অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ- এ তিন কাল নিয়েই আমাদের পথচলা। আজ আমরা যা করছি, আগামীকাল সেটাই অতীত। তারপরও অতীত আমাদের পথ দেখায় নানাভাবে। সেই পুরোনো কাজগুলো সংরক্ষণের ব্যবস্থাই আর্কাইভ। সংবাদপত্র দিয়ে তা খুব সহজেই বোঝানো যায়। দৈনিক সংবাদপত্র নতুন ঘটনাপ্রবাহ নিয়ে প্রতিদিন প্রকাশ হয়। যেদিন পত্রিকা প্রকাশ হয়, ওই দিন যেমন তার কদর থাকে; পরদিন তা থাকে না। পরদিন তা পুরোনো হয়ে গেলেও কোনো কোনো কাজে লাগে বলেই সেগুলো আর্কাইভে সংরক্ষণ করা হয়। আপনি যখন একটু পেছনে গিয়ে পুরোনো ঘটনাগুলো জানতে চাইবেন তখন সংশ্নিষ্ট দিনের পত্রিকাটি পেতে আপনাকে আর্কাইভের দ্বারস্থ হতে হয়। তথ্যপ্রযুক্তির কল্যাণে বর্তমানে অধিকাংশ সংবাদপত্রের নিজস্ব ওয়েবসাইটেই আর্কাইভ থাকে। অনলাইনে থাকা ই-পেপার থেকে মুদ্রিত সংবাদপত্রেরও হুবহু দেখার ব্যবস্থা থাকে। কিন্তু যখন ইন্টারনেট ছিল না, সে সময়ের সংবাদপত্রগুলো কোথায়? সেগুলোও অধিকাংশ সংবাদপত্র নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় যেমন সংরক্ষিত থাকে, তেমনি সরকারিভাবেও সংরক্ষণ করা হয়। দেশের পুরোনো পত্রিকার সবচেয়ে বড় আর্কাইভ প্রেস ইনস্টিটিউট বাংলাদেশ বা পিআইবি গ্রন্থাগার। এ ছাড়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগার, শাহবাগের গণগ্রন্থাগার এবং জাতীয় আর্কাইভসেও পুরোনো পত্রিকার সংগ্রহ রয়েছে।
বাংলাদেশে আর্কাইভ নিয়ে কাজ করছে আরকাইভ ও গ্রন্থাগার অধিদপ্তর। বাংলাদেশ সরকারের গুরুত্বপূর্ণ ও স্থায়ী দলিল-দস্তাবেজ সংগ্রহ, সংরক্ষণসহ দেশের ইতিহাস ও ঐতিহ্য সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে সরকার ১৯৮৩ সালে জাতীয় আর্কাইভ অধ্যাদেশ জারি করে। বাংলাদেশ জাতীয় আর্কাইভ গত কয়েক দশকে বিভিন্ন সংস্থা ও উৎস থেকে বিপুল পরিমাণ নথিপত্র সংগ্রহ করেছে। এগুলোর মধ্যে প্রাচীন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নথি, বিশিষ্টজনের ব্যক্তিগত নথিপত্র, সংবাদপত্রের গুরুত্বপূর্ণ প্রেস ক্লিপিং, এস্টেট রেকর্ড, সরকারি প্রকাশনা, পুরাতন মানচিত্র, কালেক্টরেট রেকর্ড, জাতীয় সংসদের রেকর্ড ইত্যাদি। জাতীয় আর্কাইভে থাকা এসব রেকর্ড গবেষক, লেখক, সাহিত্যিক, শিক্ষার্থী ও প্রশাসকদের প্রয়োজনে কাজে লাগছে। সরকারের বিভিন্ন বিভাগও প্রয়োজন অনুসারে আর্কাইভ থেকে সেবা নিয়ে থাকে। বাংলাদেশ জাতীয় আর্কাইভ ইন্টারন্যাশনাল কাউন্সিল অন আর্কাইভস বা আইসিএর সদস্য।
আর্কাইভ পুরোনো বিষয়াদি সম্পর্কিত হলেও তা বর্তমান ও ভবিষ্যতের জন্য সমান প্রাসঙ্গিক। আগেই বলেছি, আর্কাইভ অতীতের সাক্ষী, বর্তমানের সিদ্ধান্ত গ্রহণের নির্দেশক এবং ভবিষ্যতের পথচলার প্রেরণা। সময়ের পরিবর্তনে আর্কাইভের ধরনেও পরিবর্তন এসেছে। কোনো নথি সংরক্ষণে আগে হয়তো স্তূপ আকারে ফাইল রাখতে হতো। নথি রাখার জন্য কিংবা পত্রিকার ফাইল রাখার জন্য আগে বড় সংরক্ষাণাগার রাখা প্রয়োজন। বলা বাহুল্য, আর্কাইভের অর্থ মহাফেজখানা। এখন আর বড় বড় দালানের সেই মহাফেজখানার প্রয়োজন নেই। এখন আর্কাইভ হচ্ছে অনলাইনে। ডিজিটালাইজেশনে আর্কাইভের রূপ অনেকটাই পাল্টে গেছে। হার্ড কপির পরিবর্তে সফট কপি রাখা অনেক ক্ষেত্রে সাশ্রয় হলেও বছরের পর বছর সংরক্ষণের ক্ষেত্রে সতর্কতারও বিকল্প নেই। কারণ হার্ড কপি ধ্বংস করতে সময় লাগলেও এক ক্লিকেই হয়তো বছরের পর বছর ধরে সংরক্ষিত সফট কপি হয় 'ডিলিট' বা শেষ হয়ে যেতে পারে।
নথির যেমন আর্কাইভ হয়; তা জাদুঘরেও সংরক্ষিত থাকতে পারে। কিন্তু আর্কাইভে থাকা আর জাদুঘরে থাকার মধ্যে পার্থক্য আছে। জাদুঘরে প্রদর্শনী হয়; সেগুলো সাধারণত ব্যবহার করা যায় না। কিন্তু আর্কাইভে থাকা নথি ব্যবহারযোগ্য হতে হয়। সংশ্নিষ্ট দিনের সংবাদপত্র যেমন পড়া যায়, তেমনি ১০ বছরের আগের সংবাদপত্র আর্কাইভে থাকা মানে তা পড়া যাবে; প্রয়োজনে ছবি তুলে কিংবা প্রিন্ট করেও নেওয়া যাবে। অনলাইনে থাকলেও ক্লিক করে সেটি সামনে আনা যাবে। আর্কাইভ সত্য ও নির্ভরযোগ্য হওয়া জরুরি। আর্কাইভ এক ধরনের প্রমাণ। ৫০ বছর আগে সংবাদমাধ্যমে যে ছবিটি প্রকাশ হয়েছে, তা আজও আদালতে প্রমাণ হিসেবে উপস্থাপনের যোগ্য।
পৃথিবীর সবকিছু নশ্বর। আর্কাইভে থাকা গুরুত্বপূর্ণ দলিলও হয়তো এক সময় হারিয়ে যাবে। তারপরও যেগুলোর উপযোগিতা রয়েছে, সেগুলো থাকবে শত শত বছর স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে কিংবা মানুষের হৃদয়ে। আমাদের উপযোগিতা কতদিন থাকবে, তা আমাদের কাজই ঠিক করে দেবে।