মধ্য ডিসেম্বরের এক দুপুরে কক্সবাজারের উখিয়ার বালুখালী রোহিঙ্গা শিবির থেকে আমাদের গাড়ি পাহাড়ের বুক চিরে এগিয়ে চলছিল কুতুপালং রোহিঙ্গা শিবিরের দিকে। দু'পাশে সারি সারি পাহাড়। সেই পাহাড়ের ওপর গড়ে উঠেছে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর বসতি। পাহাড়ের ওপর কোথাও সবুজ গাছের সারি। মূলত ওই এলাকাজুড়েই ছিল সংরক্ষিত বন। সেই বন কেটে রোহিঙ্গাদের জন্য বসবাসের জায়গা করা হয়েছে। বস্তুত উখিয়া থেকে টেকনাফজুড়ে পাহাড়েই এখন বিশ্বের সবচেয়ে বড় শরণার্থী শিবির। তথ্য বলছে, ২০১৭ সালের আগস্টের পর বাংলাদেশে আসা প্রায় সাড়ে সাত লাখ ভাগ্যবিড়ম্বিত রোহিঙ্গাদের বসতি নির্মাণ ও জ্বালানি কাঠ সংগ্রহের কারণে গত কয়েক বছরে উখিয়া ও টেকনাফের প্রায় আট হাজার একর বন ধ্বংস হয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই এর প্রভাব সেখানকার পরিবেশের ওপর পড়ছে। পাহাড় ও গাছ কাটার ফলে সেখানকার পরিবেশ মাঝেমধ্যেই বিরূপ আচরণ করে। বিশেষ করে বৃষ্টির সময় পাহাড়ধসে প্রায়ই রোহিঙ্গা নারী ও শিশুর নিহত হওয়ার খবর সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ হয়। প্রতি বছর জুন-জুলাই মাসে বৃষ্টির সময় সাধারণত পাহাড়ধসের ঘটনা ঘটে। এমন প্রায় প্রতিটি ঘটনায় রোহিঙ্গাদের প্রাণহানি বেদনাদায়ক।
সাংবাদিক হিসেবে আমাদের কয়েকজনের রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবির ও তার আশপাশ এলাকা দেখার সুযোগ হয়। পাহাড়ের ওপরে ছোট ছোট ঘর আপাত নিরাপদ দেখালেও দুর্যোগে এসব যে নড়বড়ে হয়ে যেতে পারে, তা সহজেই উপলব্ধিযোগ্য। কক্সবাজারের পরিবেশ ও রোহিঙ্গা শিবির সুরক্ষায় কী কী পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, সেটি আমরা দেখতে চাই। স্থানীয়রা এবং সেখানে রোঙ্গিাদের যাঁরা মানবিক সহায়তা দিচ্ছেন, এমন আন্তর্জাতিক ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মীরা আমাদের বনায়ন দেখান। অবশ্য রোহিঙ্গা ক্যাম্প সংলগ্ন এলাকায় গেলেই তা যে কারও চোখে পড়বে। যেখানে গাছ কাটা হয়েছে, সেখানে নতুন করে গাছ লাগানো হয়েছে এবং অনেক গাছ ইতোমধ্যে বড়ও হয়েছে। মোটাদাগে কেবল সবুজায়নের উদ্যোগ চোখে পড়লেও জানা গেল, আরও কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। উখিয়া ও টেকনাফে পাহাড়ধস ঠেকাতে ২০১৮ সালের মার্চ থেকে আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা (আইওএম), কৃষি ও খাদ্যবিষয়ক সংস্থা (এফএও) ও বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিউএফপি) 'সেফ প্লাস' নামে একটি কর্মসূচি বাস্তবায়ন করে। 'সেফ প্লাস' কর্মসূচির আওতায় বনায়নের পাশাপাশি বনাঞ্চল যাতে উজাড় না হয়, সে জন্য রান্নার কাজে জ্বালানি কাঠের পরিবর্তে রোহিঙ্গা পরিবারগুলোকে এলপি গ্যাস ও চুলা দেওয়া হয়েছে। শুধু রোহিঙ্গাদেরই নয়; সেখানে যারা 'হোস্ট কমিউনটি' বা স্থানীয় পরিবার রয়েছে, তারাও এসব সরঞ্জাম পেয়েছে। একই কর্মসূচির আওতায় ডব্লিউএফপি উখিয়া ও টেকনাফে রোহিঙ্গা শিবিরে প্রায় ৬০ লাখ চারাগাছ রোপণের পরিকল্পনা হাতে নিয়েছিল।
সেখানে আমরা দেখেছি, রোহিঙ্গা শিবির তৈরির ক্ষেত্রে যে পরিমাণ বন উজাড় হয়েছে, সে তুলনায় বনায়ন হয়েছে কম। বলার অপেক্ষা রাখে না, প্রকৃতি ও পরিবেশের ভারসাম্য বজায় রাখতে বন ও বনভূমির গুরুত্ব অপরিসীম। কিন্তু এটি সংরক্ষণে কার্যকর ব্যবস্থায় ঘাটতি বিদ্যমান। কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফে পাহাড় ও বনধসে যে ক্ষতি হয়ে গেছে, তার ঘাটতি পূরণে তো বটেই, জাতীয় সুরক্ষার জন্যও সেখানে বনায়ন ও পাহাড়ধস ঠেকাতে ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি। কক্সবাজারে রোহিঙ্গাদের জন্য বন ও পাহাড়ের জায়গা ব্যবহূত হয়েছে। তবে দেশের অন্যান্য স্থানেও বন ও পাহাড় রক্ষার চিত্র সন্তোষজনক বলা যাবে না। বনের জমিতে অপরিকল্পিত উন্নয়ন কর্মকাণ্ড পরিচালনা, সুন্দরবনসহ সংরক্ষিত বনাঞ্চলের সন্নিকটে বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ, বনের আশপাশের জমি সরকারি ও বেসরকারি শিল্প কারখানা এবং স্থাপনা তৈরিতে বরাদ্দ প্রদান, বনকেন্দ্রিক অনিয়ম, দুর্নীতি ও বনের জমি জবরদখলের মাধ্যমে বন ধ্বংসের বহুমুখী ঝুঁকি আমরা দেখছি। মনে রাখতে হবে, বনজসম্পদ ও বনভূমির অবক্ষয়ে বন্যপ্রাণী যেমন হুমকির মুখে পড়েছে, তেমনি এ কারণে জীববৈচিত্র্য ধ্বংসসহ পরিবেশের ভারসাম্যহীনতা ও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবকে আরও ত্বরান্বিত করছে।
কক্সবাজারের উখিয়ার রোহিঙ্গা শিবিরগুলো পরিদর্শনে এটা স্পষ্ট হয়েছে, সদিচ্ছা থাকলে পরিবেশ সুরক্ষায় আমরা অনেক কিছু করতে পারি। জাতিসংঘের প্রতিষ্ঠান, আন্তর্জাতিক ও বেসরকারি সংস্থাগুলোকে পাশে নিয়ে সরকারের বন বিভাগ অভিনব উদ্যোগ নিতে পারে। সেফ প্লাসের মাধ্যমে যেমন রোহিঙ্গাদের এলপিজির ব্যবস্থা করায় রান্নার জন্য বনের ওপর নির্ভরশীলতা কমেছে; বনায়নের মাধ্যমে ক্ষতিপূরণের যেভাবে চেষ্টা হয়েছে; এ প্রক্রিয়া এখানেই শেষ হওয়া উচিত নয়।
দুই দিনের রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবির পর্যবেক্ষণে আমরা দেখেছি, সরকারও বনায়নের ব্যাপারে উদ্যোগী। বন বিভাগ এ ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নিয়ে আরও কার্যকর পদক্ষেপ নিতে পারে। তাতে বেসরকারি সংস্থাগুলো এগিয়ে আসবে বলে আমরা মনে করি। এটি রোহিঙ্গারা যতদিন আছে; তাদের যেমন সুরক্ষা দেবে তেমনি ওই অঞ্চল যেহেতু এমনিতেই দুর্যোগপ্রবণ, সেখানকার স্থায়ী নিরাপত্তায়ও এটি ভূমিকা রাখবে।