Mahfuzur Rahman Manik
জেলে থেকেই লড়ে দেখালেন ইমরান খান
ফেব্রুয়ারী 13, 2024

চার্লি ক্যাম্পবেল

তাঁকে গুলি করা হয়েছে। জেলে ভরা হয়েছে। নিষিদ্ধ করা হয়েছে তাঁর দলকে। মূলধারার সংবাদমাধ্যমে তাঁর ও দলের নামে সংবাদ প্রকাশে এক ধরনের নিষেধাজ্ঞাও দেওয়া হয়। কিন্তু কোনো কিছুতেই ইমরান খানকে থামানো যায়নি।

বৃহস্পতিবার অনুষ্ঠিত পাকিস্তানের নির্বাচনের প্রাথমিক ফলে দেখা যাচ্ছে, ব্যাপক অনিয়ম সত্ত্বেও পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ তথা পিটিআই সমর্থিত স্বতন্ত্র প্রার্থীরা সেখানে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করতে যাচ্ছেন। তবে এটি আটকে দিতে ফল প্রকাশে বিলম্বসহ বিভিন্ন পদক্ষেপ দেখা গেছে। পিটিআইকে তার কাঙ্ক্ষিত ক্রিকেট ব্যাট প্রতীকে নির্বাচন করতে দেওয়া হয়নি। নির্বাচনের দিন মোবাইল নেটওয়ার্ক বন্ধ করে দেওয়া হয়, যাতে দলটি তাদের সমর্থিত প্রার্থীদের কথা সংশ্লিষ্ট ভোটারদের না জানাতে পারে। (সরকার এর পেছনে নিরাপত্তার অজুহাত দেখালেও পাকিস্তান হাইকোর্ট এমন পদক্ষেপকে অবৈধ ঘোষণা করেছেন)। বুথফেরত জরিপও নিষিদ্ধ করা হয়। পিটিআই অভিযোগ করেছে, তাদের এজেন্টদের ভোটকেন্দ্রে নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করতে দেওয়া হয়নি। টাইম ম্যাগাজিনকে ইমরান খানের মন্ত্রী জুলফি বুখারি বলেছেন, ‘কল্পনাতীত কারচুপি হচ্ছে।’

এমনকি নির্দিষ্ট সময়ের ১০ ঘণ্টা পর ফল ঘোষণার বিষয়টিকে পর্যবেক্ষকরা বলেছেন, এটা বেশ সন্দেহজনক। শুক্রবার এ লেখা পর্যন্ত ভোট গণনায় পাকিস্তানের তিনবারের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফের দল পাকিস্তান মুসলিম লীগ-নওয়াজ তথা পিএমএল-এনের সঙ্গে পিটিআইয়ের হাড্ডাহাড্ডি লড়াই দেখা গেছে। তৃতীয় অবস্থানে আছেন আততায়ীর হাতে নিহত সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেনজির ভুট্টোর ছেলে বিলাওয়াল ভুট্টো জারদারির নেতৃত্বাধীন দল পাকিস্তান পিপলস পার্টি (পিপিপি)।

পাকিস্তানের এবারে নির্বাচনে নওয়াজ শরিফ দেশটির প্রভাবশালী সামরিক বাহিনীর পছন্দের প্রার্থী। ক্ষমতাচ্যুত নওয়াজকে তারা তিনবার সমর্থন দিয়েছে। নির্বাসনে থাকা ৭৪ বছর বয়সী নওয়াজকে সম্প্রতি যুক্তরাজ্য থেকে আসার অনুমতি দিয়েছে, তাঁর দুর্নীতির অভিযোগ বাতিল করা হয়েছে এবং রাজনৈতিক নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা হয়েছে। এত দ্রুত নওয়াজকে সব কিছু থেকে মুক্তি দিয়ে জেনারেলরা ইমরান খান ও তাঁর দলের বিপরীতে দাঁড় করিয়েছে। অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির সরকার ও জননীতি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মায়া টিউডর বলেছেন, পাকিস্তানে ‘সামরিক বাহিনীর মৌন সম্মতি ছাড়া কেউই শাসন করতে পারে না। এবার ব্যতিক্রম যেটা দেখা গেছে, সামরিক বাহিনী প্রকাশ্যেই পিটিআইকে টার্গেট করেছে, কারণ দলটির তৃণমূল পর্যন্ত জনসমর্থন রয়েছে এবং তারা প্রযুক্তি ব্যবহারে এগিয়ে।’

পিটিআই সব প্রতিকূলতা মাড়িয়ে পার্লামেন্টে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করলেও সরকার গঠনে অনেক বাধা ডিঙাতে হবে। দলটির নির্বাচিত প্রতিনিধিরা আইন অনুযায়ী স্বতন্ত্র বলে তাদের কোনো দলের নির্দেশনা অনুসরণ করার বাধ্যবাধকতা নেই; এতে শঙ্কা তৈরি হয়েছে, তারা জোরপূর্বক দলত্যাগের শিকার হতে পারেন। তা ছাড়া নারী ও সংখ্যালঘুদের জন্য জাতীয় পরিষদে যে ৭০টি ‘সংরক্ষিত আসন’ আছে, তা পিটিআই পাবে না। একই সঙ্গে ৭১ বছর বয়সী ইমরান খান এখন কারাগারেই আছেন এবং তাঁকে নির্বাচনে দাঁড়ানোর অযোগ্য ঘোষণা করা হয়েছে। নির্বাচনের আগে পিএমএল-এন ও পিপিপির মধ্যে ক্ষমতার ভাগাভাগির ব্যাপক গুঞ্জন ওঠে, যেখানে নওয়াজ শরিফ প্রধানমন্ত্রী এবং বিলাওয়াল ভুট্টো প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন। তাদের দুই দলের জোট সর্বাধিক আসন পাচ্ছে।

তারপরও পাকিস্তানের নির্বাচনে পিটিআই যে শক্তি দেখিয়েছে, তা সামরিক বাহিনীর জন্য পরাজয়তুল্য। অবশ্য ২০১৮ সালের নির্বাচনে সামরিক বাহিনী ইমরান খানকে সমর্থন দিয়েছিল। পরে জাতীয় ক্রিকেটের সাবেক এই অধিনায়কের সঙ্গে তাদের বিরোধ দেখা দেয় এবং ২০২২ সালের এপ্রিলে অনাস্থা ভোটে ইমরান খানকে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়। এরপর তাঁকে হত্যাচেষ্টা করা হয়। তিনি বেঁচে গেলেও মাত্র ছয় মাসে ১৮০টির বেশি মামলার শিকার হন। নির্বাচনের সপ্তাহখানেক আগে তাঁকে দুর্নীতি, রাষ্ট্রীয় গোপনীয়তা ফাঁস এবং ‘অনৈসলামিক’ বিয়ের জন্য মোট ৩১ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়।

এরপরও ভোটের আগে তাঁর জনপ্রিয়তা ছিল তুঙ্গে। বিশেষ করে, ১৮-৩৫ বছর বয়সী তরুণদের মধ্যে তিনি ব্যাপক জনপ্রিয়। এই তরুণরা ১৩ কোটি ভোটারের মধ্যে ৪৫ শতাংশ। যুক্তরাষ্ট্রের উইলসন সেন্টারের দক্ষিণ এশিয়া ইনস্টিটিউটের পরিচালক মাইকেল কুগেলম্যান বলেছেন, ‘সামরিক বাহিনী ইমরান খানকে নিয়ে এমনিতেই যে বেকায়দায় ছিল, তা স্পষ্ট এবং এরপর নির্বাচনে পিটিআইয়ের প্রত্যাশার চেয়ে বেশি ভোট পাওয়ার বিষয়টি তাদের জন্য আরও বড় ধাক্কা।’

পাকিস্তানের নতুন নেতৃত্বের সামনে সমস্যার পাহাড়। দেশটিতে এখন এশিয়ার সর্বোচ্চ মুদ্রাস্ফীতি। এক বছর আগের ডিসেম্বরের বছরের তুলনায় এখন তা বেড়ে ২৯.৭ শতাংশে পৌঁছেছে। দক্ষিণ এশীয় দেশটি গত গ্রীষ্মে আইএমএফের ৩ বিলিয়ন ডলার ঋণের কারণে কোনোমতে দেউলিয়া হওয়া থেকে বেঁচে গেছে এবং অর্থনৈতিক দুর্যোগ এড়াতে আগামী মাসের মধ্যে এর জন্য নতুন একটি চুক্তি অপরিহার্য হয়ে পড়েছে। পাকিস্তান একই সঙ্গে নিরাপত্তার সংকটে আছে, দেশটির সীমান্তে উত্তেজনা বাড়ছে। আফগান তালেবানের সঙ্গে ঐতিহাসিকভাবে দৃঢ় সম্পর্ক থাকার পরও সাম্প্রতিক আন্তঃসীমান্ত সন্ত্রাসী হামলা এবং কয়েক হাজার আফগান শরণার্থীকে বহিষ্কারের কারণে ইসলামাবাদের সঙ্গে কাবুলের সম্পর্ক খারাপ হয়েছে। গত মাসে ইরান পাকিস্তানের ভূখণ্ডে কথিত জঙ্গি ঘাঁটিতে বিমান হামলা চালায়, পাকিস্তানও এর জবাব দেয়। তা ছাড়া ভারতকে পাকিস্তানের ভূখণ্ডে গুপ্তহত্যা চালানোর জন্য সম্প্রতি অভিযুক্ত করে ইসলামাবাদ। এতে তার ঐতিহাসিক শত্রু-প্রতিবেশীর সঙ্গে সম্পর্কের আরও অবনতি ঘটে।

যাহোক, পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী পিটিআইকে ক্ষমতার বাইরে রাখতে সব ধরনের ব্যবস্থা অব্যাহত রাখছে। প্রশ্ন হলো, ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত করার প্রতিক্রিয়া কীভাবে পিটিআই সমর্থকরা জানাবেন। এর আগে গত বছরের ৯ মে পিটিআই সমর্থকরা ইমরান খানকে গ্রেপ্তারের প্রতিক্রিয়া হিসেবে সেনানিবাসে ভাঙচুর চালান। ইমরান খান কারান্তরীণ বটে, তবে বৃহস্পতিবারের নির্বাচনের ফল বলছে, রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে তাঁর প্রভাব এখনও বিদ্যমান।

মাইকেল কুগেলম্যান যেমনটা বলেছেন, ‘সেনাবাহিনী চায় পরবর্তী সরকার অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের দিকে মনোনিবেশ করুক এবং তারা আশা করে, এর মাধ্যমে এবং ইমরান খানকে কয়েক বছরের জন্য জেলে রাখলে তাঁর প্রভাব কমবে, কিন্তু দেশটির চ্যালেঞ্জ বাড়বেই, কারণ পিটিআই তাতে আরও সংক্ষুব্ধ হয়ে উঠবে।’

চার্লি ক্যাম্পবেল: যুক্তরাষ্ট্রের টাইম সাময়িকীর সাংবাদিক; টাইম ডটকম থেকে ভাষান্তর
মাহফুজুর রহমান মানিক

সমকালে প্রকাশ: ১০ ফেব্রুয়ারি ২০২৪

ট্যাগঃ ,

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।