Mahfuzur Rahman Manik
ফিলিস্তিনের সংকট সমাধানে চীন কেন আগ্রহী
সেপ্টেম্বর 4, 2023

লেখক: রামজি বারুদ

ভাষান্তর: মাহফুজুর রহমান মানিক

মধ্যপ্রাচ্যের সংঘাতে মধ্যস্থতায় চীন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। বিশেষ করে ফিলিস্তিনে ইসরায়েলি দখলদারির বেলায় চীনের মধ্যস্থতা সফল হতে পারে। এপ্রিল মাসে সৌদি আরব ও ইরানের পুনর্মিলনে সফল ভূমিকা পালন করেছিল বেইজিং। সেখানে দেখা গেছে, চীনের কূটনীতি কতটা পরিপক্ব। অনেক বছর ধরে বৈশ্বিক বিষয়ে চীন নাক গলাত না। দেশটি তখন হয়তো নিজেদের অর্থনৈতিক সম্প্রসারণ কিংবা আঞ্চলিক অর্থনৈতিক মেলবন্ধনেই মনোযোগী ছিল। সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প চীনকে বিশ্বমুখী করতে বাধ্য করেন কিংবা বহির্বিশ্বের প্রতি চীনের মনোযোগ তখন থেকেই বাড়তে থাকে।

২০১৮ সালের ঘটনা এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ। ডোনাল্ড ট্রাম্প তখন এশিয়ার শক্তিশালী এই দেশটির বিরুদ্ধে নজিরবিহীন বাণিজ্য যুদ্ধ ঘোষণা করে। ট্রাম্পের পরিকল্পনা হিতে বিপরীত হয়। ওই সময় ওয়াশিংটন বেইজিংকে আমেরিকার কাছে মাথা নত করাতে ব্যর্থ হয়। একই সঙ্গে চীনকে ‘উলফ ওয়ারিয়র’ বা নেকড়ে যোদ্ধা কূটনীতি গ্রহণে অনুপ্রাণিত করে। অর্থাৎ পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে আত্মপ্রত্যয়ী ভূমিকায় অবতীর্ণ হয় চীন। আমেরিকা কিংবা পশ্চিমা দৃষ্টিভঙ্গিতে চীনের নতুন কৌশল শত্রুতাপূর্ণ ও আগ্রাসী বলে বিবেচিত হয়। কিন্তু চীনের দিক থেকে এ নীতি অনিবার্য ছিল। কারণ সে সময় মার্কিন প্রশাসনসহ তাদের পশ্চিমা মিত্ররা চীনের বিরুদ্ধে বিরামহীন যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়।

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক সংঘাত ও কূটনীতিতে চীনের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। যদিও মার্চ মাসে ঘোষিত চীনের ১২ দফা শান্তি প্রস্তাব পশ্চিমাদের মুগ্ধ করতে ব্যর্থ হয়। রাশিয়া ভেতরে না হলেও ওপরে ওপরে স্বাগত জানায়। তারপরও এ উদ্যোগ একটি গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তনের আভাস দিচ্ছে। এর মানে, আন্তর্জাতিক ফোরামে চীন এখন আর কারও সহযোগী ভূমিকায় নেই। চীন নিজেই সম্ভাব্য মধ্যস্থতাকারী হিসেবে হাজির হয়েছে।

১২ দফা ঘোষণার তিন সপ্তাহ যেতে না যেতেই চীনের মধ্যস্থতায় ইরান-সৌদি আরবের চুক্তির বিষয়টি প্রকাশিত হয়। এটি ওই অঞ্চলে প্রধান রাজনৈতিক খেলোয়াড় যুক্তরাষ্ট্রসহ অনেককেই অবাক করে। গ্লোবাল সাউথের অনেক সাংবাদিক তখন মধ্যপ্রাচ্যে ওয়াশিংটনের সংঘাতমূলক নীতির তুলনায় চীনের সফলতার গল্প প্রকাশ করেন।

সেই সফলতার হাত ধরেই ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনের মধ্যকার সংঘাত নিরসনে উদ্যোগী হয়েছে চীন। ফিলিস্তিন চীনের এ উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছে; অবশ্য ইসরায়েল ছিল নির্লিপ্ত।

চীন সরকার নিশ্চয় এ ব্যাপারে সচেতন যে, ফিলিস্তিন ও ইসরায়েলকে সত্যিকার শান্তি আলোচনার জন্য এক টেবিলে আনা কঠিন কাজ। যদিও ফিলিস্তিনিরা ওয়াশিংটনের প্রভাব থেকে বের হতে চায়, কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ইসরায়েলের স্বার্থ জড়িত। যুক্তরাষ্ট্র হলো ইসরায়েলের রাজনৈতিক হিতাকাঙ্ক্ষী, অর্থদাতা ও সামরিক সহযোগিতা দানকারী।

চীন ও ইসরায়েল উভয়েই সাম্প্রতিক বছরে অপেক্ষাকৃত শক্তিশালী অর্থনৈতিক ও কৌশলগত সম্পর্ক বজায় রাখছে। ভূ-রাজনৈতিক সংকটে তেল আবিবের কাছে ওয়াশিংটনের তুলনায় বেইজিং অতটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। কারণ, চীন ঐতিহাসিকভাবে ফিলিস্তিনি মানুষের স্বাধীনতা সংগ্রামে পাশে দাঁড়িয়েছে।

কয়েক দশক ধরে প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশনের (পিএলও) মূল সমর্থক হিসেবে ভূমিকা পালন করছে চীন। ফিলিস্তিনের পক্ষে জাতিসংঘে ভূমিকা রাখছে দেশটি। ফিলিস্তিনিদের মর্যাদা রক্ষা এবং ইসরায়েলি দখল বন্ধের দাবি জানিয়ে আসছে চীন। ১৯৬৫ সালে পিএলও এবং ১৯৮৮ সালে ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের স্বীকৃতি দেয় চীন। এখন ফিলিস্তিনকে যেন বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংগঠন/সংস্থার পূর্ণ সদস্য করা হয়, সে চেষ্টা করছে চীন।

মধ্যস্থতার জন্য এপ্রিলে চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী কিন গ্যাং ফিলিস্তিন ও ইসরায়েল উভয় দেশের সঙ্গে কথা বলেন। এ লক্ষ্যে চীন ইতোমধ্যে শান্তির জন্য চার দফা প্রস্তাবের উদ্যোগ নিয়েছে। এই প্রস্তাবে চীন বৈশ্বিক ক্ষেত্রে বাণিজ্যিক অংশীদার হিসেবে তার ভূমিকা এবং রাজনৈতিক খেলোয়াড় হিসেবে তার পদক্ষেপ গুরুত্ব দিয়ে তুলে ধরে। চীনের জন্য এটি মর্যাদার বিষয়। সাম্প্রতিক মাসগুলোয় শান্তির মধ্যস্থতাকারী হিসেবে চীনের আগ্রহ ব্যাপকভাবে বেড়েছে। বিশেষ করে ওয়াশিংটনের অনুপস্থিতির মধ্যে চীন নিজেকে ‘সত্যিকার শান্তির দূত’ হিসেবে ঘোষণা করেছে। এমনকি ফিলিস্তিনের প্রতিদ্বন্দ্বী দলগুলোর মধ্যেও মধ্যস্থতার ব্যাপারে আগ্রহ প্রকাশ করেছে চীন। তবে তা সহজ হবে না। এটা স্পষ্ট, ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি এবং রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ অনেকাংশ আমেরিকা ও পশ্চিমা পুঁজির ওপর নির্ভরশীল। যদিও পররাষ্ট্রমন্ত্রী রিয়াদ আল মালিকিসহ ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ ওয়াশিংটনের ওপর হতাশ হওয়ার কারণে চীনের দিকে ঝোঁকার হুমকি দিয়েছেন। এই পরিবর্তন ওয়াশিংটন মেনে নিলেও তেল আবিব মানবে না।

জুন মাসে প্রেসিডেন্ট মাহমুদ বেইজিং সফর করেন। যদিও ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ পরিচালিত মিডিয়া একে গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে ব্যাপকভাবে প্রচার করে, কিন্তু এটি মৌলিক কোনো পরিবর্তন আনবে না। সেখানে ফিলিস্তিনের প্রতি চীনের ক্রমবর্ধমান আগ্রহের বিষয়ে জোর দেওয়া হয়। চীনকে ফিলিস্তিনিদের প্রয়োজন। কারণ, গ্লোবাল সাউথে তাদের অন্য শক্তিশালী খেলোয়াড় দরকার। তবে তারা যে মধ্যস্থতা চায়, তার সমাধান হয়তো এত সহজে হবে না। মধ্যস্থতার মাধ্যমে সামরিক দখলের পরিসমাপ্তি কিংবা বর্ণবাদী শাসনের শেষ হবে না। এর পরিবর্তে সংহতি গুরুত্বপূর্ণ। ফিলিস্তিনিরা এই সংহতি চায়।

বৈশ্বিক ভূ-রাজনৈতিক মানচিত্রে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন আসছে। গ্লোবাল সাউথের ক্রমবর্ধমান গুরুত্ব ফিলিস্তিনিদের জন্য পশ্চিমা প্রভাব থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সুযোগ তৈরি করেছে। এর মাধ্যমে ফিলিস্তিনকে এশিয়া, আফ্রিকা, দক্ষিণ আমেরিকা ও বাকি বিশ্বের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার সুযোগ এনে দিয়েছে। এ জন্য ফিলিস্তিনিদের তাদের বিষয় ঐক্যবদ্ধভাবে তুলে ধরতে হবে। এখানে নিজেদের মধ্যে রাজনৈতিক বিভাজন ও বিভক্তি কাম্য নয়। তাহলেই কেবল উদীয়মান শক্তিগুলো ব্যাপক পরিবর্তিত এই বিশ্বে ফিলিস্তিনিদের গুরুত্বপূর্ণ ভূ-রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে দেখবে।

রামজি বারুদ: সাংবাদিক ও প্যালেস্টাইন ক্রনিকল-এর সম্পাদক; আরব নিউজ থেকে সংক্ষেপিত ভাষান্তর

সমকালো প্রকাশ: ১৭ আগস্ট ২০২৩

ট্যাগঃ , , ,

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।