Mahfuzur Rahman Manik
প্রশ্নফাঁসের ভূতগ্রস্ত সরিষা
আগস্ট 26, 2022

প্রশ্নফাঁস বিষবৃক্ষের চারা কীভাবে মহিরুহ হয়ে উঠেছে, তার প্রমাণ আমরা প্রায়ই দেখেছি। ছাত্র, শিক্ষক, চিকিৎসক, কর্মচারী-কর্মকর্তা থেকে জনপ্রতিনিধি, এমনকি অধ্যক্ষও এর বাইরে নন! মঙ্গলবার সমকালে নার্সিং কলেজের পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসে জড়িত থাকার কারণে ছয়জন গ্রেপ্তার হওয়ার খবর প্রকাশ হয়। প্রতিবেদন অনুসারে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত নার্সিং কলেজের পরীক্ষার প্রশ্নপত্র তৈরি, প্যাকেজিং এবং সরবরাহের জন্য যে গোপন টিম রয়েছে, সেখানে নার্সিং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অধ্যক্ষ থেকে শিক্ষক থাকেন। কিন্তু এই রক্ষকদেরই একটি অংশ ভক্ষকের কাজ করে পরীক্ষার আগে অর্থের লোভে প্রশ্ন ফাঁস করে দেন!
নার্সিং কলেজের প্রশ্নফাঁস চক্রকে গ্রেপ্তারের পর আমরা জেনেছি, পাঁচ বছর ধরে তারা এ অপকর্ম চালিয়ে যাচ্ছে। র‌্যাব জানিয়েছে, তারা নার্সিং কলেজের পাশাপাশি অন্যান্য পরীক্ষার প্রশ্নও ফাঁস করত। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, এ চক্রের মূল হোতা হিসেবে যে নারী গ্রেপ্তার হন, তিনি ২০০৮ সাল থেকে ঢাকার একটি সরকারি নার্সিং কলেজে নার্সিং প্রশিক্ষক হিসেবে কর্মরত ছিলেন এবং ২০১৬ সালে অবসরে যাওয়ার পর একটি বেসরকারি নার্সিং কলেজে অধ্যক্ষ হিসেবে যোগ দেন। অধ্যক্ষ হিসেবে যখন নার্সিং কলেজের পরীক্ষার প্রশ্নপত্র প্রণয়নসহ দায়িত্বশীল ভূমিকায় অবতীর্ণ হন, তখনই তিনি এ সুযোগের অসৎ ব্যবহার শুরু করেন প্রশ্নফাঁসের মাধ্যমে।
বলা বাহুল্য, ভর্তি পরীক্ষা, চাকরির পরীক্ষা, বোর্ড পরীক্ষা অর্থাৎ প্রতিযোগিতামূলক প্রায় সব ধরনের পরীক্ষায়ই প্রশ্নফাঁসের অঘটন ঘটেছে। প্রশ্নপত্র ফাঁসের মাধ্যমে অনেকেই বিপুল অর্থের মালিক হয়েছেন। নার্সিং কলেজের এ অঘটনে র‌্যাব বলছে, ফাঁস হওয়া প্রশ্নপত্র দিয়ে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে ১৫ হাজার টাকা করে নেওয়ার তথ্য মিলেছে। অর্থের লোভে যেভাবে একজন দায়িত্বশীল ব্যক্তি নীতি-নৈতিকতা ভুলে প্রশ্নফাঁসে জড়িত হন, তা নিঃসন্দেহে বেদনাদায়ক। প্রশ্নফাঁসের ঘটনা জাতি হিসেবেও আমাদের জন্য কলঙ্কের বিষয়। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন পরীক্ষায় প্রশ্নফাঁস চক্রে জড়িতদের ধরা হলেও এ অপচর্চা বন্ধ হচ্ছে না। প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষাগুলোতে প্রার্থীর মেধার মূল্যায়ন করা হয় বিধায় এখানে নূ্যনতম অনিয়মও গ্রহণযোগ্য নয়। পরীক্ষার নিরিখে মেধা ও যোগ্যতার মাপকাঠিতে যারা এগিয়ে থাকবে, তাদেরই অগ্রাধিকার কিংবা ক্ষেত্রবিশেষে চাকরি পাওয়া উচিত। অথচ প্রশ্নফাঁস অযোগ্যদের এগিয়ে যাওয়ার পথ প্রশস্ত করে। যার প্রভাবে আক্রান্ত হতে পারে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা, সমাজ এবং প্রশাসন। এর সুদূরপ্রসারী নেতিবাচক ফল আমরা কল্পনাও করতে পারি না।
এক সময় পাবলিক পরীক্ষাগুলোতে প্রশ্নফাঁসের ঘটনা উদ্বেগজনক পর্যায়ে পৌঁছেছিল। স্বস্তির বিষয়, প্রশাসনের কঠোর পদক্ষেপে পাবলিক পরীক্ষা প্রক্রিয়া প্রশ্নফাঁসের বৃত্ত থেকে বেরিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছে। ঠিক একইভাবে সরকার চাইলে চাকরির পরীক্ষা, ভর্তি পরীক্ষাসহ সব পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়া বন্ধ করতে পারে। নার্সিং কলেজের প্রশ্নফাঁস চক্রটি ধরা পড়ার পেছনেও র‌্যাবের ভূমিকা উল্লেখযোগ্য। গত ২০ আগস্ট অনুষ্ঠিতব্য পরীক্ষার আগের দিন প্রশ্নপত্র বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমে আদানপ্রদান করার প্রমাণ পাওয়ার পর র‌্যাব যেভাবে গোয়েন্দা নজরদারি করে এবং অভিযান চালিয়ে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা থেকে প্রশ্নপত্র ফাঁস চক্রের মূল হোতাসহ সদস্যদের গ্রেপ্তার করতে সক্ষম হয়, তা প্রশংসনীয়। কিন্তু প্রশ্নপত্র ফাঁসের অপরাধে অনেকে গ্রেপ্তার হলেও কারও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হয়েছে বলে আমাদের জানা নেই।
প্রশ্নফাঁস বন্ধে এর সঙ্গে জড়িতদের শাস্তি যেমন প্রয়োজন; তেমনি এটি কতটা অনৈতিক- সেটিও বোঝানো দরকার। একজন অধ্যক্ষ যখন দায়িত্বের কারণে বিভিন্ন গোপনীয়তা জানেন; সেটি প্রতিষ্ঠানের স্বার্থে গোপন রাখা জরুরি। তা না করে একে সুযোগ হিসেবে নিয়ে নিজের পকেট ভারী করার মাধ্যম বানানো গর্হিত কাজ এবং গুরুতর অপরাধ। প্রশ্নফাঁসের অন্য ঘটনাগুলোতে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ভেতরের কারও না কারও সহযোগিতার প্রমাণ মিলেছে। সরিষার মধ্যে ভূত পাওয়ার যে বাংলা প্রবাদ রয়েছে, এ ক্ষেত্রে তার সার্থক রূপায়ণ ঘটেছে। প্রশ্নফাঁস বিষবৃক্ষের ডালপালা আর সামনে বাড়তে দেওয়ার আগেই এর মূলোৎপাটন জরুরি।

সমকালে প্রকাশিত ২৫ আগস্ট ২০২২

ট্যাগঃ , , , , ,

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।