকর ছিলো। বিশেষ করে শনিবার থেকে বুধবার। যেহেতু এসময় তাদের ক্লাস, ল্যাব ইত্যাদি থাকতো। তার জন্য বৃহস্পতিবারটা অপেক্ষা করতাম। এরকম কত বৃহস্পতিবার যে অপেক্ষা করেছি। আসলে ভার্সিটিতে তিনি ছাড়া আর কারো সঙ্গে সময় কাটাইনি। অভ্যস্তও ছিলাম না। উনাদের যখন পরীক্ষা হয়ে যেতো তখন বেশ গ্যাপ থাকতো। ওয়াসিম ভাই আমার রুমেও আসতেন। রুমে আসলে তো রুমমেট একেকজন একেক বিষয় নিয়ে আসতো। কারও কম্পিউটারটা সেট আপ দিতে হবে, কারও ল্যাপটপটায় একটু সমস্যা, ঠিক করে দিতে হবে। কারও আবার অঙ্কে সমস্যা, দেখিয়ে দিতে হবে। আমিও ওয়াসিম ভাইয়ের কাছে অনেক অঙ্ক, বিজ্ঞান ফ্রি ফ্রি শিখেছি। ধৈর্য্য ধরে তিনি সব বুঝাতেন।
কাছাকাছি থাকলেও ভার্চুয়াল যোগযোগটা আমার ওয়াসিম ভাইয়ের সঙ্গেই বেশি। ফেসবুকে তো সেকেন্ডে সেকেন্ডে আপডেট। আমার ব্লগস্পটের প্রথম সাইটটা তিনিই করে দিয়েছেন। অনলাইনের অনেক কিছুই আমি তার কাছ থেকে শিখেছি। ওয়াসিম ভাইয়ের শিখনোর ধৈর্য্য ব্যাপক। তার কিন্তু অনেক ছাত্র। বিভিন্ন কলেজের ছেলেরা তার রুমে এসে পড়তো।
নানা সময় আবার ওয়াসিম ভাইকে ডিস্টার্বও দিয়েছি। যেমন তার পরীক্ষা, অথচ আমি তার রুমে হাজির। তিনি কিন্তু একটুও বিরক্তবোধ করেন নি।
বুয়েটে মাঝখানের ঝামেলা না হলে ওয়াসিম ভাইদের কিন্তু গ্রাজুয়েশন শেষ হয়ে যেতো। একটা অসিলায় হলেও বেশিদিন ক্যাম্পাসে থাকছেন, সেটা আমার জন্য ভালো।
ওয়াসিম ভাইকে নিয়ে আসলে পুরো তিন বছরে নানান বিচিত্র স্মৃতি রয়েছে। সব লিখাও সম্ভব নয়। তার সঙ্গে কিন্তু কোনোদিন কোনো বিষয়ে আমার ঝগড়া হয়নি। কয়েকমাস আগে আমি বাড়ি ছিলাম তখন অনেক কষ্টে তিনি আমাদের বাড়িতে গিয়েছিলেন। নদীতে আমরা নৌকা নিয়ে বেশ মজা করেছিলাম।
কেউ যদি আমাকে প্রশ্ন করে, ইউনিভার্সিটি লাইফে আপনার বেস্ট ফ্রেন্ড কে? বলবো জাহের ওয়াসিম। ওয়াসিম ভাইকে একবার আমার বিষয়ে একজন জিজ্ঞেস করেছিলো তার গার্ল ফ্রেন্ড নাই, উনি প্রেম করে না? জবাবে তিনি বলেছিলেন করে- আমাদের সাথে।
কিছুদিন আগে আমার জন্মদিনে ওয়াসিম ভাই একটা টি-শার্ট নিয়ে আমার রুমে হাজির। আমার সে যে কী অনুভূতি বোঝাতে পারবো না। আজ তার জন্মদিন। ভালো থাকবেন ওয়াসিম ভাই।
২০১২ ওয়াসিম ভাইয়ের জন্মদিনে লেখা ফেসবুক নোট