
সাক্ষাৎকার: অধ্যাপক ড. মো. আহসান হাবীব
ড. মো. আহসান হাবীব ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইআর) শিক্ষা মনোবিজ্ঞান ও নির্দেশনা বিভাগের অধ্যাপক। ইউএসএইড, বিশ্বব্যাংক, ইউনিসেফসহ সরকারি-বেসরকারি উল্লেখযোগ্য প্রতিষ্ঠানে গবেষণাপ্রধান ও কনসালট্যান্ট হিসেবেও কাজ করছেন। বাংলাদেশ সাইকোমেট্রিক সোসাইটির (বিপিএস) প্রোগ্রাম সেক্রেটারি এবং ইন্টারন্যাশনাল স্কুল সাইকোলজি অ্যাসোসিয়েশনের সদস্য। আহসান হাবীব অস্ট্রেলিয়ার মোনাশ ইউনিভার্সিটি থেকে শিক্ষা মনোবিজ্ঞানে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউট থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সমকালের জ্যেষ্ঠ সহসম্পাদক মাহফুজুর রহমান মানিক।
সমকাল: শিক্ষাঙ্গনে শিক্ষার্থীদের মধ্যকার সংঘাত কতটা মনস্তাত্ত্বিক? যেমন ধরুন, ঢাকা কলেজের সঙ্গে প্রতিবেশী সিটি কলেজ ও আইডিয়াল কলেজের যুগ যুগ ধরে যে সংঘর্ষ চলে আসছে, এর মনস্তাত্ত্বিক কোনো ব্যাখ্যা আছে?
মো. আহসান হাবীব: শিক্ষার্থীদের সংঘর্ষের সঙ্গে অবশ্যই মনস্তাত্ত্বিক বিষয় আছে। কারণ এই ১৭-১৯ বয়স, যা টিনএজ বলে শিক্ষার্থীদের শারীরিক শক্তিমত্তা প্রদর্শনের এক ধরনের প্রবণতা থাকে। জীবনের এই সময়ে মানুষের শারীরিকভাবে শক্তিও সবচেয়ে বেশি থাকে। মানসিকভাবে এমন একটা অবস্থায় থাকে, তারা যাকে সত্য বলবে সেটিই সত্য। অর্থাৎ এক ধরনের আদর্শিক অবস্থান তৈরি হয়। এই সময়ে তারা তাদের সামনে কোনো মডেল দেখতে চায়। তাই আমরা দেখি, এই বয়সেই শিক্ষার্থীরা নায়ক-নায়িকা বা প্রিয় খেলোয়াড়দের ছবি ঘরের দেয়ালে লাগায় বা তাদের নিয়ে অতি উল্লাস দেখায়। এই সময়ে শক্তিকে ইতিবাচকভাবে ব্যবহার না করলে তার নেতিবাচক প্রকাশ হতে বাধ্য। কলেজে কলেজে শিক্ষার্থীদের সংঘর্ষ তার বাইরে নয়।
সমকাল: ইতিবাচক ব্যবহার বলতে আপনি কী বোঝাচ্ছেন?
মো. আহসান হাবীব: শিক্ষার্থীদের খেলাধুলার পর্যাপ্ত ব্যবস্থা থাকতে হবে। সাংস্কৃতিক কাজ ও সহশিক্ষা কার্যক্রমে শিক্ষার্থীদের সক্রিয় অংশগ্রহণের ব্যবস্থা করতে হবে। যেমন– কলেজে অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন থাকতে পারে, ডিবেটিং সোসাইটি থাকবে। এভাবে যে কোনো কিছুর সঙ্গে তার যুক্ত থাকতে হবে।
সমকাল: তার মানে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে সহশিক্ষা কার্যক্রম কম আছে বলে মনে করছেন?
আহসান হাবীব: হ্যাঁ। অনেক কম আছে। এর মধ্যেও আবার অনেকই সক্রিয় নয়। সহশিক্ষা কার্যক্রমে এর গুরুত্ব যেমন কম, তেমনি ফান্ডিং এবং রিসোর্স কম। আগে আন্তঃজেলা টুর্নামেন্ট ছিল, এখন নেই। এখন খেলাধুলায় আগ্রহী শিক্ষার্থীদের অন্য কোথাও যেতে হচ্ছে।
সমকাল: এ ক্ষেত্রে অন্য দেশের পরিস্থিতি কী?
আহসান হাবীব: অন্য দেশে বাংলাদেশের মতো সংঘর্ষ কমই হয়। তার কারণ, সেখানকার শিক্ষার্থীরা নানা কাজে যুক্ত হয়। পশ্চিমাবিশ্বের কথা যদি বলি, বিদ্যালয় থেকেই তারা বিভিন্ন খণ্ডকালীন কাজে যুক্ত হয়। এশিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যেমন– চীন বা সিঙ্গাপুরে শিক্ষার্থীরা অনেক ধরনের সহশিক্ষা কার্যক্রমে যুক্ত থাকে। উচ্চ বিদ্যালয় বা কলেজের কোনো শিক্ষার্থীর সঙ্গে কথা বলতে চাইবেন, সে হয়তো ডায়েরি খুলে শিডিউল দেখবে, কখন তার সঙ্গে কথা বলা বা দেখা করা যাবে। আর আমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে বিশেষ করে উচ্চবিদ্যালয় বা কলেজে সহশিক্ষা কার্যক্রম তো সীমাবদ্ধই, সাধারণ বিজ্ঞান ক্লাসের ল্যাব কার্যক্রমগুলো অনেক সময় হয় না। স্কুলগুলোতে ল্যাব বন্ধ থাকে।
সমকাল: সম্প্রতি ঢাকা ও যাত্রাবাড়ীর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর শিক্ষার্থীদের মধ্যে যে সংঘর্ষ হয়, এর ভিন্ন কোনো মাত্রা আছে? বিশেষ করে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের ট্রমা থেকে শিক্ষার্থীরা বেশি অসহিষ্ণু হয়ে উঠছে কিনা; যে কোনো ঘটনায় কর্তৃপক্ষের দ্বারস্থ না হয়ে নিজেরাই ‘ব্যবস্থা’ নেওয়ার চেষ্টা করছে বলে অভিযোগ?
আহসান হাবীব: হ্যাঁ, ভিন্নমাত্রা আছে। জুলাই গণঅভ্যুত্থানের আগে কভিডের কথাও যদি আমরা বলি, কভিড ১৯-এ দীর্ঘদিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকার পর আমরা এমন অনেক অভিযোগ শুনেছি যে, শিক্ষার্থীদের সঙ্গে শিক্ষকদের মিলছে না। অর্থাৎ দীর্ঘদিন ছাত্র-শিক্ষকের মিথস্ক্রিয়া না হওয়াতেই এমনটা হয়েছে। অনুরূপভাবে জুলাই গণঅভ্যুত্থানে শিক্ষার্থীরা এক ধরনের ‘ফাইটিং’ মুডে ছিল। এমন অবস্থায় ছিল যে প্রয়োজনে তারা জীবন দিয়ে দেবে। এই অভ্যুত্থানের পরই আবার তাদের লড়তে হয়েছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধানদের বিরুদ্ধে। সেখানে বিচারহীনতা কিংবা দলীয়করণের কারণে প্রশাসনিক পর্যায়ে সংকট দেখা দেয়। ফলে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে শিক্ষকদের এক ধরনের দূরত্ব তৈরি হয়। বিশ্বাস ও আস্থাহীনতা তৈরি হয়েছে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার পরও সেই শূন্যতা পূরণ করা হয়নি। এই রিকনসিলিয়েশন না হওয়ার কারণেই অনেকের সেই মুড রয়ে যেতে পারে; যার কারণে শিক্ষার্থীদের মারমুখী আচরণ সম্ভবত রয়ে গেছে। তুচ্ছ কারণেই কলেজগুলোতে বিধ্বংসী ঘটনা তারই আলামত হওয়া অস্বাভাবিক নয়।
সমকাল: ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে সারাদেশের শিক্ষার্থীদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ আমরা দেখেছি। তাদের ‘রিকনসিলিয়েশন’ কীভাবে হতে পারত?
আহসান হাবীব: শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও মিডিয়ার মাধ্যমে এটি করা যেত। শিক্ষকদের মাধ্যমে সেলিব্রেশন বা ঘটা করে এটি করা যেত। অর্থাৎ আমরা বড় একটি কিছু করেছি। তোমরা যা করেছে ‘গুড জব’। এই অ্যাপ্রিসিয়েশন দিয়ে তারপর বলা যেত, এবার তাহলে পড়াশোনায় ফিরি। এই সেলিব্রেশন না হয়ে শিক্ষার্থীরা সরাসরি পড়াশোনার মধ্যে ঢুকে গেছে।
সমকাল: শিক্ষার্থীদের সাম্প্রতিক সংঘর্ষের পর আমরা দেখছি সরকার ইতোমধ্যে সহশিক্ষা কার্যক্রমে তাদের ব্যস্ত রাখতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে নির্দেশনা দিয়েছে। যে বিষয়টি আপনিও এর আগে বলেছেন। এ নির্দেশনা আপনি কীভাবে দেখছেন?
আহসান হাবীব: এ সময়ে এ নির্দেশনা নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ। শিক্ষার্থীদের শিক্ষামুখী রাখতে ৯টি সহশিক্ষা কার্যক্রমে সম্পৃক্ত করার বিষয়টি শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে বলা হয়েছে। এটি আমি ইতিবাচকভাবেই দেখছি। তবে এটি যদি ‘অ্যাডহক’ ভিত্তিতে, সাময়িক সময়ের জন্য হয়, তবে এর সুফল নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে। শিক্ষার্থীদের ঠিক করতে সার্বিক বিষয়েই নজর দিতে হবে। যেমন– যথাযথ শিক্ষক নিয়োগ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সুবিধা ও সামর্থ্য যদি আমরা বাড়াতে না পারি, তবে এর স্থায়িত্ব থাকবে কিনা সন্দেহ। অর্থাৎ আমি একে রেগুলার
অ্যাক্টিভিটিজের ওপর জোর দিচ্ছি। মনে রাখতে হবে, কারিকুলাম কেবল একাডেমিক অর্জনে সীমাবদ্ধ নয়। এর সঙ্গে অনেক কিছু যুক্ত। পাশাপাশি এ জন্য বিদ্যালয়কে ‘স্কুল মেগা প্রজেক্ট’ হিসেবে নেওয়া দরকার।
সমকাল: এর বাইরেও দেখা গেছে, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে তুচ্ছ কারণেই সংঘাত বেধে যায়। যেমন– নিউমার্কেটে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কিংবা বাসের সামান্য ভাড়া নিয়ে দ্বন্দ্ব। এখানে পারিবারিক শিক্ষা কিংবা অবস্থার প্রভাব কতটা?
আহসান হাবীব: সমাজ-পরিবার এগুলো সবই আন্তঃসম্পর্কিত। পরিবারের খরচ যখন বেড়ে যায় তখন অর্থনৈতিক চাপে মা-বাবার মধ্যে এক ধরনের মনোমালিন্য সন্তানরা দেখে থাকে। এর প্রভাব তাদের মনে অবচেতনভাবে পড়ে। অর্থনৈতিক সংকটও তারা অনুধাবন করে। এ জন্য বাবা-মাকে যুক্ত করা এবং শিক্ষা ব্যয় কমানো। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বাইরেও খরচ অনেক বেশি। প্রাইভেট, নোট-গাইড। অথচ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভালোভাবে পড়ালে এগুলোর প্রয়োজন হতো না।
সমকাল: এই সময়ে শিক্ষার্থীদের নিয়ন্ত্রণে শিক্ষা প্রশাসন কিংবা শিক্ষকদের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তোলা যায়? বিশেষ করে শিক্ষার্থীদের সফল অভ্যুত্থানের পর শিক্ষকদের অনেকের মধ্যে কি শিক্ষার্থীদের প্রতি ‘সমীহ’ বা ‘ভয়ের’ মানসিকতা কাজ করছে?
আহসান হাবীব: জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পর অনেক প্রতিষ্ঠানেরই প্রধান শিক্ষকদের পদত্যাগের দাবিতে শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে আন্দোলন হয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে যোগ্যতার বাইরে দলীয়করণের মাধ্যম এসব পদে শিক্ষকদের নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। শিক্ষার্থীরা হয়তো তাদের ব্যাপারে সরব ছিল। এতে হয়তো অন্য শিক্ষকরাও ভীত হয়েছেন। সমীহের কারণও হতে পারে, শিক্ষকরা হয়তো আন্দোলনে কিছু করতে পারেননি, অথচ পরিবর্তনটা শিক্ষার্থীরাই এনেছে। অনেক শিক্ষকও নিশ্চয়ই আন্দোলনে ছিলেন, কিন্তু শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের মধ্যকার প্রজন্মগত গ্যাপের কারণে প্রতিবাদের ধারা হয়তো ভিন্ন ছিল। যে কারণে, শিক্ষকদের সঙ্গে সম্পর্ক সবার এখনও স্বাভাবিক হয়নি। প্রজন্মের এই গ্যাপটা পূরণে হয়তো আরও সময় লাগব। এ ক্ষেত্রে শিক্ষকদেরও অনুধাবন করতে হবে যে, শিখনের পুরোনো সেই ধারণা এখন আর নেই যে, কেবল শিক্ষক থেকেই শিখবে। এখন জ্ঞান অবারিত, শিক্ষার্থীরা চাইলে যে কোনো উৎস থেকে শিখতে পারে।
সমকাল: অনেক শিক্ষক শিক্ষার্থীদের সংঘর্ষে সংহতির বার্তাও দিতে পারেননি। যেমন– সম্প্রতি ঢাকা কলেজ ও ঢাকা সিটি কলেজের শিক্ষার্থীদের মধ্যকার সংঘর্ষের পর ঢাকা কলেজের একজন শিক্ষক সংঘর্ষ এড়াতে সিটি কলেজ সরানোর দাবি করেন। বিষয়টি কীভাবে দেখছেন?
আহসান হাবীব: সংঘর্ষের কারণে ঢাকা সিটি কলেজ সরিয়ে দেওয়ার দাবি করা মানে মাথা ব্যথার জন্য মাথা কেটে ফেলা। এর পরিবর্তে দুই কলেজের শিক্ষার্থীদের মধ্যে সম্প্রীতি সৃষ্টির উদ্যোগ নেওয়া যেত। দুই কলেজের শিক্ষার্থীরা যদি শিক্ষকসহ একসঙ্গে বসত, একসঙ্গে কাজ করার সুযোগ পেত, তবে উভয়ের মধ্যে এক ধরনের সম্পর্ক তৈরি হতো কিংবা ভুল বোঝাবুঝির অবসান হতো। এতে গন্ডগোলের আশঙ্কা তৈরি হতো না। কিন্তু আমরা কাজ করার সুযোগই দিতে পারিনি। প্রতিবেশী প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে মিথস্ক্রিয়া বাড়ানো, আন্তঃস্কুল-কলেজ প্রোগ্রাম বাড়ালে এ ধরনের পরিস্থিতির উদ্ভব হতো না।
সমকাল: পুরান ঢাকার কলেজগুলোতে যে সংঘর্ষ ঘটেছে, সেখানে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ হয়েছে। একটি কলেজের শিক্ষার্থীরা সংবাদ সম্মেলন করে বলেছেন, তাদের মধ্যে তৃতীয় পক্ষ ঢুকে পড়েছে বা তৃতীয় পক্ষের ইন্ধন ছিল। এমনটা হতে পারে?
আহসান হাবীব: রাজনীতিকদের মতো তো আমি বলতে পারব না। তবে আমি বলতে পারি, তারুণ্যের এই সময়টায় তাদের যে ধরনের ঝোঁক থাকে, তাকে যে কেউই ব্যবহারের আশঙ্কা থাকে। তৃতীয় পক্ষ যদি চায় সেভাবে সহজেই ব্যবহার করতে পারে। এই গ্যাপটা যাতে না হয়, সে জন্য স্কুল বা কলেজই একমাত্র ক্ষেত্র, যেখানে শিক্ষার্থীদের বিভিন্নভাবে ব্যস্ত রাখা যায়।
সমকাল: কলেজগুলোর সংঘর্ষের পরিপ্রেক্ষিতে প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের মধ্যে একতা ও সংহতির বার্তা পৌঁছে দিতে ‘জাতীয় ছাত্র সংহতি সপ্তাহ’ শীর্ষক কর্মসূচি ঘোষণা করেছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। এটিকে কীভাবে দেখছেন?
আহসান হাবীব: আমাদের শিক্ষকরা বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো দীর্ঘদিন ‘সেন্ট্রালাইজড’ থাকার কারণে অনেক সময় নিজেরা উদ্যোগ নিতে পারে না। সে জন্য মোটাদাগে নির্দেশনা দেওয়া প্রয়োজন, যাতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো আন্তঃপ্রাতিষ্ঠানিক কাজে স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নিতে পারে। কানেক্টিং ক্লাসরুম মডেল, সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতা, যৌথ প্রদর্শনী, বিজ্ঞানমেলা এমন উদ্যোগ সংহতিতে ভূমিকা রাখতে পারে।
সমকাল: যখনই শিক্ষাঙ্গন অস্থির হয়, অনির্দিষ্টকালের জন্য প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেওয়ার প্রবণতা থাকে। এটিই কি ভালো বিকল্প?
আহসান হাবীব: যখনই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অনাকাঙ্ক্ষিত কিছু ঘটে, প্রশাসন দেখা যায় অনির্দিষ্টকালের জন্য প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেয়। তারা এটি করে, যাতে বড় ঘটনা না ঘটে। একটি ক্লাসে কোনো ঘটনা ঘটলে তার জন্য পুরো প্রতিষ্ঠান কেন সংকটে পড়বে? প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দিলে সব শিক্ষার্থীর পড়াশোনা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। অনেক সময় আবাসিক হলসহ প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দিলে ছাত্রছাত্রীদের অন্যত্র যেতেও সমস্যা হয়। এটি ভালো বিকল্প হতে পারে না। উচিত হবে ঘটনার পর সংশ্লিষ্টদের নিয়ে বসা। উন্মুক্তভাবে সবার কথা শোনা। তৎক্ষণাৎ ব্যবস্থা নিয়ে এরপর বলা যায়, তাহলে এবার আমরা ক্লাসে ফিরি। প্রশ্ন হলো, সব বিষয়ে কেন শিক্ষার্থীদের আন্দোলন করতে হবে?
সমকাল: তাহলে করণীয়?
আহসান হাবীব: জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে সম্প্রতি একটি ঘটনা ঘটেছে, অটোরিকশার ধাক্কায় এক ছাত্রী নিহত হয়। এ ঘটনার পর কেন শিক্ষার্থীদের আন্দোলন করতে হলো? এটি তো এমনিতেই একটা অপরাধ। সে অনুযায়ী প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তৎক্ষণাৎ ব্যবস্থা নেবে। উপাচার্য এসে বলবেন, আমরা এই ব্যবস্থা ইতোমধ্যে নিয়েছি। কেন শিক্ষার্থীদের রাতভর আন্দোলন করার পর গিয়ে প্রশাসন বলবে, আমরা ব্যবস্থা নিচ্ছি। এটি তো আগেই হতে পারত।
সমকাল: শিক্ষাঙ্গনে শিক্ষার পরিবেশ নিশ্চিতে আপনার পরামর্শ কী?
আহসান হাবীব: প্রথমত শিক্ষায় মেগা প্রজেক্ট নিয়ে এখানে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নিয়মিত শিক্ষা কার্যক্রম এবং মানসম্মত শ্রেণি কার্যক্রম নিশ্চিত করলে, পাশাপাশি সহশিক্ষা কার্যক্রম থাকলে অনেক সমস্যার সমাধান সম্ভব। এখন দেখা যায়, অনেক প্রতিষ্ঠানে ঠিকমতো ক্লাস হয় না, ল্যাব কার্যক্রমের খবর থাকে না। সহশিক্ষা তো দূরের কথা। শিক্ষক যদি সেভাবে ক্লাস নেন, নানামুখী শিখন পদ্ধতি প্রয়োগ করেন, তবে শিক্ষার্থীদের জগৎটা বড় হবে, তাতেই তাদের ব্যস্ততা বাড়বে। তারা মাল্টিমিডিয়ায় প্রেজেন্ট করবে, নানামুখী অ্যাক্টিভিটি থাকবে। পাশাপাশি যোগ্য লোককে শিক্ষক বানানো দরকার। এখনকার পড়াশোনা তো আগের মতো নেই যে, ক্লাসে গিয়ে কোনো রকম লেকচার দিলেই শেষ। আমি যে লেকচার দিচ্ছি, সেই বিষয়ে হয়তো হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটির লেকচার ইউটিউবে আছে। তাহলে শিক্ষার্থী কেন আমারটা শুনবে? শিক্ষক বরং ওই লেকচার শুনিয়ে বলবেন, এবার আমরা আলোচনা করি। এ ধরনের ইনোভেটিভ শিক্ষক নিয়োগ দরকার।
সমকাল: সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
আহসান হাবীব: আপনাকেও ধন্যবাদ। সমকালের জন্য শুভকামনা।