Mahfuzur Rahman Manik
বর্ষসেরা বাংলাদেশের জন্য ইকোনমিস্টের বার্তা
জানুয়ারি 3, 2025

জুলাইয়ে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের শেখ হাসিনা সরকারের পতন দেশে তো বটেই, আন্তর্জাতিকভাবেও যে বিরল ঘটনা, দি ইকোনমিস্টের মতো প্রভাবশালী সংবাদমাধ্যম বাংলাদেশকে ‘কান্ট্রি অব দ্য ইয়ার’ ঘোষণার মধ্য দিয়ে প্রমাণ হয়। এর কারণও জানিয়েছে পত্রিকাটি। এ সংক্রান্ত প্রতিবেদনের উপশিরোনামে তারা লিখেছে, স্বৈরাচারের পতন ঘটিয়েছে বিজয়ী (দেশ) এবং দৃশ্যত ভালোর দিকে যাত্রা শুরু করেছে। প্রতিবেদনের শুরুতেই বলা হয়েছে, প্রতি বছর ডিসেম্বরে ইকোনমিস্ট বর্ষসেরা দেশ বাছাই করে। বর্ষসেরা হতে গেলে এমন নয় যে, বিজয়ী দেশটিকে সবচেয়ে ধনী হতে হবে বা সবচেয়ে সুখী দেশ হবে; পবিত্র কোনো ভূমি হওয়ারও দরকার নেই। বরং গত ১২ মাসে যে দেশটি সবচেয়ে বেশি উন্নতি করেছে, সেটিই বর্ষসেরা।

ইকোনমিস্টের প্রতিবেদনে এটাও স্পষ্ট যে, চব্বিশের বর্ষসেরা দেশ হওয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সিরিয়াকেও টপকে যায়। যে সিরিয়ার স্বৈরাচারী শাসক বাশার আল-আসাদের দুই যুগের শাসনের শেষ যুগের প্রায় সময়জুড়ে গৃহযুদ্ধে নিপতিত হয় দেশটি। যার কারণে পাঁচ লক্ষাধিক মানুষ প্রাণ হারায়। লাখ লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়। সিরিয়া পরিণত হয় এক অকার্যকর রাষ্ট্রে; যেখানে পশ্চিমা বিশ্ব ও রাশিয়া উভয়ের কুরুক্ষেত্রে পরিণত হয় সিরিয়া। সেই সিরিয়া থেকেও স্বৈরাচারী ও নিষ্ঠুর শাসক বাশার আল-আসাদ শেষ পর্যন্ত পালিয়ে যেতে বাধ্য হন।

স্পষ্টতই ইকোনমিস্ট সিরিয়া থেকে বাংলাদেশের ঘটনাপ্রবাহকে বেশি গুরুত্ব দিয়েছে এবং বর্ষসেরার তালিকায় বিজয়ী করেছে। তবে বাংলাদেশের পরের স্থানটি সিরিয়ার। দি ইকোনমিস্ট তার প্রতিবেদনে এটাও উল্লেখ করেছে যে, বর্ষসেরা দেশ বাছাইয়ের ক্ষেত্রে সংবাদমাধ্যটির সাংবাদিকদের মধ্যে বেশ ভালো বিতর্ক হয়। চূড়ান্ত তালিকায় বাংলাদেশ ও সিরিয়া ছাড়াও ছিল পোল্যান্ড, দক্ষিণ আফ্রিকা ও আর্জেন্টিনা।
ইকোনমিস্টের তালিকায় বাংলাদেশের শীর্ষে উঠে আসা যত বড় ঘটনা, তার চাইতে চমকপ্রদ ছিল সরকার পতনের আন্দোলন। জুলাইয়ের মধ্যভাগেই হয়তো কেউ ভাবতে পারেনি হাসিনা সরকারের এভাবে পতন ঘটবে। কেবল শেখ হাসিনাই ভারতে আশ্রয় নিয়েছেন তা নয়, তার দলের শীর্ষ পর্যায়ের নেতা হতে সারাদেশের এমপিরা, উপজেলা পর্যায়ের নেতাকর্মী, এমনকি ইউনিয়ন পর্যায়েরও অনেক নেতা আত্মগোপনে চলে যান। ছাত্রদের আন্দোলনে বলপ্রয়োগের ফলে যে হত্যাকাণ্ড ঘটে, যেভাবে পুলিশের গুলিতে ছাত্ররা চোখসহ অন্যান্য অঙ্গপ্রত্যঙ্গ হারায় তা স্বাভাবিকভাবেই কেউই মেনে নিতে পারেনি। বৈষম্যবিরোধী ছাত্রদের আন্দোলন যখন তুঙ্গে, তখন তাদের সামাজিক মাধ্যমেও তারা একধরনের জোয়ার তৈরি করতে সক্ষম হয়।

তারা যখন প্রোফাইলের ছবি বদল করে লাল করার নির্দেশনা দেয়, তখন ফেসবুকে ঢুকলেই দেখা যেত সব লালে লাল দুনিয়া।
শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সর্বস্তরের মানুষের এমন স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণের কারণেই সরকার পতন সম্ভব হয়েছিল। এর পরই আওয়ামী লীগ আমলের বাস্তবচিত্র সংবাদপত্রগুলোতে ফুটে ওঠে। এতদিন যেসব সংবাদ প্রকাশের কথা কল্পনাও করা যায়নি, সেগুলো মানুষের দেখার সুযোগ হয়। কীভাবে দেশের অর্থ লুট হয়েছে, কীভাবে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে উন্নয়নের বয়ান প্রচার করা হয়, সেগুলোও সামনে আসে। আয়নাঘরসহ নানা টর্চার সেল, গুম-খুনের চিত্রও মানুষ দেখতে পায়। অনেকে দেড় দশক ধরে যে দমবন্ধকর পরিস্থিতির মধ্যে বাস করছিল, সেখান থেকে স্বস্তি আসে। মানুষের এই বিজয়কেই বস্তুত সম্মান করে দি ইকোনমিস্ট বর্ষসেরা দেশ হিসেবে নির্বাচিত করেছে বাংলাদেশকে।

৫ আগস্ট সরকার পতনের পর ৮ আগস্ট থেকে যাত্রা শুরু করে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার। সমুদ্রসম চ্যালেঞ্জ সরকারের সামনে এসে পড়ে। পুলিশ বাহিনী যেভাবে দলীয়করণের শিকার হয়েছিল, সে কারণে নির্যাতনকারী অনেক পুলিশ অফিসার গা ঢাকা দিতে বাধ্য হয়; ফলে থানাগুলো জনতার নিশানায় পরিণত হয়।
অন্তর্বর্তী সরকার আসার পর পুলিশ বাহিনী নিরাপত্তার সংকটে কর্মবিরতি পালন করে। শেষ পর্যন্ত অবশ্য তারা কাজে যোগদান করে। অর্থাৎ অন্তর্বর্তী সরকার শুরুতেই আইনশৃঙ্খলার সংকটে পড়ে। পরিস্থিতির উন্নতি ঘটলেও সেই সংকট এখনও রয়ে গেছে। ইকোনমিস্টের প্রতিবেদনে আইনশৃঙ্খলা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেছে ও অর্থনীতি স্থিতিশীল করার কথা উল্লেখ করে।
অবশ্য অন্য সংকটের কথাও বলা হয়েছে। যেমন– দেশের প্রধান বিরোধী দল বিএনপিকে ‘দুর্নীতিপরায়ণ’ বলা হয়েছে। তাছাড়া ‘ইসলামী চরমপন্থা’ হুমকি হিসেবে উল্লেখ হয়েছে। তারপরও তারা পরিবর্তনকে আশাব্যঞ্জক হিসেবে দেখছে, যেখানে শান্তিতে নোবেলজয়ী অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। ইকোনমিস্ট বর্ষসেরা বলেই ক্ষান্ত হয়নি। তার কিছু প্রত্যাশার কথা বলেছে প্রতিবেদনে। প্রতিবেশী হিসেবে ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক ঠিক করার তাগিদ এসেছে। নির্বাচনের তারিখ নির্ধারণের কথাও সংবাদমাধ্যমটি উল্লেখ করেছে। আদালতে যাতে নিরপেক্ষ আচরণ করতে পারে তাও বলা হয়েছে।

আমরা দেখছি, ইউনূস সরকার পরবর্তী গণতান্ত্রিক উত্তরণের লক্ষ্যে এরই মধ্যে কয়েকটি সংস্কার কমিশন গঠন করছে। এরই মধ্যে মূল্যস্ফীতিসহ নানা সংকট সরকারকে মোকাবিলা করতে হচ্ছে। নির্বাচনের বিষয়ে অন্তর্বর্তী সরকার এরই মধ্যে সম্ভাব্য তারিখ ঘোষণা করেছে। যদিও নির্বাচন আগানোর দাবি রয়েছে বিএনপির তরফ থেকে। ইকোনমিস্টের মোদ্দাকথা হলো, ‘অত্যাচারী শাসকের পতন ঘটানো এবং আরও উদার সরকার গঠনের পথে হাঁটার জন্য বাংলাদেশ আমাদের এ বছরের সেরা দেশ।’
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের কারণেই দি ইকোনমিস্টের স্বীকৃতি এসেছে। সেই কারণেই আমাদের দায়িত্ব হলো আগামী দিনে এমন বাংলাদেশ তৈরি করা, যেখানে অত্যাচারী শাসকের উদ্ভব যেন না ঘটে।

সমকালে প্রকাশ: ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪

ট্যাগঃ ,

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।