
সোমবার একটি জাতীয় দৈনিকের শীর্ষ প্রতিবেদন ছিল- প্রাথমিক শিক্ষায় তুঘলকি কাণ্ড। 'তুঘলকি কাণ্ড' মানে বড়সড় ঘটনা, যেটা সাধারণত জোর খাটিয়ে করা হয়। কয়েকদিন ধরেই সংবাদমাধ্যমে প্রাথমিক শিক্ষার উল্লেখযোগ্য পরিবর্তনের খবর প্রকাশিত হচ্ছে। এর মধ্যে কোনোটা ইতিবাচক হলেও কোনোটা যে তুঘলকি কাণ্ড তা বলাই বাহুল্য। এখানে বিশ্লেষণ নয়; সংক্ষিপ্ত পরিসরে কয়েকটি প্রশ্নের অবতারণা করছি।
প্রথমেই এক শিফট প্রসঙ্গ। রোববার প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে জানানো হয়, দেশের সব প্রাথমিক বিদ্যালয় জানুয়ারি থেকে এক শিফটে শ্রেণি কার্যক্রম পরিচালিত হবে। এটা নিঃসন্দেহে ভালো সিদ্ধান্ত। কিন্তু প্রশ্ন হলো, সব প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সেই সক্ষমতা রয়েছে কিনা। আমরা জানি, বর্তমানে দেশ সাড়ে ৬৫ হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অধিকাংশেরই দুই শিফটে ক্লাস হয়। কারণ, এক শিফটে ক্লাস নেওয়ার মতো যথেষ্ট শিক্ষক ও শ্রেণিকক্ষ নেই। পর্যাপ্ত শিক্ষক ও শ্রেণিকক্ষ নিশ্চিত না করে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে এক শিফট কীভাবে চালু হবে? আমরা জানি, প্রাথমিকে নতুন শিক্ষক নিয়োগের কাজ চলছে এবং নভেম্বরেই তা চূড়ান্ত হওয়ার কথা। প্রশ্ন হলো, এ শিক্ষক দিয়েই কি সংকট শেষ হবে? যেসব প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শ্রেণিকক্ষ নেই, সেখানে রাতারাতি কীভাবে অবকাঠামো গড়ে উঠবে? প্রাথমিক শিক্ষা প্রশাসন বলছে, তাদের প্রস্তুতি রয়েছে। কী সেই প্রস্তুতি?
দ্বিতীয় বিষয়টি সে প্রসঙ্গেই, ওই প্রতিবেদনটি ইঙ্গিত দিয়েছে, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় দুটি প্রাথমিক বিদ্যালয়কে মিলিয়ে একটি বিদ্যালয় করতে চাচ্ছে। যদি তা-ই হয়, সেটি নিঃসন্দেহে তুঘলকি কাণ্ডই হবে। তাহলে এক শিফটে ক্লাস করার এটিই কি সেই প্রস্তুতি। এতে শিক্ষকের না হয় সংকট ঘুচবে, যে বিদ্যালয়টিকে বিলুপ্ত করা হবে, সেখানকার শিক্ষার্থীরা কোথায় যাবে? কোনো গ্রামের দুই প্রান্তে দুটি প্রাথমিক বিদ্যালয় থাকলে অপর প্রান্তের শিক্ষার্থীরা কীভাবে ক্লাস করবে? আবার দুই স্কুলের শিক্ষার্থীদের একীভূত করার মতো অবকাঠামোই বা তৈরি হবে কবে? যেখানে কোথাও কোথাও নতুন প্রাথমিক বিদ্যালয় নির্মাণ করা জরুরি, সেখানে এই উল্টো সিদ্ধান্ত কেন?
তৃতীয় এবং আপাতত শেষ বিষয়, প্রাথমিক শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ-সংক্রান্ত। বর্তমানে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের জন্য ১৮ মাসের ডিপিএড কোর্স রয়েছে। ১৮ মাসের এ কোর্সকে ছয় মাসে পরিণত করার কর্মসূচি হাতে নিয়েছে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। দেশে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগ বিধিমালায় প্রধান শিক্ষক ও সহকারী শিক্ষক নিয়োগে যোগ্যতায় শিক্ষাবিষয়ক ডিগ্রি বাধ্যতামূলক না থাকার কারণে শিক্ষকদের প্রায় ৯৯ শতাংশেরই শিক্ষাবিষয়ক ডিগ্রি থাকে না। অথচ প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিশুদের শিক্ষাদানের জন্য এ বিষয়ে গভীর জ্ঞান ও অনুশীলন প্রয়োজন। পৃথিবীর অনেক দেশে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার আগে শিক্ষাবিষয়ক পেশাগত ডিগ্রি অর্জন করতে হয়। আমাদের দেশে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পেতে শিক্ষাবিষয়ক ডিগ্রি বাধ্যতামূলক না থাকার কারণেই অন্তত দেড় বছরের প্রশিক্ষণ জরুরি। বলা বাহুল্য, একাধিক শিক্ষানীতিতে প্রাথমিক শিক্ষকদের এ প্রশিক্ষণ সময়সূচি বাড়ানোর কথা বলা হয়েছে। অথচ সেখানে কীভাবে উল্টো পথে হাঁটছে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়?
বলার অপেক্ষা রাখে না, পরিবর্তন স্বাভাবিক বিষয়। কিন্তু যে কোনো পরিবর্তন হওয়া উচিত গবেষণার মাধ্যমে এবং কল্যাণের জন্য। এর বিপরীতে পরিবর্তন ভালোর বদলে খারাপ ফল বয়ে আনে। প্রাথমিক শিক্ষায় যে ধরনের পরিবর্তন আসছে, সেগুলো কতটা পরিকল্পিত এবং গবেষণার মাধ্যমে করা হচ্ছে? আমরা দেখছি, এমনকি ডিপিএড কোর্সকে সংক্ষিপ্ত করার ক্ষেত্রে সংশ্নিষ্টদের পরামর্শ নেওয়া হয়নি। এক শিফটে ক্লাস ভালো সিদ্ধান্ত হলেও সেই সক্ষমতা এখনই নেই। তাহলে কেন এই মুহূর্তে ঘোষণা দেওয়া। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় ও শিক্ষার নীতিনির্ধারকরা নতুন পরিকল্পনা বাস্তবায়নের আগে আবার ভাববেন। প্রাথমিক শিক্ষার কোমলমতি শিশুদের নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট বা পরীক্ষার কোনো সুযোগ নেই।