
সাক্ষাৎকার: ডা. মুশতাক হোসেন
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. মুশতাক হোসেন ইনস্টিটিউট অব এপিডেমিওলজি, ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড রিসার্চের (আইইডিসিআর) সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা। তিনি ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস ডিগ্রি লাভ করেন। ডাকসুর সাবেক জিএস; পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন যুক্তরাজ্যের কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সমকালের জ্যেষ্ঠ সহ-সম্পাদক মাহফুজুর রহমান মানিক।
সমকাল: বুধবার স্বাস্থ্য উপদেষ্টা জুলাই গণঅভ্যুত্থানে আহতদের দেখতে গিয়ে হাসপাতালে ক্ষোভের শিকার হয়েছেন। তাদের চিকিৎসার বিষয়টি কি সরকার অগ্রাধিকার দিচ্ছে না?
মুশতাক হোসেন: আমি মনে করি, তাদের বিক্ষোভ ন্যায্য। গণঅভ্যুত্থানে আহতরা চিকিৎসা নিয়ে নানা কারণেই সংক্ষুব্ধ। প্রথমত, আমাদের স্বাভাবিক স্বাস্থ্য কাঠামোই ত্রুটিপূর্ণ। প্রায় সব নাগরিকই এর শিকার। সরকারি হাসপাতালগুলোর অব্যবস্থাপনা নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না। হয়তো চিকিৎসক আছেন; চিকিৎসা সরঞ্জামেরও অভাব নেই। তারপরও কাঠামোর কারণে চিকিৎসা পুরোপুরি পেতে সমস্যা হয়। আহতদের চিকিৎসায় নিশ্চয় সরকারের অগ্রাধিকার আছে। কিন্তু কাঠামোর দুর্বলতার কারণে তার প্রয়োগ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
সমকাল: জুলাইয়েই বেশি আহত হয়েছেন। আগের সরকারের সময়েই তারা চিকিৎসা সংকটে ভুগছিলেন। পুরোনো ভূত কি রয়ে গেছে?
মুশতাক হোসেন: আমরা ব্যক্তিগতভাবে আহতদের হাসপাতালে দেখতে আন্দোলনের সময় যেমন গিয়েছি, তেমনি সরকার পতন হওয়ার পরও গিয়েছি। আগের কথা যদি বলি; তখন কেউ কেউ সরকারের উগ্র সমর্থক ছিলেন। তারা আন্দোলনে আহতদের ঠিকভাবে চিকিৎসা দেননি। অধিকাংশই তখন ছিলেন ভয়ে– চিকিৎসায় মনোযোগ দিলে তারা সরকারের রোষানলে পড়েন কিনা! এমনও হয়েছে, পঙ্গু হাসপাতালের (জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠান) একজন চিকিৎসক ফেসবুক প্রোফাইল লাল করায় হেনস্তার শিকার হন। সরকার পতনের পরপর পরিস্থিতি কিছুদিন খারাপই ছিল।
সমকাল: কেন?
মুশতাক হোসেন: কারণ, প্রথম দিকে সরকারের কার্যক্রমই ছিল না। আমরা তখনও হাসপাতাল পরিদর্শনে যাই। নিজেদের পকেট থেকে সামান্য অর্থও আমরা দিই, যা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই অপ্রতুল। অনেকে তৎক্ষণাৎ ঋণ করে নানাভাবে চিকিৎসা চালিয়েছেন। হয়তো খরচের ফর্দও রাখেননি। পরিস্থিতিটা এমন ছিল, তাদের জীবন বাঁচানো জরুরি। অর্থ ছাড়া চিকিৎসা হবে না, তাই অন্যথা করারও সুযোগ ছিল না। অন্তর্বর্তী সরকার ১৭ আগস্ট এসে ঘোষণা করে, আহতদের চিকিৎসা ব্যয় বহন করবে সরকার। তার আগেই অনেকের বিপুল অর্থ খরচ হয়ে যায়। বেসরকারি হাসপাতালে কাউকে চিকিৎসার জন্য লাখ লাখ টাকা খরচ করতে হয়। সেগুলো যদিও সরকার থেকে বলা হয়, পরিশোধ করে দেবে। তার কতদূর কী হয়েছে, আমাদের জানা নেই। বুধবার আহতরা যে বিক্ষোভ করেছেন; অধিকাংশই বলেছেন, সহায়তার টাকা হাতে পাননি।
সমকাল: চিকিৎসার প্রতিবন্ধকতা হিসেবে আপনি যে কাঠামোগত সংকটের কথা বললেন, সেটা কেমন?
মুশতাক হোসেন: এখানে নিয়মকানুনের বেড়াজাল আছে। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ টাকা খরচ করতে পারবে কিনা। আবার খরচ করলেও অডিটে দুর্নীতির কথা বলা হয় কিনা। একটা শঙ্কা দেখা তো গেছে, যারা আগের সরকারের সময়ে হাসপাতাল বা স্বাস্থ্য প্রশাসনে ঢাকায় পোস্টিং পেয়েছেন, তাদের বদলি করে দেওয়া হবে। তারা সবাই তো আর ওই সরকারের সমর্থক ছিলেন না। তারপরও তাদের মধ্যে হতাশা লক্ষণীয় ছিল, যদিও এখন কেটে গেছে।
সমকাল: তাহলে সমস্যা কী?
মুশতাক হোসেন: সরকার চিকিৎসাসহ সব ব্যয় বহনের কথা বলেছে। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষও বলেছে, বিনা পয়সায় চিকিৎসা হচ্ছে। রোগীর কাছে গিয়ে যখন জানতে চাইলাম, তারা বললেন, সবই আমাদের কিনতে হয়েছে। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ নাকি সেভাবে কিনে রিসিট রেখে দিতে বলেছে। তাদের অনেকেরই অর্থনৈতিক অবস্থা খুব খারাপ। এর মধ্যে এভাবে যদি সব কিনতে হয়, তবে সঠিক সময়ে সহায়তা কীভাবে দেওয়া হচ্ছে?
সমকাল: তার মানে, আপনি চিকিৎসায় অবহেলার কথা বলছেন?
মুশতাক হোসেন: দেখুন, এই আহতরাই আমাদের গণআন্দোলনে ন্যায্যতার অন্যতম প্রতীক। যারা শহীদ হয়েছেন, তাদের আত্মত্যাগ এবং যাদের অঙ্গহানি হয়েছে তাদের ত্যাগের বিনিময়ে আমরা পরিবর্তনটা পেয়েছি। অনেকে চোখ হারিয়েছেন, অথচ যথাযথ চিকিৎসা পাননি, এমন অভিযোগও আছে। গণঅভ্যুত্থান হলো, অথচ তার ভাগ্যে এখনও সেই অমানিশার অন্ধকার। যারা আহত হয়েছেন, অঙ্গ হারিয়েছেন, তারা যদি দেশ-বিদেশে যথাযথ চিকিৎসা না পান। পুরোনো নিয়মতান্ত্রিকতার বেড়াজালে তাদের চিকিৎসা যদি আটকে থাকে, এর চেয়ে দুঃখজনক আর কী হতে পারে!
সমকাল: আমরা দেখেছি, বৃহস্পতিবার উপদেষ্টাদের সঙ্গে বৈঠকে আহতরা মন্ত্রী-উপদেষ্টাদের মতো চিকিৎসা, যারা আহত হয়ে নিজ খরচে চিকিৎসা নিয়েছেন তাদের চিকিৎসা খরচ পরিশোধ করার দাবি করেছেন? এ দাবি কেন করতে হচ্ছে?
মুশতাক হোসেন: মন্ত্রী-উপদেষ্টাদের চিকিৎসায় সরকার যেমন বিনা খরচে এবং বিশেষ অগ্রাধিকার দিয়ে করায়, তারাও তা চাইছেন। যদিও এটা কোনো দাবির বিষয় নয়; এমনিতেই পাওয়ার কথা। তিন মাসের অভিজ্ঞতা তাদের সেই অর্থে সুখকর ছিল না। যদিও এই বাস্তবতা দুঃখজনক। আর স্বাভাবিকভাবেই যারা নিজ খরচে চিকিৎসা নিয়েছেন, সে অর্থ তাদের দিতে হবে। অনেকে ঋণ করে কিংবা সম্পদ বিক্রি করেও হয়তো চিকিৎসা চালিয়েছেন। তাদের সেই অর্থ ফেরত দেওয়া দরকার। নতুন করে দাবি না করলেও সরকারকে তা নিশ্চিত করতে হবে।
সমকাল: জুলাই আন্দোলনে এমন অনেকে গুরুতর আহত হয়েছেন, অথচ সরকারি খাতায় নাম ওঠেনি। তাদের ব্যাপারে কী মত?
মুশতাক হোসেন: সরকারি খাতায় নাম না আসা আহত অনেকেই থাকতে পারেন। অনেকে হয়তো পুলিশের ভয়েই তখন বাড়ি চলে গেছেন। অথচ তাঁর চিকিৎসা জরুরি। তাদের অন্তর্ভুক্তকরণে একটা কমিটি গঠন করা দরকার। এই কমিটিতে ছাত্র যেমন থাকবে, তেমনি পুলিশ ও স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষকেও থাকতে হবে। যেমন কারও আঘাত বা গুলি লাগলে সেটা পরীক্ষা করে দেখা হবে। সেভাবে নিশ্চিত করে তাদের নিবন্ধন করতে হবে। আমরা জানি, হাসপাতালে যারা চিকিৎসা নিচ্ছেন তার বাইরে হয়তো আরও বেশি আহত আছেন। কমিটির মাধ্যমে তাদের দ্রুত সরকারি সেবার আওতায় আনা দরকার।
সমকাল: আহতদের চিকিৎসা নিশ্চিতে করণীয় কী বলে আপনি মনে করেন?
মুশতাক হোসেন: জুলাই গণঅভ্যুত্থানে আহতদের চিকিৎসায় আলাদা দপ্তর গঠন করা জরুরি। যাতে তারা সবকিছুর ‘ওয়ানস্টপ’ সমাধান দিতে পারেন। এখন হাসপাতালে যারা চিকিৎসাধীন তাদের প্রত্যেকের অবস্থা ওই দপ্তরের নখদর্পণে থাকবে। প্রত্যেকের অগ্রাধিকার অনুযায়ী দ্রুত চিকিৎসা নিশ্চিত করবে। যেমন কারও অন্য হাসপাতালে কিংবা বিদেশ নেওয়ার প্রয়োজন হলে সঙ্গে সঙ্গে তার ব্যবস্থা করা। একটা আলাদা ডেস্ক করে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ২৪ ঘণ্টার জন্য যথাযথ ক্ষমতা দিয়ে কাউকে বসাতে পারে। এখানে ক্ষমতা গুরুত্বপূর্ণ।
সমকাল: তারা কী করবেন?
মুশতাক হোসেন: আমরা জানি, সরকারি হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসার ক্ষেত্রে এক ধরনের আমলাতান্ত্রিক জটিলতা থাকে। সিদ্ধান্ত নিতে সক্ষম অস্থায়ী কর্তৃপক্ষ করলে পরিবর্তন আসতে পারে। তিনি প্রয়োজনে পরিচালককেও নির্দেশ দেবেন। ধরেন, বিমানের টিকিট দেওয়ার জন্য তিনি কারও অনুমতির অপেক্ষা করবেন না। নিজের ক্ষমতায় তিনি দ্রুত যে কোনো সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করতে পারবেন। অর্থাৎ র্যাপিড সিদ্ধান্ত নেওয়ার কর্তৃপক্ষ লাগবে।
সমকাল: অনেকের পুনর্বাসন জরুরি। অনেক পরিবারের একমাত্র কর্মক্ষম ব্যক্তি পঙ্গু হয়ে আছেন…।
মুশতাক হোসেন: পুনর্বাসনের বিষয়টি স্বাস্থ্য ও সমাজকল্যাণ বিভাগ মিলে করতে হবে। স্বাস্থ্য পুনর্বাসনটা জরুরি। এটি এমন একটি প্রক্রিয়া, যার মাধ্যমে শারীরিক, মানসিক বা সামাজিকভাবে অসুস্থ বা আঘাতপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের পুনরায় স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনা হয়। এর মূল উদ্দেশ্য হলো ব্যক্তির স্বাস্থ্যের উন্নতি ঘটানো, যাতে তারা স্বাবলম্বীভাবে দৈনন্দিন কাজকর্ম করতে পারেন এবং সমাজে স্বাভাবিকভাবে জীবন যাপন করতে পারেন। এভাবে আহতদের যার যেভাবে পুনর্বাসন ও সহায়তা দরকার সেভাবে করা চাই।
সমকাল: সময় দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ।
মুশতাক হোসেন: আপনাকেও ধন্যবাদ। সমকালের জন্য শুভকামনা।