Mahfuzur Rahman Manik
একটি দুয়ার বন্ধ হলে হাজারটা দুয়ার খোলে
অক্টোবর 31, 2023
student-suicide-rate-rising in Bangladesh

জীবন বাঁচানোর জন্য কত আয়োজন! শেষ চেষ্টা হিসেবে হাসপাতালে আইসিইউ বা লাইফ সাপোর্টের জন্য স্বজনের কত আকুতি! এক হাসপাতাল থেকে অন্য হাসপাতালে দৌড়াদৌড়ি। সাঁতার না জানা ব্যক্তিও কিছু একটা আঁকড়ে ধরে বাঁচতে চায়। সাপ দেখলে বাঁচার জন্য যত দ্রুত সম্ভব দৌড়াতে কেউ কুণ্ঠিত হয় না। দুর্যোগে আশ্রয়কেন্দ্রে মানুষের হুড়োহুড়ি। সবাই একটু বাঁচতে চায়। ভিক্ষা করে হলেও জীবন বাঁচাতে হবে। বাঁচার এই আয়োজনের মধ্যে আত্মহত্যা বড়ই বেমানান। তারপরও কেউ কেউ সেই পথ বেছে নেয়।

গোটা বিশ্বই আত্মহত্যা-সংকট মোকাবিলা করছে। কিন্তু বাংলাদেশের চিত্র ভিন্ন। পরিসংখ্যান বলছে, শিক্ষার্থী ১৩ থেকে ১৯ বছর বয়সীরা বেশি আত্মহত্যা করছে। আঁচল ফাউন্ডেশনের তথ্যমতে, চলতি বছরের প্রথম ৯ মাসে সারাদেশে ৪০৫ শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছে। কোনো পর্যায়ের শিক্ষার্থীই এর বাইরে নেই।
শিক্ষার্থীরা আপাত সামান্য কারণেই আত্মহত্যা করে থাকে। চলতি মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে পটুয়াখালীর দশম শ্রেণির এক শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছে নির্বাচনী পরীক্ষার ফি দিতে না পারায় শিক্ষকের বকাঝকা সইতে না পেরে। কিশোর-কিশোরী, তরুণ-তরুণীদের মধ্যে বয়সের কারণে নানা ধরনের আবেগ কাজ করে। ‘ছোট্ট’ অপমান তাদের কাছে বড় হয়ে উঠতে পারে। আবার মা-বাবা, শিক্ষক, আত্মীয়দের প্রত্যাশাতেও তারা চাপ অনুভব করে। যেমন পরীক্ষার ফল সংক্রান্ত আত্মহত্যা। এর সঙ্গে সামাজিক কারণ নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ।

কেউ ‘জিপিএ ফাইভ’ পেয়েছে মানে, তাকে সামাজিকভাবে সফল ধরা হয়। সমাজ একে এতটা মহিমান্বিত করেছে যে, হাতছাড়া হলে হাজারো মানুষের কথা শুনতে হয়। মা-বাবা, আত্মীয়স্বজন, শিক্ষক– কেউই ছাড়বেন না। অমুকে পেয়েছে, তুমি পাবে না কেন? অতিরিক্ত সামাজিক প্রত্যাশা আর হুজুগে শিক্ষার্থীর দফারফা। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের সংকট আরও বেশি। কারণ দিন দিন তাদের হতাশা বাড়ে। সমাজ তাদের বোঝায়– ভোগেই সুখ। সফলতা পেতে হলে অনেক টাকা, ভালো চাকরি লাগবে। এই প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়লে হতাশা দানা বাঁধে।

একবার, দু’বার, তিনবার এভাবে পাঁচ-ছয়বার বিসিএস দিয়েও চাকরিটা হয় না। তখন ভাবনা আসতে পারে– জীবনটাই বুঝি ব্যর্থ হয়ে গেল। প্রতি বছর অন্তত চার লাখ শিক্ষার্থী বিসিএসে অংশগ্রহণ করেন। এর মধ্যে হয়তো দুই-আড়াই হাজার ‘ক্যাডার’ হন। কিন্তু সেই সোনার হরিণের পেছনে ছুটতে ছুটতে অনেকে ক্লান্ত; হতাশায় আচ্ছন্ন। আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্রে এটিই ‘সিস্টেম’। এর দায়ও সবার। অথচ পেশার ক্ষেত্রে ‘সামাজিক ট্রেন্ড’ শেষ কথা হতে পারে না। সমাজ যেটি কাঙ্ক্ষিত পেশা মনে করে সেটি বাস্তবে অনেকের পছন্দ না-ও হতে পারে। কারণ জীবন সরলরৈখিক নয়। দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে কেউ একটা অবস্থানে যায়; কেউ কাঙ্ক্ষিত চাকরি বা পদ পায়; কেউ প্রিয় মানুষকে বিয়ে করতে সক্ষম হয়। এসব প্রাপ্তির পর এমন নয় যে, বাকি জীবন আরাম আর আরাম। মানুষকে নানামুখী চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হয়। কারও হয়তো প্রমোশন হয় না; কারও কর্মক্ষেত্রে অশান্তি; কারও পরিবারে শতভাগ বনিবনা হয় না। এর মধ্য দিয়েই মানুষ বেঁচে থাকে। মানুষকে সংগ্রাম করেই বেঁচে থাকতে হয়। ছোটখাটো প্রতিকূলতা মানুষ হাসিমুখে মেনে নেয়। এটিই জীবনের সৌন্দর্য।

‘পাছে লোকে কিছু বলে’ ভেবে আমরা কেন থামব? একটি দুয়ার বন্ধ হলে হাজারটা দুয়ার উন্মুক্ত হওয়ার উদাহরণ কি আমরা জানি না? এক দুয়ার বন্ধ দেখে থেমে না গিয়ে অপর দুয়ারের কাছে যেতে হবে। চারদিকে তাকালে দেখা যাবে, নিজের চেয়েও কত নাজুক অবস্থায় মানুষের জীবন কাটছে! কবিতায় পড়েছি- ‘একদা ছিল না জুতা চরণ যুগলে…’। জীবনে উত্থান-পতন আসবেই। এক পর্যায়ে মৃত্যুও অনিবার্য। কিন্তু নিজ থেকে মৃত্যুর কাছে সঁপে দেওয়ার কোনো অর্থ নেই।

মানুষের জীবনের তাৎপর্য ও ব্যাপকতার তুলনায় আত্মহননের সব কারণই তুচ্ছ হতে বাধ্য। মানুষের সম্ভাবনা এত বেশি, যে কোনো সময় জীবনের মোড় ঘোরানোর ঘটনা ঘটতে পারে। আমাদের নির্দয় সিস্টেম, প্রতিযোগিতার এই ক্ষেত্র, আধুনিক ভোগবাদিতা ইত্যাদি চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করেই টিকে থাকতে হবে।

এই সমাজটা খোলা ম্যানহোলের মতো। আপনাকেই সতর্ক থাকতে হবে। আপনি আত্মহত্যার পথ নিলেন মানে পরাজয় মেনে নিলেন। দৃশ্যপট থেকে আপনার বিদায় মানে আপনি হেরে গেলেন। আপনার জন্য দুনিয়া এক সেকেন্ডের জন্যও থেমে থাকবে না। আপনি হয়তো কাউকে না পেয়ে আত্মহত্যা করছেন; তাতে তার কিছুই আসবে যাবে না। আপনি আজ জিপিএ ফাইভ পাননি; কাল অন্য ক্ষেত্রে সফল হবেন। জীবনে পরিমিতিবোধ জরুরি। জীবনের বাস্তবতার শিক্ষা শিক্ষার্থীদের দেওয়া উচিত। নিদারুণ দারিদ্র্য থেকে কত মানুষ আজ উঠে এসেছে! প্রতিকূল সামাজিক বাস্তবতা ঠেলে কত মানুষ উঠে দাঁড়িয়েছে! তাদের জীবনও অনেকের জন্য উৎসাহ দিতে পারে। কিন্তু এটাও মনে রাখতে হবে, প্রত্যেকের জীবন বাস্তবতা আলাদা। নিজ অবস্থান অনুসারে আপনার কৌশল আপনাকেই ঠিক করতে হবে। সাধারণ সংগ্রামী জীবনেই মানুষ অসাধারণ।

সমকালে প্রকাশ: ৩০ অক্টোবর ২০২৩

ট্যাগঃ , ,

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।