Mahfuzur Rahman Manik
ভেঙে পড়ছে ইসরায়েলি মিথ
অক্টোবর 31, 2023

প্রতিষ্ঠার পর থেকেই ইসরায়েল তার নিজের একটা চটকদার ভাবমূর্তি তৈরি করেছিল; যার ভিত্তি হিসেবে বলা হয়েছিল গণতন্ত্র ও স্থিতিশীলতার কথা। এর প্রধান লক্ষ্য ছিলো শক্তিধর পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলো, যারা অসম রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামরিক শক্তির অধিকারী। এ পশ্চিমা সরকারগুলো প্রভাবশালী মূলধারার করপোরেট সংবাদমাধ্যমকে সঙ্গে নিয়ে খুব গণতান্ত্রিক এবং অত্যন্ত স্থিতিশীল হিসেবে ইসরায়েলের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করার কাজটি নিষ্ঠাভরে পালন করেছে। একই সঙ্গে এরা আরব এবং ইসরায়েলের শত্রু ফিলিস্তিনিদের কিংবা যারাই ইসরায়েলের সমালোচনা করেছে তাদের ভাবমূর্তিতে কালিমা লেপন করেছে।

ইসরায়েল আসলেই গণতন্ত্র ও স্থিতিশীলতার বাতিঘর ছিল কিনা, তাতে কিছু আসে যায় না। কারণ এসব পরিভাষা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বলা হয় বা ব্যবহার করা হয় ওই ক্ষমতাধর দেশগুলোর সুবিধার্থে। আর এ বন্দনা টিকিয়ে রাখার জন্য ইসরায়েলের কাজও সহজ ছিল: দেশে গণতন্ত্রের মুখোশ পরে থাকা; এমনকি যদিও এই গণতন্ত্র ছিল বর্ণভিত্তিক এবং বর্জনবাদী। ইসরাইলকে যথেষ্ট ‘স্থিতিশীল’ বলা হয় বিদেশি কোম্পানিগুলোর মধ্যে এ বিশ্বাস জন্মানোর জন্য, ইসরায়েলে তাদের বিনিয়োগ নিরাপদ।

অনেক বছর ধরে এভাবেই এ ধারণাটা গড়ে তোলা হয়েছে– ইসরায়েল হলো ‘মধ্যপ্রাচ্যের একমাত্র গণতান্ত্রিক দেশ’; ‘স্বাধীনতা ও স্থিতিশীলতার মরূদ্যান’, যা ‘বিশ্বের সবচাইতে নৈতিক সেনবাহিনী’ দ্বারা সুরক্ষিত ইত্যাদি।

কিন্তু এই ভুয়া বাস্তবতা টিকিয়ে রাখার উদ্দেশ্য হলো ইসরায়েলের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করা এবং আরবদের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করা; তাদের যতটা পারা যায় হীনভাবে উপস্থাপন করা। যদিও সত্য হলো, ইসরায়েল দাঁড়িয়ে আছে অবৈধভাবে দখল করা আরব ভূমির ওপর। এ জন্য তারা ফিলিস্তিনি ও অন্য আরব জাতির ওপর বারবার যুদ্ধ চাপিয়ে দিয়েছে। এখন পর্যন্ত এই ইসরায়েল মডেলের সবচেয়ে ভালো উপস্থাপন করতে পেরেছেন ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনইয়ামিন নেতানিয়াহু। ১১ বছর আগে (১৩ সেপ্টেম্বর ২০১২) ইহুদীদের রোশ হাসানাহ উদযাপন উপলক্ষে দেওয়া এক বক্তব্যে ইসরায়েলি শীর্ষ সেনা কমান্ডারদের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘আমরা একটা অস্থিতিশীল ও ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ অঞ্চলে বাস করি। এই এলাকা ক্রমশ বিস্ফোরণোন্মুখ হচ্ছে, ঝড়ের শঙ্কাও বাড়ছে। ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা বাহিনীর শক্তি এটা নিশ্চিত করতে সাহায্য করেছে– ঝড়ের মধ্যে আমরা স্থিতিশীল একটি বিচ্ছিন্ন দ্বীপ।’

তবে ওই বক্তব্যে নেতানিয়াহু দুটি বিষয় এড়িয়ে গেছেন। প্রথমটি হলো, মধ্যপ্রাচ্যের আধুনিক ইতিহাসে সেই ‘বিস্ফোরণ ও ঝড়’-এর অধিকাংশই ইসরায়েলের সৃষ্টি। ইসরায়েলের সামরিক অভিযান, দখল এবং স্থিতিশীলতা নষ্টকারী অন্যান্য বিষয় এর প্রধান কারণ। আর দ্বিতীয়টি, দার্শনিক হেরাক্লিটাসের ভাষায়, ‘জীবনে সবচেয়ে ধ্রুব সত্য বিষয় হলো– পরিবর্তন’।

সেই বক্তব্যের ১১ বছর পর আজ ইসরায়েল নিশ্চয় উপলব্ধি করছে, তারা ‘অস্থিতিশীল ও ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ অঞ্চল’ থেকে বিচ্ছিন্ন কোনো দ্বীপ নয়।

বিশ্বের এই অঞ্চলে সেনা অভ্যুত্থান, বিপ্লব, রাজনৈতিক সংকট, অর্থনীতি ভেঙে পড়া ইত্যাদি যা-ই ঘটছে তার অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পশ্চিমারা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িত ছিল। আরবরা মানব জাতির ইতিহাসে সবচাইতে বড় ও সবচেয়ে মহান সভ্যতাগুলোর অন্যতম নির্মাতা। তারা সহজাতভাবে ‘বিশৃঙ্খল’ নয়, যেমনটা ইসরায়েল ও তার পশ্চিমা হিতাকাঙ্ক্ষীরা প্রপাগান্ডা চালিয়ে থাকে।

সেসব কথা অবশ্য এখন সেকেলে। কারণ ইসরায়েল নিজেই রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা ও সামাজিক বিশৃঙ্খলার প্রতীক। ৭ সেপ্টেম্বর ভাইরাল হওয়া এক ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে, ইসরায়েরেলের ‘অভিজাত’ গোলানি ব্রিগেডের এক দল সৈন্য তাদের নিজেদের সামরিক ঘাঁটি ধ্বংস করছে।

ফাঁস হওয়া ভিডিওকে একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা হিসেবে বাতিল করা যেতে পারত, যদি সেখানে রিজার্ভে থাকা কমপক্ষে ১০ হাজার ইসরায়েলি সেনার এ ঘোষণা দেখা না যেত– নেতানিয়াহুর বিচারিক সংস্কার কার্যকর হলে তারা তাদের সামরিক ইউনিটে যোগ দেবে না। কয়েক হাজার সেনা এরই মধ্যে বাহিনীতে যোগ দেয়নি এবং সংখ্যাটি ক্রমে বাড়ছে। অন্যদিকে, হাজার হাজার ইসরায়েলি একে অতি ডানপন্থি ক্যু বলে অভিহিত করে এর অবসান চেয়ে ইসরায়েলের সব শহরের প্রধান প্রধান স্থান দখল করে আন্দোলন করছে।

ইসরায়েলি সামরিক বিশ্লেষক এবং উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন সাংবাদিকরা রাজনৈতিক এবং নৈতিক বিতর্কে জড়িয়ে পড়ছেন, যা কয়েক বছর আগেও অকল্পনীয় বলে মনে করা হতো। তাদের প্রশ্ন, সেনাবাহিনী যদি জনগণের বিরুদ্ধে চলে যায় কিংবা জনগণ যদি সরকারকে উৎখাত করে? কিংবা ইসরায়েলে যদি আর গণতন্ত্র না থাকে তাহলে কী হবে?

বস্তুত এরই মধ্যে অনেকেই একমত, শেষোক্ত শঙ্কার কিছু কিছু এরই মধ্যে বাস্তব হতে শুরু করেছে। তারা ইসরায়েলের অভ্যন্তরীণ শক্তিশালী গোয়েন্দা সংস্থা শিন বেটের সাবেক দু’জন প্রধানকে অন্তর্ভুক্ত করেছে।

৩১ আগস্ট একটি চিঠি প্রকাশিত হয়। সেখানে দেখা যাচ্ছে, তারা মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনকে নেতানিয়াহুর সঙ্গে দেখা না করার আহ্বান জানিয়েছেন। তারা লিখেছেন, এ ধরনের সফরকে ‘সরকারি অভ্যুত্থানের বৈধতা’ হিসেবে দেখা হবে। তারা ইসরায়েলি নেতাকে ইসরায়েলের ‘গুরুতর ক্ষতির কারণ’ ঘটানোর দায়ে অভিযুক্ত করেছেন। যেখানে ‘যুক্তরাষ্ট্র এবং ইসরায়েলের মধ্যে রয়েছে কৌশলগত সম্পর্ক।’

ফলে ইসরায়েলকে ‘মধ্যপ্রাচ্যের একমাত্র গণতান্ত্রিক দেশ’ হিসেবে বাজারজাত করার কাজটি আর সহজ হবে না। কারণ, সেখানে ‘গণতান্ত্রিক’ স্তম্ভ ভেঙে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে ‘স্থিতিশীলতা’র স্তম্ভও ভেঙে পড়ছে। স্থিতিশীলতা না থাকলে বিনিয়োগকারীদের চলে যাওয়া ছাড়া আর পথ থাকে না। ইসরায়েলি বাজার ছাড়ার কাজ এরই মধ্যে শুরু হয়েছে। ইসরায়েলের নিজস্ব হিসাব অনুসারে পুঁজি পাচার এমন অবস্থায় গেছে, এটি অনেক বাজার বিশ্লেষককে অবাক করে দিয়েছে। ইসরায়েলের অর্থ মন্ত্রণালয়ের সাম্প্রতিক এক রিপোর্টে প্রকাশ, ২০২০ সালের তুলনায় ২০২২ সালের প্রথম তিন মাসে ইসরায়েলে বৈদেশিক বিনিয়োগ ২ দশমিক ৬ বিলিয়ন অর্থাৎ ৬০ শতাংশ কমে যায়।

নিঃসন্দেহে ‘গণতান্ত্রিক’ এবং ‘স্থিতিশীল’ ইসরায়েলে যা ঘটছে তা নজিরবিহীন। ইসরায়েলের বর্তমান নাজুকতা বৃদ্ধির কারণ হলো, মধ্যপ্রাচ্য এবং বিশ্বের রাজনৈতিক মানচিত্রে ব্যাপক এবং দ্রুত পরিবর্তন হয়েছে। এ অঞ্চলে এবং বিশ্বের অন্যান্য অংশে যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা শক্তির ঘাঁটি দুর্বল হয়ে পড়ায় ইসরায়েলের এক সময়ের শক্তিশালী ভূরাজনৈতিক অবস্থান দুর্বল হচ্ছে।

এই পরিস্থিতিকে ফিলিস্তিনিরা সুযোগ হিসেবে নিতে পারে। তারা ইসরায়েলের ক্ষয়িষ্ণু ‘ব্র্যান্ড’-এর বাস্তবতা প্রকাশ করে দিতে পারে। যে ব্র্যান্ড তৈরি হয়েছে মেকি গণতন্ত্র, সামাজিক অস্থিতিশীলতা এবং সম্পূর্ণ বর্ণবাদের ওপর। এখন ইসরায়েলকে আন্তর্জাতিক আইন মেনে নিতে চাপ দিতে হবে, যা নীতিগতভাবে ফিলিস্তিনি জনগণের ন্যায়বিচার ও স্বাধীনতার গ্যারান্টি দেয় এবং তাদের শরণার্থীদের জন্য অবিচ্ছেদ্য ‘প্রত্যাবর্তনের অধিকার’ নিশ্চিত করে।

এটা বোঝাতে হবে– ফিলিস্তিনিদের ছাড়া ইসরায়েল এক অস্থিতিশীল দেশ, যেখানে অগণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানের ছড়াছড়ি, বর্ণবাদ স্থায়ী রূপ লাভ করেছে এবং বিশৃঙ্খলাও স্থায়ী হয়েছে।

ড. রামজি বারুদ: সাংবাদিক ও প্যালেস্টাইন ক্রনিকল-এর সম্পাদক; মিডল ইস্ট মনিটর থেকে ঈষৎ সংক্ষেপিত ভাষান্তর মাহফুজুর রহমান মানিক

ট্যাগঃ ,

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।