মূল: স্কট মার্সেল
অনুবাদ: মাহফুজুর রহমান মানিক
মিয়ানমারের নিষ্ঠুর সামরিক শাসন নিয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় তিন ভাগে বিভক্ত। এক ভাগে রাশিয়া, চীন ও ভারত। তারা জান্তা সরকারকে সমর্থন দিচ্ছে। এমনকি রাশিয়া ও চীন নিজেদের সংকীর্ণ স্বার্থে মিয়ানমারে অস্ত্র সরবরাহ করছে। দ্বিতীয় ভাগে রয়েছে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর আঞ্চলিক জোট আসিয়ান। সংস্থাটি অবশ্য বিভক্ত। কারণ তারা মিয়ানমারের রাজনৈতিক সংকট সমাধানে পাঁচ দফা প্রস্তাবে ঐকমত্য পোষণ করেছে। কিন্তু এক বছরেও তার কোনো ইতিবাচক ফল স্পষ্ট নয়। আর তৃতীয় পক্ষ হলো পশ্চিমা বিশ্ব, যারা ইতোমধ্যে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। একই সঙ্গে মিয়ানমারের মানুষের জন্য মানবিক সাহায্য পাঠিয়েছে এবং ক্যুর বিরুদ্ধে শক্তিশালী অবস্থান গ্রহণ করেছে।
আন্তর্জাতিক এই পটভূমিতে মিয়ানমার জান্তা ক্ষমতা ধরে রাখার জন্য দেশটির জনগণের ওপর নিপীড়ন চালাচ্ছে। এ অবস্থায় মিয়ানমারের মানুষ ক্রমবর্ধমান হতাশা নিয়ে বলছে, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় তাদের জন্য আরও কিছু করছে না কেন? মিয়ানমারের মানুষের এ দুর্ভোগ কবে শেষ হবে, তা আমরা জানি না। দেশটির ভেতরের শক্তিগুলোর কর্মতৎপরতার ওপর নির্ভর করছে মিয়ানমারের ভবিষ্যৎ। কিন্তু এ ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া গুরুত্বপূর্ণ। কারণ আগামী বছর সামরিক জান্তা নির্বাচনে কারচুপির মাধ্যমে ক্ষমতা বৈধ করার চেষ্টা করবে। সে সময়ে সামরিক বাহিনী তার জনগণকে সহিংসতা ও সন্ত্রাসবাদের মাধ্যমে বশীভূত করার চেষ্টা করবে। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের ক্ষেত্রেও সেখানে এমনটি ঘটতে পারে। অন্যদিকে, মিয়ানমারের বর্তমান ছায়া সরকার বা ঐক্য সরকার এবং সেখানকার মানুষ এ আশায় সামরিক প্রতিরোধ চালিয়ে যাচ্ছে- তারা আরও আন্তর্জাতিক সমর্থন পাবে এবং জান্তা সরকারকে দুর্বল করতে পারবে।
এখন পর্যন্ত আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ভূমিকার প্রভাবে বলা যায়, মিয়ানমারে একটা ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থা রয়েছে। কিন্তু চীন, ভারত ও রাশিয়ার সামরিক জান্তাকে সমর্থন এবং অস্ত্র দেওয়ার কারণে পরিস্থিতি ভিন্ন দিকে মোড় নিচ্ছে। মিয়ানমারের ভেতরের পরিস্থিতির একটি স্পষ্ট ধারণা পাওয়া জরুরি। অবস্থা এমন নয়, সেখানে দুটি সমান শক্তিসম্পন্ন রাজনৈতিক গোষ্ঠীর মধ্যে বিবাদ চলছে। বরং সেখানে ঘৃণিত ও রক্তপিপাসু এমন এক শক্তির বিরুদ্ধে জাতীয় জাগরণ ঘটেছে, যারা দশকের পর দশক ধরে নৃতাত্ত্বিক সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে যুদ্ধাবস্থা জারি করেছে। রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে গণহত্যা সংঘটিত করেছে এবং এখন এমন নির্দয় ও নিষ্ঠুর আচরণ শুরু করেছে; দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় খেমাররুজ শাসনের পর যেটি আর দেখা যায়নি।
মিয়ানমারে সামরিক অভ্যুত্থানের পর সৃষ্ট ভয়াবহ সহিংসতায় দেশটির রাজনৈতিক সংকট সমাধানে আসিয়ানে যে পাঁচ দফা প্রস্তাবে সবাই একমত, সেটি আসলে ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে। কারণ মিয়ানমার সেনাবাহিনী সহিংসতা বন্ধ করেনি। আর রাজনৈতিক আলোচনা তো দূরস্থ। ২৫ জুলাই মিয়ানমারে গণতন্ত্রপন্থি চার বিরোধী নেতাকে যেভাবে ফাঁসি দেওয়া হয়; সেখানেই বস্তুত আসিয়ানের আহ্বানের প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখানো হয়।
মিয়ানমারকে এই সংকট থেকে বাঁচাতে এবং সেখানে শান্তি ও স্থিতিশীলতা আনয়নের একমাত্র উপায় হলো সামরিক বাহিনীকে ক্ষমতা থেকে উৎখাত করা কিংবা অন্তত এমন অবস্থায় ফেলা, যাতে তারা পিঠ রক্ষায় ক্ষমতা স্বেচ্ছায় ছেড়ে দেয়। এ ছাড়া কোনো পথ নেই। কারণ ২০২৩ সালে সামরিক বাহিনী যে জালিয়াতিপূর্ণ নির্বাচনের পরিকল্পনা করছে, তার উদ্দেশ্য আসলে মিয়ানমারকে একদলীয় রাষ্ট্রে পরিণত করা। সেটি জান্তার ভাষায় 'সুশৃঙ্খল গণতন্ত্র'।
এ অবস্থায় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে পদক্ষেপ নিতেই হবে। মালয়েশিয়া আসিয়ানের পাঁচ দফা প্রস্তাব আনুষ্ঠানিকভাবে বাদ দেওয়ার যে কথা বলছে, তা গুরুত্বপূর্ণ। মিয়ানমারের এ পরিস্থিতিতে এর কোনো কার্যকারিতা নেই। মিয়ানমারের ঐক্য সরকার এবং জাতিগত সশস্ত্র সংগঠন ইএও এবং সিভিল ডিজওবিডিয়েন্স মুভমেন্ট-সিডিএম নেতারাসহ অন্য যারা জান্তা সরকারের বিরুদ্ধে সোচ্চার, তাদের সঙ্গে সরকারি-বেসরকারি যোগাযোগ বাড়াতে হবে।
জান্তা সরকারের রাজস্ব আসে যেসব খাত থেকে তথা মিয়ানমারের তেল ও গ্যাসের বাণিজ্যের ওপর ইউরোপীয় ইউনিয়নের নিষেধাজ্ঞার সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেরও যুক্ত হওয়া দরকার। রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে গণহত্যা পরিচালনার জন্য যেভাবে গাম্বিয়া মিয়ানমারের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক আদালতে মামলা করেছে, সেভাবে জান্তার বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপও নিতে হবে সমানভাবে। গত ১৮ মাসের সামরিক শাসনে মিয়ানমারের যে ক্ষতি হয়েছে, তা কাটিয়ে ওঠা সহজ হবে না। তবে বর্তমানে এবং এর আগেও দেশটিতে যে নিপীড়ন ও অবিচার হয়েছে, বিশেষ করে রোহিঙ্গাসহ অন্যান্য সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে যে গণহত্যা সংঘটিত হয়েছে, সেখান থেকে মিয়ানমারের সংখ্যাগুরু গোষ্ঠীর সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নও কঠিন হবে। তার পরও সম্পর্কোন্নয়নের প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। তাতেও কিছু আশা জেগে থাকবে। কারণ, মিয়ানমারে যতদিন সামরিক বাহিনী থাকবে, ততদিন আশার আলো দেখার কোনো সুযোগ নেই।
স্কট মার্সেল :মিয়ানমারে নিযুক্ত সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রদূত; ইরাবতি থেকে ঈষৎ সংক্ষেপিত ভাষান্তর