একবার পরিচিত একজনের ফেসবুক হ্যাক হয়েছিল। সামাজিক মাধ্যমেই সতর্কবার্তা এলো– কেউ যেন ফেসবুকে এই আইডির সঙ্গে লেনদেন না করে। ততক্ষণে কয়েকজনের টাকা খোয়া গেছে। এমনকি প্রতারক সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির ভাইকে বার্তা পাঠিয়ে বলছে– ভাই, দ্রুত দুই হাজার টাকা মোবাইলে পাঠাও, এখনই জরুরি। ভাইয়ের উপকারার্থে সাতপাঁচ না ভেবে তার দেওয়া নম্বরে টাকা পাঠিয়ে দিয়েছে। সেই টাকা ভাইয়ের কাছে না গিয়ে চলে গেছে প্রতারকের কাছে। এভাবে ভাই, বন্ধু, চাচা, মামার কাছে বিপদে পড়ার নাম করে হ্যাক করা ফেসবুক দিয়ে তারা টাকা হাতিয়ে নেয়। এটি সাইবার অপরাধের একটি দিক। এভাবে ইন্টারনেটে সংঘটিত নানা অপরাধের খবর সংবাদমাধ্যমে এসেছে কিংবা কাছাকাছি অনেকে এর শিকার দেখছি।
বস্তুত মানুষ যত বেশি ইন্টারনেটনির্ভর হচ্ছে, তত বেশি সাইবার অপরাধের হার বাড়ছে। কয়েক বছরে এ অপরাধের বিস্তৃতি এতটাই ঘটেছে যে, রোববার সমকালে প্রকাশিত খবর বলছে, তা ২৮২ শতাংশ পর্যন্ত। অনলাইনে পণ্য বেচাকেনায় প্রতারণা, অপ্রত্যাশিত বার্তা পাঠানো, পর্নোগ্রাফি, সামাজিক মাধ্যমে অপপ্রচার ও ছবি বিকৃতি যেমন রয়েছে, তেমনি অনলাইনে চাকরি দেওয়ার মিথ্যা আশ্বাস, ভুয়া অ্যাপ ব্যবহার, সামাজিক মাধ্যমে ভুয়া অ্যাকাউন্টে অপপ্রচার ইত্যাদি অপরাধ এর অন্তর্ভুক্ত। বাংলাদেশ সাইবার অপরাধপ্রবণতা-২০২৩ প্রতিবেদনে যে বিষয়টি বলা চলে নতুন সেটি হলো, সাইবার অপরাধের শিকার নারীর চেয়েও বেশি হচ্ছে পুরুষ। দেখা যাচ্ছে, ফেসবুক ও অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের আইডি হ্যাকিং-বিষয়ক অভিযোগ বেশি করেছেন পুরুষরা। এই জরিপের আরেকটি দিক হলো, ভুক্তভোগীর ৫৫ শতাংশই বাংলাদেশের তথ্যপ্রযুক্তিবিষয়ক আইন সম্পর্কে জানেন না।
তথ্যপ্রযুক্তিবিষয়ক আইনের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো প্রযুক্তিকে দক্ষ হাতে ব্যবহার। বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) হিসাবে দেশে প্রায় ১৩ কোটি ইন্টারনেট গ্রাহক রয়েছেন। এর মধ্যে কতজন দক্ষতার সঙ্গে ইন্টারনেট ব্যবহার করতে পারেন– সেটি বড় প্রশ্ন। ব্যক্তির সামাজিক মাধ্যমের সুরক্ষায় যে ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হয়, তা হয়তো অনেকের জানা নেই। সুরক্ষিত পাসওয়ার্ডসহ কিছু বিষয় রয়েছে, যার মাধ্যমে ইন্টারনেট জগৎ নিরাপদ করা সম্ভব; যেগুলো অন্যকে বলা যাবে না। অনেক প্রতারক ফোন করে কৌশলে এগুলো উদ্ধার করতে পারে। সে জন্যই দক্ষতার প্রশ্ন। গত বছরের আরেক প্রতিবেদনে প্রকাশ, সাইবার অপরাধের শিকার ৫০ শতাংশ ভুক্তভোগী বিভিন্ন ধরনের সাইবার বুলিংয়ের শিকার। ভালো বিষয় হলো, সম্প্রতি সরকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বুলিং ও র্যাগিং প্রতিরোধে যে নীতিমালা করেছে, তাতে সাইবার বুলিংও অন্তর্ভুক্ত। বিশ্বের অন্যান্য দেশে সাইবার বুলিং আইন অত্যন্ত কঠোর। অর্থাৎ সামনাসামনি যে কাজ করা যাবে না, অনলাইনে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করেও কেউ কারও সঙ্গে একই ধরনের আচরণ করতে পারবে না। এ ক্ষেত্রে কানাডার আইন সবচেয়ে কঠিন। কানাডায় এডুকেশন অ্যাক্ট বা শিক্ষা আইনের মধ্যে সাইবার বুলিং অন্তর্ভুক্ত। সেখানে বলা হয়েছে, কেউ সাইবার বুলিং করলে তাকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে অব্যাহতি দেওয়া হবে। কেউ বারবার করলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে একেবারে বহিষ্কার করাসহ জেলে দেওয়ার বিধান রয়েছে। অবশ্য আমাদের সাইবার নিপীড়নের শাস্তি ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনেও বলা আছে।
সাইবার অপরাধ এড়াতে ডিজিটাল লিটারেসি বা ডিজিটাল সাক্ষরতা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। ডিজিটাল সাক্ষরতার জন্য সরকারের ডিজিটাল লিটারেসি সেন্টার সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারে। যার লক্ষ্য হলো, অনলাইন দুনিয়ায় আরও নিরাপত্তা ও দক্ষতার সঙ্গে বিচরণ। সেখানে যুবকদের জন্য ডিজিটাল লিটারেসি কোর্স যেমন রয়েছে, তেমনি বিনামূল্যে কোর্স রয়েছে অভিভাবক, সাধারণ মানুষ, মাধ্যমিক ও প্রাথমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের জন্যও। তবে প্রাথমিকভাবে ইন্টারনেটে সুরক্ষিত থাকতে দক্ষ হাতে এর ব্যবহার, কাণ্ডজ্ঞান খাটিয়ে কাজ এবং সচেতনতাই কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারে।