
সাংবাদিক গোলাম রব্বানী নাদিম হত্যায় আলোচিত মাহমুদুল আলম বাবুর সৌভাগ্য বটে! ক্ষমতার একাধিক মাধ্যম তাঁর। ওইসব মাধ্যম তাঁকে রাজমিস্ত্রি কিংবা মুদি দোকানি থেকে অঢেল সম্পদের অধিকারী বানিয়েছে। বর্তমান সময়ে রাজনীতি যে অনেকের জন্য আলাদিনের চেরাগ হিসেবে কাজ করেছে; সেখানেও রয়েছেন এই বাবু। তাঁর চাচাতো ভাই পুলিশের বড় কর্মকর্তা হওয়ায় সেই প্রভাবও খাটিয়েছেন। তদবির ও নিয়োগ বাণিজ্য, থানায় দালালি, বিচার-সালিশের মাধ্যমে অর্থযোগ কিংবা ডলারের কারবারসহ নানা মাধ্যমে অর্থ পাওয়ার পথে তাঁকে সাহায্য করেছে সেই প্রভাব।
সাংবাদিক গোলাম রব্বানী নাদিম হত্যার প্রধান আসামি হিসেবে ইতোমধ্যে বাবুকে পাঁচ দিনের রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে। অনলাইন পোর্টাল বাংলানিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের জামালপুর জেলা প্রতিনিধি এবং একাত্তর টিভির বকশীগঞ্জ উপজেলা প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করছিলেন গোলাম রব্বানী। প্রধান আসামি বাবু যেমন বকশীগঞ্জের সাধুরপাড়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান, তেমনি ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকও বটে। সাংবাদিক তাঁর পেশাগত দায়িত্ব পালনকালে স্বাভাবিকভাবেই অনেকের বিরাগভাজন হন।
বাংলাদেশের সাংবাদিকরা, বিশেষ করে মফস্বল সাংবাদিকরা এদিক থেকে অনেক বেশি ঝুঁকিতে থাকেন। সে জন্য অধিকাংশ সময়ে দেখা যায়, স্থানীয় প্রভাবশালীদের সমীহ করে চলেন। এমনকি তাঁদের অনেক অপরাধ জানা সত্ত্বেও সেগুলোকে খবর করেন না। এঁদের মধ্যে যাঁরা ব্যতিক্রম, তাঁরা ঝুঁকি নিয়েই সত্য প্রচার করেন। এঁরাই ক্ষমতার রোষানলে পড়েন। দুঃখজনক বিষয় হলো, সাংবাদিক নির্যাতন কিংবা হত্যার পর বিচারের ক্ষেত্রে নানা দীর্ঘসূত্রতা দেখা যায়। আমরা দেখেছি, সমকালের শাহজাদপুর প্রতিনিধি সাংবাদিক আব্দুল হাকিম শিমুল হত্যাকাণ্ডের পাঁচ বছর পেরিয়ে গেলেও বিচার পায়নি তাঁর পরিবার। ২০১৭ সালে শাহজাদপুরের সে সময়ের মেয়র হালিমুল হক মিরুর বাড়ির সামনে আওয়ামী লীগের দু’পক্ষের সংঘর্ষে সাংবাদিক শিমুল গুলিবিদ্ধ হন। পরদিন ৩ ফেব্রুয়ারি উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকায় নেওয়ার পথে তিনি মারা যান। শিমুলের মৃত্যুর কয়েক দিন পর মেয়র হালিমুল হক মিরুকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে। কিন্তু ২ বছর ৯ মাস কারাভোগের পর তিনি জামিনে রয়েছেন।
রোববার সমকালে প্রকাশিত ‘ব্যক্তিগত প্রতিহিংসা থেকে হত্যার ছক’ শিরোনামের খবরে আমরা দেখছি, ফেসবুক লাইভে এসে প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে জীবনের নিরাপত্তা চেয়েছিলেন সাংবাদিক গোলাম রব্বানী। এর পরও তাঁর নিরাপত্তায় কোনো ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এ ব্যাপারে কিছু জানবে না– এটা বিস্ময়কর। আমরা জানি, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন বিভাগ-অনুবিভাগ রয়েছে। তা ছাড়া আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দক্ষতা সম্পর্কেও আমরা গর্ব করি। কিন্তু লাইভে এসে একজন সাংবাদিক যদি জীবনের নিরাপত্তা চান, তা না দেখার ভান করা হতাশাজনক।
আসামিদের রিমান্ডে নেওয়া হলেও অতীতের ঘটনাবলি আমাদের শঙ্কিত করে। আমরা জানি না, আদৌ মাহমুদুল আলম বাবুর বিচার হবে কিনা! বাবু যে উপায়ে ক্ষমতাবান হয়েছেন, তিনি জেল থেকে বেরুতে পারলে হয়তো তাঁর আরও বড় নেতা হওয়া বিস্ময়কর নয়। আমরা দেখেছি, কীভাবে সময়ে সময়ে তিনি রাজনীতিতে ভোল পাল্টে ফেলেন। তিনি ছাত্রজীবনে জাতীয় পার্টির ছাত্র সংগঠন জাতীয় ছাত্রসমাজ করলেও পরে ভিড়েছিলেন বিএনপিতে। ওয়ান-ইলেভেনের সময় ভোল পাল্টে রাজনীতি ছাড়েন। ২০১১ সালে আওয়ামী লীগে যুক্ত হন। আওয়ামী লীগে যোগ দিয়েই তিনি সাধুরপাড়া ইউপি নির্বাচনে অংশ নেন। ওই নির্বাচনে জিততে না পারলেও পরে ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের পদ পান এবং ২০১৬ ও ২০২২ সালে জামালপুরের বকশীগঞ্জের সাধুরপাড়া ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের টিকিটে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন।
বাংলাদেশের বর্তমানকালের কোনো কোনো রাজনৈতিক নেতার উত্থানের ইতিহাস এই বাবুর সঙ্গে মিলে যায়। অপরাধ, টাকা, ক্ষমতা একাকার করতে পারলেই যেন নেতা হওয়ার যোগ্যতা আসে। নাদিম হত্যাকাণ্ডে এ সত্যই আবার প্রমাণিত হলো।
গোলাম রব্বানী নাদিমের হত্যাকাণ্ড বলছে, আঞ্চলিক পর্যায়ে রাজনৈতিক বন্দোবস্ত কতটা অপরাধমূলক হয়ে গেছে! আমাদের মফস্বল সাংবাদিকতা কতটা বিপজ্জনক পর্যায়ে পৌঁছেছে! তবে তাঁর মৃত্যু এও বলছে– এখনও সেই সাংবাদিকতা রয়েছে, যেখানে কারও কাছে নত না হয়ে সত্য প্রকাশ করা যায়; যেখানে সত্য প্রকাশে বাবুর মতো ক্ষমতাবানদের বিরুদ্ধেও দাঁড়ানো যায়; যেখানে হুমকি-ধমকিতেও কীভাবে অনড় থাকতে হয়। বিপজ্জনক এ পথ থেকে সাংবাদিকতাকে বের করে আনার দায়িত্ব কিন্তু রাষ্ট্র ও সরকারের।