Mahfuzur Rahman Manik
প্রশ্নপত্র প্রণেতাদের সামর্থ্য ও সুস্থতা প্রশ্নবিদ্ধ
নভেম্বর 29, 2022
Interview-Taken-by-MahfuzManik

সাক্ষাৎকার: অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ মনিনুর রশিদ

সাক্ষাৎকার গ্রহণ: মাহফুজুর রহমান মানিক

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইআর) অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ মনিনুর রশিদ ২০২২ সালের শুরু থেকে ইউনিভার্সিটি ব্রুনাই দারুসসালামে পোস্ট ডক্টরাল ফেলো হিসেবে আন্তর্জাতিক ও তুলনামূলক শিক্ষা বিষয়ে গবেষণা করছেন। তিনি সরকারি শিক্ষাসংশ্নিষ্ট প্রতিষ্ঠান এবং বেসরকারি ও আন্তর্জাতিক সংস্থার সঙ্গেও কাজ করেছেন। ২০১৪ সালে তিনি অস্ট্রেলিয়ার মনাশ ইউনিভার্সিটি থেকে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটউট থেকে যথাক্রমে ১৯৯৮ ও ১৯৯৯ সালে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর সম্পন্নকারী মনিনুর রশিদের জন্ম ১৯৭৮ সালে, পাবনায়।

সমকাল: চলমান উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় ঢাকা বোর্ডের বাংলা প্রথম পত্রের বিতর্কিত প্রশ্ন নিয়ে সমালোচনা আমরা দেখছি। অনেকে একে 'সাম্প্রদায়িক উস্কানিমূলক' হিসেবে দেখছেন। আপনার কী মনে হয়?

মনিনুর রশিদ: প্রশ্নটি যেভাবে এসেছে তা দুঃখজনক, উদ্বেগজনক এবং অনাকাঙ্ক্ষিত। একে 'সাম্প্রদায়িক উস্কানি'সহ নানাভাবে দেখার সুযোগ রয়েছে নিঃসন্দেহে। একজন শিক্ষাকর্মী হিসেবে প্রথমেই আমি শিক্ষার দৃষ্টিকোণ থেকে দেখব। পরীক্ষায় কোনো ভালো প্রশ্ন নির্ধারণের আগে প্রশ্নকারীদের বিবেচনা করতে হবে- প্রশ্ন সেট করার উদ্দেশ্য কী এবং এই প্রশ্নগুলোর মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের কোন শিখনফল অর্জনের মূল্যায়ন করা হবে। একই সঙ্গে প্রশ্ন তৈরিতে প্রদত্ত নীতিমালা তাঁদের অনুসরণ করতে হবে। সেদিক থেকে উচ্চ মাধ্যমিকের চূড়ান্ত পরীক্ষার জন্য এ প্রশ্ন অপ্রাসঙ্গিক, সমস্যাযুক্ত, সংবেদনশীল এবং অগ্রহণযোগ্য। এতে সামাজিক শান্তি বিনষ্ট এবং সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বন্ধন শিথিল হওয়ার অবকাশ রয়েছে।

সমকাল: এ পরিস্থিতি তৈরি হলো কীভাবে? প্রশ্নটি নিশ্চয়ই মডারেশন বা পুনর্নিরীক্ষার মাধ্যমে এসেছে?

মনিনুর রশিদ: পাবলিক পরীক্ষার প্রশ্ন মডারেশনের মাধ্যমে আসবে- এটাই স্বাভাবিক। প্রশ্নকারী তা জমা দেওয়ার পর অন্তত চারজনের বোর্ডে সেটি মডারেশন হয়। ঢাকা শিক্ষা বোর্ড ইতোমধ্যে সেই চারজন মডারেটরের কথাও বলেছে। প্রশ্নটি সবার চোখ এড়িয়ে গেছে- এটি বিস্ময়কর। এত বড় উদ্দীপক, সেটি ভুলে এড়িয়ে যাওয়ারও সুযোগ নেই। এই প্রশ্নটির ক্ষেত্রে অনুসন্ধান করে দেখতে হবে আসলে কাদের গাফিলতিতে বা দক্ষতার অভাবে এমনটা হয়েছে।

সমকাল: প্রশ্নকারী ও মডারেটরদের চিহ্নিত করেছে ঢাকা শিক্ষা বোর্ড। তাদের কি আর কোনো দায় নেই?

মনিনুর রশিদ: এখানে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে অনেকে জড়িত এবং তাঁদের দায় এড়ানোর সুযোগ নেই। প্রশ্নটির সঙ্গে প্রত্যক্ষ সংশ্নিষ্টজন হিসেবে প্রশ্নকারী ও মডারেটরদের চিহ্নিত করা গেছে- এটি ভালো বিষয়। আর কারা জড়িত, তা সঠিক ও নিরপেক্ষ তদন্ত করলে নিঃসন্দেহে বেরিয়ে আসার কথা। আমরা ঘটনাকে বাইরে থেকে দেখছি, যেখানে সংকটের একটা অংশ আমরা দেখছি, তা হয়তো 'হিমশৈলের চূড়া' মাত্র। নিরপেক্ষ তদন্তের মাধ্যমে ভেতরের দুর্বলতা ও সমস্যা চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নেওয়া দরকার।

সমকাল: কারিগরি শিক্ষা বোর্ডে চলতি উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার বাংলা দ্বিতীয় পত্রের প্রশ্নে আমরা দেখেছি, একজন লেখককে ব্যক্তিগত আক্রমণ করে উদ্দীপক সাজানো হয়েছে।

মনিনুর রশিদ: আমি বিস্মিত, ব্যক্তিগত আক্রমণাত্মক এ উদ্দীপক কীভাবে প্রশ্নে স্থান পেল! পাবলিক পরীক্ষার প্রশ্ন নিয়ে যেখানে এত 'প্রশ্ন'; তার মানে শিক্ষার্থীদের মূল্যায়নে একটি গভীর সংকট স্পষ্ট। প্রশ্ন যাঁরা তৈরি বা মডারেশনের কাজ করছেন, তাঁদের সামর্থ্য, মানসিক সুস্থতা ও উদ্দেশ্য নিয়েও প্রশ্ন ওঠা অস্বাভাবিক নয়। আমি মনে করি, যোগ্য, দক্ষ ও বিশেষজ্ঞদেরই এসব দায়িত্ব দেওয়া উচিত। তা না হলে এমন সংকট বাড়বে। অন্যদিকে শিক্ষার্থীদের শিখনের মূল্যায়নও যথাযথ হবে না। এ ক্ষেত্রে সরকারকে বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে নিয়ে বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের সুরক্ষা এবং জাতীয় সংহতি নিশ্চিত করতে গুণগত ও টেকসই শিক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া দরকার।

সমকাল: বিতর্কিত দুটি প্রশ্নই এসেছে সৃজনশীল উদ্দীপক হিসেবে। সৃজনশীলতার বিচারে একে কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন?

মনিনুর রশিদ: প্রশ্নটি সৃজনশীল উদ্দীপক হিসেবে বলা হলেও একে কোনোভাবেই সৃজনশীল বলা যাবে না। এমনিতেই আমাদের তথাকথিত সৃজনশীল প্রশ্ন নিয়ে অনেক প্রশ্ন রয়েছে। এখানে কাঠামোবদ্ধ প্রশ্নকেই সৃজনশীল নাম দেওয়া হয়েছে। নাম দিলেই তো আর তা সৃজনশীল হয় না। শিক্ষাসংশ্নিষ্টরা জানেন, সৃজনশীল প্রশ্ন এসেছে বেঞ্জামিন ব্লুমসের টেক্সোনমি থেকে; যেখানে শিক্ষার্থীর জ্ঞান, অনুধাবন, প্রয়োগ, বিশ্নেষণ, সংশ্নেষণ এবং মূল্যায়ন যোগ্যতা অনুক্রমিকভাবে দেখা হয়। এসব বিষয়ের যথাযথ সংযোগ ঘটিয়ে কোনো ভালো প্রশ্ন তৈরি করলে সেটিই হবে সৃজনশীল প্রশ্ন। অথচ বিভিন্ন কারণে আমাদের মাধ্যমিকের প্রশ্নগুলো সেভাবে হচ্ছে না।

সমকাল: অন্য বিষয়ের প্রশ্নের কথাও বলছেন। সেগুলোও 'সৃজনশীল' হয় না?

মনিনুর রশিদ: প্রায় এক যুগ আগে সেকেন্ডারি এডুকেশন সেক্টর ইনভেস্টমেন্ট প্রোগ্রাম-সেসিপ প্রজেক্টের মাধ্যমে সৃজনশীল চালু হলেও এখনও অনেক শিক্ষক এ পদ্ধতিতে প্রশ্ন করতে পারছেন না। সব বিষয়েই কমবেশি এমনটা দেখা যাচ্ছে এবং সেটি মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের প্রতিবেদনেই প্রকাশিত। ২০১৯ সালে দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সমীক্ষা চালিয়ে মাউশি দেখিয়েছে, ৪২ শতাংশ শিক্ষক সৃজনশীল বোঝেন না বা সৃজনশীল প্রশ্ন করতে পারেন না। শিক্ষক প্রশিক্ষণসহ নানা কাজে বিপুল অঙ্কের অর্থ খরচ হলেও তার ফল সন্তোষজনক নয়। অন্তত আলোচ্য দুটি প্রশ্ন তারই প্রমাণ দেয়। এর সঙ্গে কর্তব্যে অবহেলা, সঠিক জবাবদিহি ও মনিটরিংয়ের অভাব যুক্ত থাকতে পারে। তাই এই ইস্যুসহ মূল্যায়ন বিষয়ে প্রতিনিয়ত গবেষণা করে অবস্থার উন্নয়নে চেষ্টা করতে হবে।

সমকাল: সৃজনশীলের দুরবস্থার কথা আপনি বলছেন। প্রশ্নে অন্য সমস্যাও স্পষ্ট। যেমন এবার কারিগরি শিক্ষা বোর্ডে সিলেবাসের বাইরে থেকে প্রশ্ন আসা; আবার এসএসসি পরীক্ষার প্রশ্নেও বানান ভুলসহ মারাত্মক ভ্রান্তি আমরা দেখেছি। এটি কি অবহেলা?

মনিনুর রশিদ: এবারের এইচএসসি পরীক্ষার প্রশ্ন নিয়ে একাধিক অভিযোগ এবং এর আগের পাবলিক পরীক্ষার প্রশ্ন নিয়েও যেসব প্রশ্ন উঠেছে; সব মিলিয়ে এখানে যে পেশাদারিত্ব, অবহেলা বা আন্তরিকতার ঘাটতি রয়েছে, তা অস্বীকার করা যাবে না। কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ- প্রশ্ন করার দায়িত্বে যাঁরা রয়েছেন, তাঁদের অবহেলার কারণে কোনো শাস্তি হয়েছে কিনা বা তাঁরা কোনো ধরনের জবাবদিহির সম্মুখীন হয়েছেন কিনা।

সমকাল: অভিযোগ রয়েছে, শিক্ষা বোর্ডের পরিচিতরাই প্রশ্ন তৈরি কিংবা মডারেশনের দায়িত্ব পাচ্ছেন। সে জন্য অনেকেই প্রশ্নে ভুল করেও পার পেয়ে যাচ্ছেন-

মনিনুর রশিদ: পরিচিতদের দিয়ে কাজ করানো একটি সাধারণ প্রবণতা। এখানে অবশ্য বিশ্বস্ততার বিষয়ও রয়েছে। আরও জরুরি বিষয় হলো, যোগ্যতা ও দক্ষতা। কেউ যদি প্রত্যাশিত ভালো মানের প্রশ্ন তৈরি করতে না পারেন, তবে বিকল্প যোগ্যদের বাদ দিয়ে তাঁদের দিয়ে প্রশ্ন করানোর কোনো কারণ নেই। পরিচিত বলে ভুল করলে তাঁকে শাস্তি থেকেও রেহাই দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। আমি মনে করি, প্রতিটি শিক্ষা বোর্ডের যেমন পরীক্ষা বিভাগ কিংবা পরীক্ষা নিয়ন্ত্রণ বিভাগ রয়েছে, তেমনি আলাদা মূল্যায়ন বিভাগ থাকা জরুরি। যাদের কাজ হবে ভালো মানের প্রশ্ন তৈরি, মূল্যায়ন সংক্রান্ত গবেষণা; শিক্ষকদের ভালো মানের প্রশ্ন তৈরি ও মূল্যায়নের ব্যাপারে প্রতিনিয়ত প্রশিক্ষণ এবং প্রণোদনার মাধ্যমে পেশাদারিত্ব তৈরি করা।

সমকাল: কাদের নিয়ে মূল্যায়ন বিভাগ হবে?

মনিনুর রশিদ: প্রতিটি শিক্ষা বোর্ডের মূল্যায়ন বিভাগ বা অ্যাসেসমেন্ট ডিপার্টমেন্টে তাঁরাই কাজ করবেন, যাঁদের এ বিষয়ে ডিগ্রি, পড়াশোনা, প্রশিক্ষণ, দক্ষতা ও গবেষণা রয়েছে। সঙ্গে সংশ্নিষ্ট বিষয়ে বিশেষজ্ঞ থাকবেন। তাঁরা বোর্ডের স্থায়ী কর্মকর্তা হিসেবে কাজ করতে পারেন। ধরা যাক, আমাদের এখানে কোনো দপ্তরে শিক্ষা অথবা মূল্যায়ন বিশেষজ্ঞ পদ আছে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে সেখানে এমন একজন বসে আছেন, যাঁর কোনো শিক্ষা বা মূল্যায়নবিষয়ক ডিগ্রি ও দক্ষতা নেই। এ ক্ষেত্রে তিনি তাঁর দায়িত্ব কীভাবে পালন করবেন? পরীক্ষার প্রশ্নের মাধ্যমে আমরা শিক্ষার্থীদের সফলতা-দুর্বলতা বা পারদর্শিতা মূল্যায়ন করি। এখানেও সংশ্নিষ্ট বিশেষজ্ঞ, দক্ষ ও পেশাদারি জনবল দরকার। চিকিৎসার ডিগ্রি না থাকলে আমরা যেমন কাউকে চিকিৎসক বলি না; বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক না হলে যেমন আমরা তাঁর কাছে বিশেষ চিকিৎসার জন্য যাই না। তবে মূল্যায়ন বিশেষজ্ঞ, দক্ষ ও পেশাদারি না হয়েও যখন প্রশ্ন করা হচ্ছে, তখন যেসব সংকট আমরা দেখছি, সেগুলো হতেই থাকবে।

সমকাল: পাবলিক পরীক্ষার প্রশ্ন যথাযথভাবে তৈরি করার ক্ষেত্রে আপনার কী পরামর্শ?

মনিনুর রশিদ: আমি মনে করি, এটি নিছক প্রশ্ন তৈরির বিষয় নয়। আমাদের মূল্যায়নের গলদটা আসলে গোড়ায় এবং সেখানেই হাত দিতে হবে। নামে সৃজনশীল হলেও যেখানে কাজে সৃজনশীল নয়; সৃজনশীল প্রশ্ন করার ক্ষেত্রে শিক্ষকদের দক্ষতা ও পেশাদারিত্বের অভাব; জবাবদিহি ও মনিটরিংয়ের অভাব থাকে, সেখানে প্রকৃত মূল্যায়ন সম্ভব নয়। আসলে এ পদ্ধতি এবং অপেশাদার ব্যক্তিদের পরিবর্তনের বিকল্প নেই। যাঁরা ভুল করবেন, তাঁদের শাস্তিও নিশ্চিত করতে হবে।

সমকাল: আপনাকে ধন্যবাদ।

মনিনুর রশিদ: সমকালকেও ধন্যবাদ।

সমকালে প্রকাশ ১২ নভেম্বর ২০২২

ট্যাগঃ , , , , , , , ,

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।