মধ্য ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু হয়েছে এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষা। এবারের পরীক্ষা ঘিরে কিছু ইতিবাচক ও নেতিবাচক ঘটনা ঘটেছে, যা আগে দেখা যায়নি। পরীক্ষার্থীদের মনোযোগে যাতে বিঘ্ন না ঘটে সে জন্য কেন্দ্র পরিদর্শনে যাননি শিক্ষামন্ত্রী– এটা ইতিবাচক। কিন্তু একই কেন্দ্রে ৫৯ ভুয়া পরীক্ষার্থীর পরীক্ষা দেওয়া কলঙ্কজনক। সন্তোষের বিষয় হলো, তারা ধরা পড়েছে।
এ বছর সারাদেশে তিন হাজার ৭০০টি কেন্দ্রে এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হচ্ছে। আগের হিসাব অনুযায়ী ধারণা করেছিলাম, পরীক্ষার দিন এসব প্রতিষ্ঠানের নিয়মিত শ্রেণি কার্যক্রম বন্ধ থাকে। লেখাটি লিখতে গিয়ে শিক্ষার্থী ও সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের বেশ কয়েকজন শিক্ষকের সঙ্গে কথা বলে জানলাম, বেসরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলো এবার পাবলিক পরীক্ষার দিনগুলোয় দুপুর ২টা থেকে শ্রেণি কার্যক্রম চালাচ্ছে। যেদিন এসএসসি পরীক্ষার বিরতি, সেদিন পুরোদমে ক্লাস চলছে। অন্যদিকে আগের মতোই সরকারি বিদ্যালয়গুলোর এসএসএসি পরীক্ষার শুরু থেকেই ছুটি। অর্থাৎ ১২ মার্চ পর্যন্ত প্রায় মাসব্যাপী চলা এসএসসি পরীক্ষার পুরোটা সময় সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে শ্রেণি কার্যক্রম বন্ধ থাকছে। এসএসসি পরীক্ষার দিনে তো বটেই, দুই পরীক্ষার মাঝের বিরতিতে একই অবস্থা।
তবে বেসরকারি স্কুলগুলোর এ সিদ্ধান্ত নিঃসন্দেহে যুগান্তকারী। এখন এ স্কুলগুলোতে শুধু সকাল ১০টা থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত এসএসসি পরীক্ষার সময়ে নির্ধারিত শ্রেণি কার্যক্রম বন্ধ থাকছে, যদিও দুই শিফটের স্কুলগুলোতে হয়তো পুরো সময়ই শ্রেণি কার্যক্রম বন্ধ রাখতে হচ্ছে। তবে সরকারি বিদ্যালয়ে পুরো সময়টাই ছুটি দিতে হচ্ছে। তিন ঘণ্টার এই হিসাবটা আমলে নিলেও সারাদেশে তিন হাজার ৩০০ প্রতিষ্ঠানের এক দিনেই প্রায় ১০ হাজার ঘণ্টা অপচয় হচ্ছে। ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণির সব শিক্ষার্থীকে বিবেচনায় নিলে এ অপচয় কত ঘণ্টা দাঁড়াবে? পাবলিক পরীক্ষার কারণে অন্যান্য শিক্ষার্থীদের এহেন শিক্ষাঘণ্টা নষ্টের একটা চূড়ান্ত সমাধান দরকার।
বিশেষ করে এখন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় সাপ্তাহিক ছুটি দু’দিন– শুক্র ও শনিবার। এর মধ্যে এই বছরের ১২ মার্চ যখন এসএসসি পরীক্ষা শেষ হবে তখন ১/২ রমজান থাকবে। ইতোমধ্যে শিক্ষা মন্ত্রণালয় সিদ্ধান্ত নিয়েছে, রমজানের মধ্যে ২৫ মার্চ পর্যন্ত বিদ্যালয়ে শ্রেণি কার্যক্রম চালু থাকবে। রমজানে ১৫ দিন পর্যন্ত শ্রেণি কার্যক্রম চলার পর আবার ঈদের ছুটি শুরু। তার মানে সেখানেও শিক্ষার্থীদের শ্রেণি কার্যক্রম কমে যাবে। সে ছুটি অবশ্য সবার জন্য। কিন্তু এসএসসি পরীক্ষার কেন্দ্র থাকার কারণে ওইসব প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের শ্রেণি কার্যক্রম কম হওয়ার কারণে তারা যে পিছিয়ে যাচ্ছে, সে ঘাটতি পূরণের উপায় কী?
কেবল এসএসসি নয়, এইচএসসি পরীক্ষার সময়ও একই ঘটনা ঘটে। যদিও এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় কেন্দ্রসংখ্যা আরও কমে যায়, তারপরও কিন্তু সমস্যা থাকছেই। যেমন গত বছর এইচএসসি ও সমমান পরীক্ষায় ১১টি শিক্ষা বোর্ডে কেন্দ্র ছিল দুই হাজার ৬৫৮টি। সে জন্যই পাবলিক পরীক্ষা অনুষ্ঠানে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বাইরে বিকল্প কেন্দ্র থাকা দরকার। প্রতি বছর অন্তত দু’বার পাবলিক পরীক্ষায় শিক্ষার্থীদের বসতে হয়। তাই স্থায়ী বিকল্প কেন্দ্র থাকলে শিক্ষাঘণ্টার অপচয় রোধ করা সম্ভব হবে। এসব কেন্দ্র কীভাবে নির্মিত হবে এবং পাবলিক পরীক্ষার বাইরে বছরের অন্য সময়ে সেগুলো কীভাবে ব্যবহৃত হবে, তা নিয়েও ভাবা যায়।
অনেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বাইরে উপজেলাভিত্তিক আলাদা পরীক্ষা কেন্দ্রের পরামর্শ দিয়েছেন; যা হবে মাল্টিডিসিপ্লিনারি। অর্থাৎ পাবলিক পরীক্ষার বাইরে অন্য সময়ে তা বিভিন্ন কাজে ব্যবহার করা যায়। এমনও হতে পারে, উপজেলার মধ্যে দুই-তিনটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বাছাই করে সেখানেই আলাদা একটা পরীক্ষা কেন্দ্র হতে পারে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর পর্যাপ্ত জায়গা থাকতে হবে, যাতে খেলার মাঠসহ বিদ্যমান সব সুযোগ-সুবিধা রেখেই সেখানে পরীক্ষা কেন্দ্র নির্মাণ করা যায় এবং তার জন্য যাতে আলাদা ফটক থাকে।
শিক্ষার্থীদের শিক্ষাঘণ্টা রক্ষায় এমন আরও বিকল্প কেন্দ্র বা ব্যবস্থার কথা চিন্তা করা যেতে পারে। এমনকি আশপাশের তিন-চারটা প্রতিষ্ঠান মিলে একটা কেন্দ্র হতে পারে, যাতে পাবলিক পরীক্ষাও নেওয়া যায় আবার নিয়মিত শ্রেণি কার্যক্রমও চালানো যায়। উপরন্তু যাতায়াতের পেছনে পরীক্ষার্থীদের বাড়তি সময়ও দিতে হবে না এ ব্যবস্থায়। সে ক্ষেত্রে হয়তো শিক্ষা প্রশাসনে আরও কিছু জনবল লাগবে। শিক্ষার স্বার্থে সেটা করতেই হবে। পরীক্ষার কেন্দ্র হতে গেলে একেবারে পুলিশ লাগবে, কড়া নিরাপত্তা বেষ্টনী– এমন বাঁধা-ধরা নিয়ম নেই। তবে এবার যেমন একটি কেন্দ্রে এত ভুয়া শিক্ষার্থী ধরা পড়ল; ভয়টা সেখানেই। ব্যক্তিগতভাবে প্রত্যেকেই যদি আমরা সৎ হই, অসদুপায় অবলম্বন না করি তবে অনেক খরচই বাঁচানো সম্ভব। খুবই বেদনাদায়ক বিষয়, এর সঙ্গে এমনকি শিক্ষকরাও জড়িত। নতুন শিক্ষাক্রমসহ শিক্ষায় নতুন অনেক প্রকল্প বাস্তবায়ন হচ্ছে। শিক্ষার উন্নয়নে তাই স্বতন্ত্র পাবলিক পরীক্ষা কেন্দ্রের বিষয়কেও গুরুত্ব দিতে হবে। এখানে খরচের চেয়েও সদিচ্ছা জরুরি। রাতারাতি না হলেও ধীরে ধীরে জেলা বা বিভাগভিত্তিক উদ্যোগ নিলে কয়েক বছরের মধ্যে সারাদেশে পরীক্ষার বিকল্প কেন্দ্র গড়ে উঠতে পারে।