Mahfuzur Rahman Manik
শুধু কথায় ঐক্যের চিড়ে ভিজবে না
জানুয়ারি 23, 2025

ঐক্য বর্তমানে বহুল আলোচিত বিষয়। সবাই ঐক্য চাইলেও বাস্তবে সে ঐক্য কতটা আছে? রোববার সমকালের প্রথম পাতায় প্রতিবেদন প্রকাশ হয়েছে– ‘ঐক্যের কথা বলে বিভক্ত অভ্যুত্থানের শক্তিগুলো’।

আমরা দেখেছি, জুলাই গণঅভ্যুত্থানে ছাত্রদের আন্দোলনে প্রায় সব রাজনৈতিক শক্তি ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল। ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার দেশত্যাগ ও আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের মধ্য দিয়ে সে আন্দোলন সফল হয়। হাসিনা সরকার সে আন্দোলন দমাতে সব রাষ্ট্রীয় শক্তি ব্যবহার করেও ব্যর্থ হয়। বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গুলিতে শহীদ হয়েছে সহস্রাধিক মানুষ; আহত কয়েক হাজার। তারপরও আন্দোলন দমাতে না পারার অন্যতম কারণ রাজনৈতিক শক্তিগুলোর ঐক্য। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে সমর্থন দিয়েছিল বিএনপি-জামায়াত ও অন্যান্য দল এবং তাদের ছাত্র সংগঠন ছাত্রদল-শিবিরসহ অন্যান্য ছাত্র সংগঠন। কিন্তু ৫ আগস্টের পর দিন যত যাচ্ছে, এসব রাজনৈতিক দল ও ছাত্র সংগঠনের মধ্যে বিভক্তি ও তিক্ততা বাড়ছে।

দীর্ঘদিনের মিত্র জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে বিএনপির বিভক্তি প্রকাশ্যে এসেছে। ছাত্রদল ও ছাত্রশিবিরের মধ্যেও বিভেদ স্পষ্ট। বিশেষ করে ছাত্র সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ছাত্রদলের সঙ্গে শিবির-বৈষম্যবিরোধীদের পাল্টাপাল্টি অবস্থান সামনে এসেছে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটির সম্প্রতি যে ‘জুলাই বিপ্লবের ঘোষণাপত্র’ নিয়ে অবস্থান, সেখানেও বিভক্তি দেখা যাচ্ছে। এ বিষয়ে বিএনপির অবস্থান যেমন নেতিবাচক, তেমনি একেকবার একেক বক্তব্যে সরকারকে অপ্রস্তুতই মনে হচ্ছে। আবার সরকারের সঙ্গে নির্বাচনের তারিখ নিয়ে বিএনপির এক ধরনের বিভাজনই দেখা যাচ্ছে।

পরিস্থিতি যা দাঁড়িয়েছে, তাতে সরকারের সঙ্গেও বিএনপির দূরত্ব বাড়ছে। দূরত্ব বাড়ছে জামায়াত ও ছাত্রদের সঙ্গেও। ২০ ডিসেম্বর সমকালের শীর্ষ প্রতিবেদন ছিল– ‘দ্রুত নির্বাচনের লড়াইয়ে একা বিএনপি’। কারণ নির্বাচনের আগে প্রয়োজনীয় সংস্কার চাইছে জামায়াতে ইসলামী। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন আওয়ামী লীগের বিচারের আগে নির্বাচন হতে দেবে না বলে ঘোষণা দিয়েছে। চরমোনাই পীরের নেতৃত্বাধীন ইসলামী আন্দোলনেরও অগ্রাধিকারে রয়েছে সংস্কার। যেসব দল বিএনপির কাছ থেকে আগামী নির্বাচনে আসন ছাড় পাওয়ার প্রতিশ্রুতি পেয়েছে, তারাই দ্রুত নির্বাচনের দাবি জানাচ্ছে।

রাজনৈতিক দল ও পক্ষগুলোর মধ্যকার বিভক্তির নানাবিধ কারণ স্পষ্ট হয়ে উঠলেও ঐক্যের কথা সবাই বলছেন। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর কয়েক দিন আগে বলেছেন, বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে বিভাজন নয়, ঐক্য চাই। তাঁর ভাষায়, ‘আমরা আহ্বান জানাব দেশের সমস্ত গণতন্ত্র ও স্বাধীনতাকামী মানুষদের– আপনারা ঐক্যবদ্ধ থাকবেন। বিভাজিত হবেন না। আমি রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের যারা যে যেখানে কাজ করছেন সবাইকে অনুরোধ করব, বিভাজন সৃষ্টি করবেন না।’ (যুগান্তর, ৯ জানুয়ারি ২০২৫)। জামায়াতের আমির ডা. শফিকুর রহমানও সম্প্রতি বলেছেন, ‘ইনসাফের বাংলাদেশ গড়তে ঐক্য চাই।’ (বিএসএস নিউজ, ৩ জানুয়ারি ২০২৫)। ছাত্র সংগঠনগুলোর নেতারাও অনৈক্যের কথা বলেননি। অর্থাৎ সব পক্ষই ঐক্যের কথা বলছে, তবে কেন এই বিভক্তি?

বলা বাহুল্য, বিভক্তির নানা কারণ থাকতে পারে। কিন্তু মতানৈক্যের দিকে নজর না দিয়ে গুরুত্ব দিতে হবে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার কারণের দিকে। জুলাইয়ের আন্দোলনে ফ্যাসিবাদবিরোধী ঐক্যবদ্ধ হয়ে জাতি তার ফলও পেয়েছে। এর পর মাঝখানে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নিয়ে সবাই ঐক্যবদ্ধ। প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের আহ্বানে সাড়া দিয়ে সব রাজনৈতিক দল ও ধর্মীয় নেতারা তাঁর সঙ্গে দেখা করেছেন। এর পর দেশে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট হয় এমন ঘটনা ঘটেনি। এখন নির্বাচন ও সংস্কার বিষয়ে যে মতদ্বৈধতা, সেখানে ঐক্য দরকার।

বর্তমানে যে এক ধরনের ঐকমত্য আছে, তা অস্বীকার করা যাবে না। বিশেষ করে নির্বাচনী ব্যবস্থা হিসেবে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ফিরে এসেছে। এ বিষয়ে কেউ দ্বিমত করেনি। এমনকি সবাই চায় গণতান্ত্রিক উত্তরণ। মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরও গণতন্ত্রের কথা বলেছেন। কিন্তু শুধু কথায় ঐক্যের চিড়ে ভিজবে না। সে জন্য রাজনৈতিক দলগুলোকে পরস্পরের মধ্যে সংলাপ করে ভুল বোঝাবুঝি দূর করতে হবে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটিকেও আস্থায় নেওয়া চাই।

ঐক্য এই প্রশ্নেও হতে পারে– সংস্কার অনিবার্য হয়ে পড়েছে। কারণ যে ধরনের ব্যবস্থা বর্তমানে প্রচলিত, এখানে পরিবর্তন না এলে, আগের ব্যবস্থা বলবৎ থাকলে যে কোনো সরকার বিগত সরকারের মতো ফ্যাসিবাদী হয়ে উঠতে পারে। ক্যাম্পাসে নির্বাচনের মাধ্যমে ছাত্র সংসদগুলো সচল না হলে বিগত সময়ের মতো লেজুড়বৃত্তির ছাত্র রাজনীতি ফিরে আসার আশঙ্কা রয়েছে। সে কারণেই এ নির্বাচন ও মৌলিক কিছু সংস্কার জরুরি– তা বিএনপিসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দলও নিশ্চয় অনুধাবন করবে।

অন্তর্বর্তী সরকার আগামী ডিসেম্বর নাগাদ নির্বাচনের যে ঘোষণা দিয়েছে, সদিচ্ছা থাকলে এর মধ্যেই কিছু সংস্কার করা সম্ভব। ১৫ জানুয়ারির মধ্যে অধিকাংশ সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন জমা দেওয়ার কথা। এর পর অন্তর্বর্তী সরকার অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ও রাজনৈতিক দলগুলোকে আস্থায় রেখে সংস্কারে হাত দিতে পারে। বাকি সংস্কারগুলো যাতে পরবর্তী সরকার করে, সে জন্য রাজনীতিকদের থেকে সেই অঙ্গীকার নেওয়া দরকার। পরস্পরকে বিভক্ত করে এমন কোনো বক্তব্য ছাত্রসহ কোনো রাজনৈতিক শক্তি থেকেই প্রত্যাশিত নয়।

মনে রাখতে হবে, জুলাই-আগস্টের গণঅভ্যুত্থানকে কেন্দ্র করে জাতি যেভাবে ঐক্যবদ্ধ হয়েছে, তার ধারাবাহিকতা কেবল হাসিনা সরকারের পতনেই সীমাবদ্ধ থাকা উচিত নয়। বরং দীর্ঘ মেয়াদে দেশে যাতে শান্তিশৃঙ্খলা ফিরে আসে এবং গণতন্ত্র বজায় থাকে সে জন্য ব্যবস্থাগত সংকটের সমাধান করা জরুরি। ঐক্যবদ্ধ না থাকলে তা কীভাবে সম্ভব?

সমকালে প্রকাশ: ১৩ জানুয়ারি ২০২৫ 

ট্যাগঃ , , ,

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।