আজকের সাক্ষরতা দিবসের প্রাক্কালে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের তরফে আমরা জানছি, দেশে বর্তমান সাক্ষরতার হার ৭৩.৯ শতাংশ। এখনও প্রায় ২৬ শতাংশ মানুষ নিরক্ষর। অর্থাৎ শতভাগ সাক্ষরতা অর্জনে বাকি এ সংখ্যাটি। এর সঙ্গে আরেকটি হিসাবও জরুরি। এ জন্য একটু পেছনে ফিরতে হবে। ঠিক ১০ বছর আগে আমরা দেখেছি, তখন সরকার ২০১৪ সালের মধ্যে শতভাগ সাক্ষরতা অর্জনের অঙ্গীকার করে। ২০১২ সাল পর্যন্ত জোরেশোরে এ প্রচারণা চলে। তখন উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরোর ওয়েবসাইট খুললেই লেখা উঠত- 'উই আর কমিটেড টু এনশিউর হান্ড্রেড পার্সেন্ট লিটারেসি বাই টোয়েন্টিফোরটিন।' কিন্তু ২০১২ সালের সাক্ষরতা দিবসের দু'দিন পর আমরা জানতে পারলাম- সে সময়ের প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রীর ভাষায়, '২০১৪ সালের মধ্যে দেশ থেকে নিরক্ষরতা দূরীকরণের ঘোষণা থাকলেও সম্ভব হচ্ছে না। তবে আমরা একটি ট্র্যাকে পৌঁছাতে চাই।' হঠাৎ করে সম্ভব না হওয়ার কারণ অনুসন্ধান করে আমি ওই সময় সাক্ষরতা দিবসে (৮ সেপ্টেম্বর ২০১২) সমকালেই লিখেছিলাম, 'দুটি প্রকল্পের পোস্টমর্টেম এবং শতভাগ সাক্ষরতা'। সে সময় সরকার দুটি প্রকল্প হাতে নেয়। প্রথমটি ৬১ জেলার নিরক্ষরদের সাক্ষর করার জন্য, ব্যয় ২ হাজার ৯৬২ কোটি টাকা আর অন্যটি এর বাইরের তিনটি পার্বত্য জেলার জন্য, ব্যয় ৫০ কোটি টাকার কিছু বেশি। সে সময় টাকার অভাব দেখিয়ে প্রকল্প দুটি বাস্তবায়ন করেনি সরকার। আর ওই দুটি প্রকল্প যখন বাতিল হলো, তখন শতভাগ সাক্ষরতার স্লোগানও শেষ হলো। তার মানে শতভাগ সাক্ষরতার স্লোগান ছিল প্রকল্পসর্বস্ব। আরও আশ্চর্যের বিষয়, সে সময় দুটি প্রকল্পের স্থানে গ্রহণ করা হয় মৌলিক সাক্ষরতা প্রকল্প। সেই প্রকল্পই মেয়াদ বাড়িয়ে এখনও চলছে। গত এক বছরে তার সুফল হলো সাক্ষরতার হার বেড়েছে মাত্র ১ শতাংশ। এভাবে করে ২০১৪ সাল থেকে পিছিয়ে আসা 'শতভাগ সাক্ষরতা' আমাদের কবে অর্জিত হবে?
সরকারি হিসেব মতে, এখনও তিন কোটি ২৫ লাখ মানুষ নিরক্ষর। নিরক্ষরতা সমাজের কত বড় অভিশাপ, তা বলাবাহুল্য। জ্ঞান-বিজ্ঞানের উৎকর্ষতার এ সময়ে মানুষ যখন মহাকাশ জয় করছে, সমুদ্র জয় করছে। একদল যখন বিশ্বজয়ে বিভোর, আরেক দল মানুষ তখন নিরক্ষরতার অন্ধকারে থাকবে, তা কী করে হয়! এ লজ্জা আমাদেরই। আমরা যারা সাক্ষরজ্ঞান সম্পন্ন লিখতে-পড়তে জানি, হিসাব করতে পারি, যোগাযোগ করতে পারি, সুন্দরভাবে জীবন পরিচালনা করতে পারি- দায়িত্বটা আমাদেরও। আমাদের সামনেই একজন মানুষ চোখ থাকতেও 'অন্ধ' হবে, সেটি মেনে নেওয়া যায় না। সরকারের সঙ্গে আমরাও যদি নিজেদের উদ্যোগে সাক্ষরতার কাজে মনোনিবেশ করি, তাতে অনেকেই উপকৃত হবে। প্রায় ৭৪ শতাংশ মানুষ ব্যক্তিগত উদ্যোগে চেষ্টা করলে বাকি মানুষগুলোর সাক্ষরতা নিশ্চিত করা সহজ হবে। তারপরও সরকারকেই সর্বাগ্রে উদ্যোগী হওয়া দরকার। এ জন্য দীর্ঘমেয়াদে প্রকল্প গ্রহণের চেয়ে স্বল্পমেয়াদে দেশব্যাপী দুই সপ্তাহের একটা অভিযান পরিচালনা করা যেতে পারে। যেখানে বিশেষত কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের দিয়ে এলাকাভিত্তিক ভাগ করে নিরক্ষর মানুষদের সাক্ষরতার কাজে নিয়োজিত করা যায়। এরপর নব্যসাক্ষরদের সাক্ষরতা কার্যক্রম চালিয়ে নিতে স্বল্প-মধ্য বা দীর্ঘমেয়াদে প্রকল্প নেওয়া যেতে পারে।
গত দশ বছরে শিক্ষায় সরকারের অর্জন কম নয়। এসব অর্জন নিরক্ষরতার কাছে ম্রিয়মাণ হোক সেটি কাম্য নয়। সাক্ষরতা অর্জনে সরকারের সদিচ্ছাও জরুরি। ২০১১ সালের দিকে সমকালেই একটি প্রতিবেদনে প্রকাশ হয়েছিল, যেখানে বলা হয়- সাক্ষরতা কার্যক্রমে ছাত্রলীগ সহায়তা করবে। সেটাও ভালো উদ্যোগ। কিন্তু তারও বাস্তবায়ন আমরা দেখিনি। আবার আমরা সংবাদমাধ্যমে এমনও প্রতিবেদন দেখেছি, যেখানে বর্তমান মৌলিক সাক্ষরতা প্রকল্পের দায়িত্ব পেয়েছে নিবন্ধন না থাকা এনজিও, যাদের বিরুদ্ধে প্রকল্পের টাকা আত্মসাতের অভিযোগ রয়েছে। এসব ব্যাপার অবশ্যই খতিয়ে দেখতে হবে। প্রকল্পের টাকা কোনোভাবে যেন নয়ছয় না হয়। প্রায় শতভাগ শিক্ষার্থী বিদ্যালয়ে যাচ্ছে, এটি আমাদের বড় অর্জন। কিন্তু ঝরে পড়া রোধ করতে না পারাটা এখনও চ্যালেঞ্জ। উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যবস্থায় এসব শিশুর প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিত করতে পিইডিপি-৪-এর আওতায় ৮-১৪ বছর বয়সী বিদ্যালয়বহির্ভূত ১০ লাখ শিশুকে উপানুষ্ঠানিক প্রাথমিক শিক্ষা প্রদানের উদ্যোগ নেওয়ার কথা আমরা জেনেছি। ঝরে পড়া রোধে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে মিড ডে মিল বা দুপুরের খাবারও ইতিবাচক ভূমিকা পালন করবে। মিড ডে মিল এখন অনেক বিদ্যালয়ে চালু রয়েছে, কয়েক বছরের মধ্যে তা শতভাগ বিদ্যালয়ে নিশ্চিত করার কথা ভাবছে সরকার। একই সঙ্গে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পরীক্ষা উঠিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্তও এখানে ইতিবাচক ভূমিকা পালন করবে। ২০২১ সাল থেকে এ পরীক্ষা হবে বলে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সংবাদ সম্মেলন থেকে আমরা জেনেছি।
এ বছর ইউনেস্কো আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবসের প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করেছে, 'বহু ভাষার সাক্ষরতা, উন্নত জীবনের নিশ্চয়তা'। গোটা বিশ্ব যখন একটা 'গ্লোবাল ভিলেজ' তখন ইউনেস্কোর এ প্রতিপাদ্য যুগোপযোগী। বিশ্বের অপর প্রান্তের মানুষের সঙ্গে আমরা সহজেই যোগাযোগ করতে পারি। এ জন্য একাধিক ভাষায় কথা বলার সমতা ও ভাষাগত বিভক্তি সত্ত্বেও যোগাযোগ করতে পারা একটি দক্ষতা বটে। এমনিতে যোগাযোগ দক্ষতাও সাক্ষরতার অন্যতম অংশ। ইউনেস্কো ভাষার বিষয়টি প্রতিপাদ্য করে তা আরও পোক্ত করছে। তবে সাক্ষরতার ব্যাপ্তি যে আরও বাড়ছে, সেটিও এ প্রতিপাদ্য প্রমাণ করছে। কেবল নিজের ভাষায় সীমাবদ্ধ না থেকে একাধিক ভাষার দক্ষতা আজকের বিশ্বে নতুন ধরনের সাক্ষরতা। এ জন্য আমাদের ভাষা শিক্ষার সম্প্রসারণ ঘটাতে হবে। বিশেষ করে আমাদের মতো দেশে যেখানে লাখ লাখ শ্রমিক মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কাজ করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করে। এসব শ্রমিক দেশ থেকেই ওইসব দেশের ভাষা শিখে যেতে পারলে তাদের কাজ পাওয়া যেমন সহজ হবে, তেমনি বেশি বেতনে চাকরিও এ ভাষাই নিশ্চিত করবে।
তবে সবার আগে আমাদের নজর দিতে হবে নিরক্ষর মানুষদের সাক্ষরতায়। তিন কোটির অধিক মানুষের অন্ধকার দূর করতে অগ্রাধিকার দিতে হবে সরকারকে। প্রকল্পের ওপর নির্ভরশীল না হয়ে সবাইকে নিয়েই সাক্ষরতা অভিযান পরিচালনা করলে দ্রুত সময়ে সুফল পাওয়া যাবে। ২০১৪ সালে যেখানে শতভাগ সাক্ষরতার অঙ্গীকার ছিল, সেখান থেকে যখন আমরা পিছিয়ে পড়েছি, কয়েক বছর হাতে রেখে নতুন আরেকটি অঙ্গীকার নিয়ে নবউদ্যমে কাজ করলেই আমরা দেখব- শতভাগ সাক্ষরতা বেশিদূর নয়।